বাংলাদেশের মধ্যমপন্থী, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মভীরু, পরিশ্রমী, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইনসাফ-প্রত্যাশী নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা ‘সাইলেন্ট মেজরিটি’ আজ এক অদ্ভুত বাস্তবতায় উপনীত। সারা বছর ধরে নির্বাচনী অনিশ্চয়তা-সৃষ্ট সংকটের উত্তাপে ধরাশায়ী হয়েছে খেটে খাওয়া মানুষ, শিশু, নারী, ছাত্র, তরুণ, উদ্যোক্তা, গৃহিণী, গ্রামের মানুষ, শহরের মানুষ, সফরে আসা মানুষসহ সব শ্রেণী-পেশার জনগণ।
সর্বব্যাপী এই ক্ষতি, দুশ্চিন্তা ও আহাজারি গুমরে গুমরে সারা বাংলাদেশকে উদ্বেলিত করলেও সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুভূতি ও দায়িত্ববোধ স্পর্শ করতে পারেনি। বরং নীতিবিবর্জিত রাজনৈতিক পাশা খেলার সর্বশেষ চালে ‘সাইলেন্ট মেজরিটি’র ভোটাধিকার হরণের আয়োজনও চূড়ান্ত।
আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ হওয়ার হিড়িকে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক অধ্যায়ে প্রত্যাবর্তনের এই ন্যূনতম অর্জন তথা ভোটাধিকারও আজ কার্যত অনুপস্থিত হয়ে গেছে। অবস্থা এমন যেন মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত এই দেশে সাধারণ মানুষ আজ অপাঙেক্তয়, অপ্রাসঙ্গিক ও মূল্যহীন। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণকে নিজ দেশেই রাজনৈতিক নির্বাসন দেওয়ার এই আয়োজন সম্পন্ন করা হচ্ছে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেই। এই পরিণতি ও এই অবস্থা কি মেনে নেওয়া যায়?
নির্বাচনী অনিশ্চয়তা সংকটের তাৎক্ষণিক কারণ হলেও বর্তমান সংকটের জন্ম একটি গভীরতর শাসন সংকট থেকে। গত ১৩ ডিসেম্বর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত নাগরিক আলোচনায় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যথার্থই বলেছিলেন, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের উৎখাত হয়েছিল বটে কিন্তু পরবর্তী দুই দশকেরও বেশি গণতান্ত্রিক অধ্যায়ের সময়কালে এক অভিন্ন একনায়কতান্ত্রিক শাসন দর্শনেরই সাধনা লক্ষ করে গেছে। ধাপে ধাপে এক অসম্ভব ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রিত্বের উদ্ভব হয়েছে, যেখানে স্বৈরতন্ত্রের মতো ‘আমি’র প্রাধান্যই নিরঙ্কুশ ও যার অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ হয়েছে অনিয়ম, দুর্নীতি, রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্রমবর্ধমান অগণতান্ত্রিক ব্যবহার ও মেধার সর্বব্যাপী অবমূল্যায়ন। যেখানে নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের সরব উদ্যোগে তিলে তিলে ভঙ্গুর অর্থনীতি চার দশকে এক ঈর্ষণীয় সবলতায় উপনীত হয়েছে, সেখানে অপরিণামদর্শী নেতৃত্ব সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বমঞ্চে দেশের ভাবমূর্তির উজ্জ্বলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছেন। সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, আজ কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকেও নানা ধরনের বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের আশঙ্কা আর তাত্ত্বিক পর্যায়ে নেই। একনায়কতান্ত্রিক শাসন দর্শনের সর্বশেষ পরিণতি আজ আমরা দেখছি প্রাসাদ ভাগ-বাঁটোয়ারার মাধ্যমে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি’ তৈরির প্রহসনমূলক আয়োজনে।
একাত্তরের সমৃদ্ধ স্বপ্নে লালিত এই জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ গন্তব্যচ্যুত করার অধিকার কারও নেই। এটিই ফুটে উঠেছে অগ্নিদগ্ধ গীতা সেনের আকুতি ও গর্জন থেকে, ‘আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।’ কি শিক্ষার্থী, কি অভিভাবক, কি কর্মজীবী মানুষ, কি উদ্যোক্তা, কি নারী, কি পুরুষ—এটিই নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা ‘সাইলেন্ট মেজরিটি’র অন্তরের কথা। এরই মর্মবাণী ধরেই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে—কোনো চালাকি ব্যাখ্যার মারপ্যাঁচে নয়। চারটি দাবি ও করণীয় এখানে বিবেচ্য:
—অবিলম্বে নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল বাতিল এবং আলোচনা ও মতৈক্যের ভিত্তিতে পুনর্নির্ধারণ।
—সব ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি অবিলম্বে প্রত্যাহার ও মৌলিক অধিকার দ্বারা সংরক্ষিত সব রাজনৈতিক ও নাগরিক কর্মসূচি পালনে নিশ্চয়তা।
—সমান সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে আস্থার পরিবেশ দৃশ্যমান করা।
—রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে সাংবিধানিক সংস্কার বিষয়ে জাতীয় আলোচনার সূত্রপাত ও এ বিষয়ে রাজনৈতিক চুক্তি সম্পাদন।
দাবি ও করণীয় হয়তো স্পষ্ট করা গেল, কিন্তু এতেই কি সংকট থেকে উত্তরণ ত্বরান্বিত হবে?
১৩ ডিসেম্বর নাগরিক আলোচনায় অনেক বক্তাই সব মহলের, বিশেষ করে নাগরিক সক্রিয়তার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ওই অনুষ্ঠানে আরও একটি গভীর সত্য সবার নজরে এনেছিলেন। ক্ষমতাকে করায়ত্ত করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব সব সামাজিক ও পেশাজীবী মহলকে ‘রাজনীতিবিদ’ বনে যেতে উৎসাহিত করেছেন। তাই আমরা দেখি শিক্ষক-রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতি, উকিল-রাজনীতি, ডাক্তার-রাজনীতি, ব্যবসায়ী-রাজনীতি, আমলা-রাজনীতি—সব ধরনের পেশায়, রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতিকে বেপরোয়াভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে, যার চূড়ান্ত রূপ বর্তমানে পরিলক্ষিত।
শুধু তা-ই নয়, এসব ক্ষেত্রে যাঁরা উদ্যোগী হয়েছেন, তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার, অনিয়ম ও দুর্নীতি করার একধরনের ছাড় দেওয়া হয়েছে। শুধু অন্ধ দলীয় আনুগত্যের প্রশ্নে কোনো ছাড় বরদাশত করা হয়নি। এই বাস্তবতায় নৈতিক প্রতিরোধ ও নাগরিক সক্রিয়তা বাস্তবিকই এক কঠিন চ্যালেঞ্জে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু গিরিখাদ থেকে বের হতে হলে রাজনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিক সক্রিয়তার কোনো বিকল্প নেই। এটি সহজ নয় এবং এটা শৌখিনতার বিষয়ও নয়। নাগরিক সক্রিয়তা অনুপস্থিত তাও কিন্তু নয়। কিন্তু যা অনুপস্থিত তা হলো সক্রিয়তায় ধারা ও পরিবর্তন আনতে সক্ষম সাহস ও শক্তির বোধ। এখানেই আজকের চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে তিনটি উদ্যোগের ক্ষেত্র আপাতত প্রস্তাব করছি:
১. বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা ‘সাইলেন্ট মেজরিটি’র বক্তব্য ও অবস্থান দৃশ্যমান করার জন্য নানামুখী ও কার্যকর নাগরিক কর্মসূচি।
২. অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষা কৌশল নির্ধারণে সমমনা নাগরিক সমাজ ও ব্যবসায়ী সমাজের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় সংলাপ।
৩. রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে অধিকতর গণতান্ত্রিক করার লক্ষ্যে সাংবিধানিক সংস্কারবিষয়ক নাগরিক প্যানেল গঠন ও বিশ্লেষণ ও আলোচনার ভিত্তিতে সংস্কার প্রস্তাবনা নির্ধারণ ও এ বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় জাতীয় উদ্যোগ।
হোসেন জিল্লুর রহমান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ।