জেরুজালেমের বেলফুর স্ট্রিটের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ছাড়ার অভিজ্ঞতা নেতানিয়াহুর পরিবারের নতুন নয়। ২০১৬ সালে পশ্চিম তীরের আমোনায় অবৈধ ইহুদি বসতি থেকে উচ্ছেদ হওয়া একদল লোকের সঙ্গে দেখা করার সময় প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁদের বলেছিলেন, ‘বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হওয়ার জ্বালা আমি বুঝি। ১৯৯৯ সালে আমি নির্বাচনে হারার পর বিনা নোটিশে আমাকে ও আমার পরিবারকে বেলফুর স্ট্রিটের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সোজা কথায়, আমাদের কাপড়চোপড় ও টুকটাক জিনিসপত্র নিয়ে আক্ষরিক অর্থে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হয়েছিল। সেখান থেকে বাধ্য হয়ে আমাদের শেরাটন প্লাজা হোটেলে উঠতে হয়েছিল। সে এক ভয়াবহ ব্যাপার।’
১৯৯৯ সালের নির্বাচনে পার্লামেন্টে লিকুদ পার্টি ১৯টি আসন পেয়েছিল, অর্থাৎ এহুদ বারাকের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির চেয়ে ৭টি আসন কম পেয়েছিল তারা। পরস্পরবিরোধী নীতিতে থাকা দলগুলোর জোট সরকার যেভাবে শপথ নিয়েছিল; বামপন্থী মেরেৎস, মধ্যপন্থী হামেরকাজ পার্টি ও উগ্র ডানপন্থী কয়েকটি দল সে বছর সরকার গঠন করেছিল। সেই জোট দুই বছরের কম সময় ক্ষমতায় টিকে ছিল। একই কায়দায় নতুন সরকার গঠিত হলো ইসরায়েলে। ১৯৯৯ সালের এহুদ বারাকের সেই স্বল্পায়ু সরকার থেকে আমরা ইয়ামিনা পার্টির নেতা নাফতালি বেনেট এবং ইয়েশ আতিদ পার্টির নেতা ইয়ায়ির লাপিডের নবগঠিত সরকারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কি শিক্ষা নিতে পারি?
যে জোটে ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দল থেকে শুরু করে মেরেৎস পার্টির মতো এমন দল আছে, যার নেতারা অবৈধ বসতিকে স্বীকৃতি দেন না এবং সে এলাকায় উৎপাদিত পণ্য বর্জন করে থাকেন, সেই জোটের সরকার কত দিন টিকবে, তা একটি বড় প্রশ্ন। লেবার পার্টির চেয়ারম্যানের পদে থাকা নারী অধিকারপন্থী মেরাভ মিশালি কি তাঁর উল্টো আদর্শে অবস্থান নেওয়া রক্ষণশীল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আয়েলেৎ শাকেদের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে পারবেন?
১৯৯৯ সালে এহুদ বারাকের হাতে যে তাস ছিল, নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের হাতে তার চেয়ে অনেক খারাপ তাস। এই দিয়েই তাকে খেলতে হবে।
প্রথমত, শুধু ইসরায়েলে নয়, দুনিয়ার কোথাও আজ পর্যন্ত মাত্র ৬ শতাংশ ভোট পাওয়া দল থেকে কোনো নেতা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তার নজির নেই। ১২০ আসনের পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী বেনেটের দল ইয়ামিনা পার্টি পেয়েছে মাত্র ৭টি আসন। নতুন জোটের এগিয়ে থাকা অন্য নেতাদের বাদ দিয়ে কৌশলগত কারণে বেনেটকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে। নতুন সরকারের বেনেটকে ও অন্য ডানপন্থী নেতাদের এখন জোটভুক্ত লেবার পার্টি, মেরেৎস পার্টি এবং ইউনাইটেড আরব লিস্ট-এর নেতাদের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে শুধু লিকুদ পার্টির নেতানিয়াহুকে সরানোর স্বার্থে।
আদর্শগত বিরোধ সরিয়ে রেখে তাঁদের এক হওয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে, তাঁরা সবাই নেতানিয়াহুর ব্যক্তিত্বকে অপছন্দ করেন এবং সবাই তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত চান। নতুন সরকারের মধ্য-ডানপন্থী শরিক দলগুলোর নেতাদের মূল ক্ষোভ নেতানিয়াহুর প্রতি। যদি চলমান মামলায় নেতানিয়াহুর সাজা হয় এবং তিনি লিকুদ পার্টির নেতৃত্ব হারান কিংবা যদি লিকুদ পার্টি তাঁকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়, তাহলে এই মধ্য দক্ষিণপন্থী দলগুলো লিকুদ পার্টির সঙ্গে জোট করবে বলে জোরালোভাবে মনে করা হয়।
নেতানিয়াহু তাঁর উত্তরসূরি বেনেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। এমনকি তল্পিতল্পা গুছিয়ে বিরোধী দলের আসনে যাওয়ার সময়ও হুংকার দিয়েছেন। মনে রাখা দরকার, ২০২১ সালের নেতানিয়াহু ২২ বছর আগের তরুণ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নন। এখন তিনি অনেক ঝানু এবং এখন তাঁর সমর্থনে আছে গরম মাথার দক্ষিণপন্থীরা।
নেতানিয়াহু সরকারের অন্তিম দিনগুলোতে উগ্র কট্টরবাদী দলগুলো এবং তাদের সমর্থক ধর্মীয় নেতারা বেনেটের বিরুদ্ধে যে স্লোগান এবং যে ভাষায় উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, তা ১৯৯৫ সালে কট্টরবাদীদের হাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের নিহত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই হিংসা ও ঘৃণা লেলিহান শিখায় আইনের শাসনের জল ঢেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং বহু মতের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করাই বেনেটের সরকারের প্রথম কাজ হতে হবে।
বেনেট-লাপিডের জোট ভালো করেই জানে, নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলো তাদের দুর্বলতা চিহ্নিত করবে এবং জোটের যে জায়গায় ফাটল পাবে, সেখানেই বিস্ফোরক রেখে তাতে আগুন ধরিয়ে দেবে। রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্ক, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের জমি দখল, সমকামীদের অধিকারের মতো অতি সংবেদনশীল বিভিন্ন ইস্যুতে আইন পাসের বিষয়গুলোকে তারা বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার করবে।
গাজা থেকে যদি হামাস আবার রকেট ছোড়ে, তাহলে প্রধানমন্ত্রী বেনেট কী করবেন? তিনি যদি গাজায় পাল্টা আঘাত চালানোর নির্দেশ দেন, তাহলে জোট সরকারে থাকা আরব দল ইউনাইটেড আরব লিস্ট-এর নেতা মানসুর আব্বাসই–বা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন? তখন নিজেদের মধ্যে কলহ লেগে জোট ভেঙে চৌচির হবে। এই ধরনের পরিস্থিতির অপেক্ষায় আছে নেতানিয়াহুর দল।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
আকিভা এলডার ইসরায়েলি লেখক ও হারেৎজ পত্রিকার কলামিস্ট