নেতানিয়াহুর সরকারকে সমর্থন বন্ধ করতে হবে
২০১৬ ও ২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক বাছাইয়ে সামনের সারির প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বার্নি স্যান্ডার্স। ২০১৬ সালে প্রার্থিতার দৌড়ে হেরে গেলেও নিজের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনকে সমর্থন দেন তিনি। ২০২০ সালে হেরে যান বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে। ১৪ মে নিউইয়র্ক টাইমসে এক কলামে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেন তিনি। বার্নি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত একজন সিনেটর। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য নিউইয়র্ক টাইমসে তাঁর প্রকাশিত কলামটি তুলে ধরা হলো।
‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে’—ফিলিস্তিনের গাজা থেকে ছোড়া রকেট হামলার জবাবে ইসরায়েল তার বিশাল সামরিক শক্তি ব্যবহার করার পর আমরা ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—দুই পক্ষের মুখ থেকেই এই শব্দগুলো শুনতে পাই।
চলুন, তাহলে খুলে বলা যাক। যেকোনো সরকারেরই আত্মরক্ষা বা তার জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার অধিকার রয়েছে। সেটা ইসরায়েলেরও রয়েছে। এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই বা কেউ তর্কও করছে না। তাহলে এই একই শব্দগুলো কেন বছরের পর বছর, যুদ্ধের পর যুদ্ধে পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে? ‘ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকারগুলো কী’—কেন এই প্রশ্নটা কখনোই করা হচ্ছে না?
কেন শুধু ইসরায়েলের ওপর রকেট হামলা হলেই আমরা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সংঘাতের দিকে নজর দিই?
এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত, যত দ্রুত সম্ভব দুই পক্ষের প্রতি অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানানো। আমাদের একটা জিনিস বোঝা উচিত, ইসরায়েলের বাসিন্দাদের ওপর হামাসের রকেট ছোড়া সত্যি অপ্রত্যাশিত। যদিও চলমান সংঘর্ষ এসব রকেট হামলার মাধ্যমে শুরু হয়নি।
জেরুজালেমে শেখ জাররাহর কাছে বসবাস করা ফিলিস্তিনিরা বহু বছর ধরে উচ্ছেদের আশঙ্কা নিয়ে দিন পার করছে। তাদের বাধ্যতামূলক বাস্তুচ্যুতির জন্য আইনি ব্যবস্থার ছক আঁকা হচ্ছে সেখানে। দুঃখজনকভাবে, এসব উচ্ছেদ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিপীড়নের বিস্তৃত ব্যবস্থার একটি অংশ মাত্র।
বহু বছর ধরে আমরা পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলের দখলদারি আরও গভীরে যেতে দেখে আসছি। গাজার ওপর নিয়মিত অবরোধ ফিলিস্তিনিদের জন্য আরও অসহনীয় হয়ে উঠেছে। গাজায় প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দা রয়েছে। সেখানকার যুবকদের ৭০ শতাংশই বেকার, যাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি আশা নেই।
এদিকে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ইসরায়েলে থাকা ফিলিস্তিনের নাগরিকদের প্রান্তিকীকরণে কাজ করছে। সম্ভাব্য দ্বি-রাষ্ট্রের সমাধানের বিষয়টি ঠেকিয়ে রাখতে ইহুদি বসতি স্থাপনকে আরও বেগবান করার পাশাপাশি এমন সব আইন পাস করছে, যাতে ইসরায়েলের ইহুদি ও ফিলিস্তিনের নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য একটা ‘সিস্টেম’ তথা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এসব কোনো কিছুই জেরুজালেমে অস্থিরতা তৈরিতে হামাসের হামলাকে বৈধতা দেয় না। তবে আসল কথা হচ্ছে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডের মধ্যে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে ইসরায়েল। যারা শান্তি ও ন্যায়বিচারের পথে না হেঁটে অসমতা ও অগণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের দিকে এগোচ্ছে।
প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলে ডানপন্থী শাসন কায়েম করে আসছেন নেতানিয়াহু। এই সময়ে তিনি ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণু ও স্বৈরাচারী ধরনের বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ক্ষমতায় থাকা ও দুর্নীতির অভিযোগে বিচার এড়াতে নেতানিয়াহু ইতামার বেন গভিরের মতো ব্যক্তি এবং কট্টরপন্থী ইহুদি পাওয়ার পার্টিকে সরকারে যুক্ত করেছেন। এটি খুবই দুঃখজনক যে বর্ণবাদী লোকজন যাঁরা জেরুজালেমের রাস্তাঘাটে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা করেন, তাঁরাই এখন ইসরায়েলি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেন।
এসব বিপজ্জনক প্রবণতা শুধু ইসরায়েলের জন্য আলাদা কিছু নয়। ইউরোপ, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়ে এমন স্বৈরাচারী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান দেখেছি। এসব আন্দোলন সমৃদ্ধি, ন্যায়বিচার ও শান্তির পরিবর্তে কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষে শক্তি তৈরি করতে জাতিগত বিদ্বেষকে কাজে লাগায়। গত চার বছর এসব আন্দোলনের পক্ষে হোয়াইট হাউসে একজন ‘বন্ধু’ ছিলেন।
আশার কথা হচ্ছে, একই সময়ে আমরা এমন একটি সক্রিয় নতুন প্রজন্মের উত্থান দেখছি, যারা মানুষের প্রয়োজন ও রাজনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে সমাজ তৈরি করতে চায়। জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গত গ্রীষ্মে আমেরিকার রাস্তায় এদের দেখেছি। আমরা তাদের ইসরায়েলে দেখি। আমরা তাদের ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডেও দেখতে পাই।
নতুন প্রেসিডেন্ট আসার পর ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রে এখন বিশ্বে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। হতে পারে, এটি দরিদ্র দেশগুলোকে টিকা পেতে সাহায্য করার মাধ্যমে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বা বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মাধ্যমে। সংঘাতের বিরুদ্ধে সহযোগিতাকে উৎসাহিত করায় যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যে, যেখানে আমরা ইসরায়েলকে প্রতিবছর প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়ে থাকি। সুতরাং আমাদের উচিত, ডানপন্থী নেতানিয়াহুর সরকার এবং তাঁর অগণতান্ত্রিক ও বর্ণবাদী আচরণের প্রতি কোনোভাবেই সমর্থন না করা। আমাদের অবশ্যই এই ধারার পরিবর্তন করতে হবে এবং বেসামরিক মানুষকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক আইনকে শক্তিশালী ও সমুন্নত করতে ন্যায়সংগত উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতা যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহার না হয়, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান আইন মেনে চলতে হবে।
এই প্রস্তাবে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে, ইসরায়েলের শান্তি ও নিরাপদে থাকার পূর্ণ অধিকার রয়েছে এবং একই অধিকার ফিলিস্তিনেরও রয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ গড়তে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি বিশ্বমঞ্চে মানবাধিকারের একটি বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠস্বর হতে চায়, তবে রাজনৈতিকভাবে কঠিন হওয়া সত্ত্বেও আমাদের অবশ্যই মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। আমাদের অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে, ফিলিস্তিনিদের অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের জীবনও গুরুত্বপূর্ণ।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন রাকিব হাসান।