এক দোষে দুই দফা শাস্তিকে বিচার বলে না। এটা অবিচার কি না তা আদালত বলবেন, তবে আমরা বলবো চরম দুর্ভাগ্য। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে আজকাল ভিয়েতনামেও যাচ্ছেন চাকরি–খোঁজামানুষ। আজকাল দেশে ভাগ্যের চাকা সবার হাতে ঘুরতে চায় না। কারো চাকা ভনভন করে ঘোরে, কারোটা জয়নুল আবেদীনের কালজয়ী চিত্র ‘সংগ্রামে’র মতো তাঁদের ভাগ্যের চাকা গর্তকাদায় আটকে যায়। তখন তাঁরা বিদেশে কাজ খুঁজতে যান।
ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা রেঙ্গুন যেতেন, জাহাজের খালাসি হতেন, এখন প্রবাসী শ্রমিক হতে যান। এমনকি যে ভিয়েতনাম প্রায় বাংলাদেশের পিঠাপিঠি স্বাধীন হয়েছে, বাংলাদেশের চেয়েও দীর্ঘ যুদ্ধে যে দেশটির সব শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেটাও এখন বাংলাদেশিদের ভাগ্যের ঠিকানা! সেটাও আমাদের মতো ধানের দেশ, নদীর দেশ। কিন্তু তাদের শিল্প কারখানা আমাদের থেকে সবল। সেই দেশে গিয়ে প্রতারিত হয়ে ফিরেছেন শতাধিক বাংলাদেশি শ্রমিক। বাংলাদেশি প্রতারকেরা দেশের মতো বিদেশেও গরিবের রক্ত চুষতে ওস্তাদ।
এসব শ্রমিকের যা কিছু ‘দোষ’—যা আসলে অনিয়ম—তা মাফ করেছে সেখানকার সরকার। কিন্তু আইনের তীর্থ, সুশাসনের আপন দেশ বাংলাদেশ তো তাঁদের ছেড়ে দিতে পারে না। তাই প্রতারক আদম ব্যবসায়ীদের হাতে পুঁজিপাট্টা খোয়ালেও আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভাবছে, এদের আরও শিক্ষা বাকি। তাই দেশে ফেরামাত্রই এক লপ্তে ৮৩ জনকে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের পুলিশ। এঁদের ৮১ জন ভিয়েতনাম থেকে এবং ২ জন কাতারফেরত। অবশ্য মাঝখানে কিছুদিন কোয়ারেন্টিনকেন্দ্রে থাকতে হয়েছে। এখন এদের নামে মামলা হয়েছে। এদের ছেড়ে দিলে নাকি এরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, নাশকতা ইত্যাদি করে বেড়াবেন (প্রথম আলো, ২ সেপ্টেম্বর)।
এই শ্রমিকেরা দালালচক্রের হাতে প্রত্যেকে চার লাখ করে টাকা দিয়েছেন। সঙ্গে নগদ দিতে হয়েছে দুই হাজার ডলার করে। ঢাকা ও ভিয়েতনামে যাঁরা এই ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করছেন, তাঁরা মহামান্য বাংলাদেশেরই নাগরিক। ভিয়েতনামে দালালেরা তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে একটি ঘরে রাখে। এরপর বাংলাদেশে থাকা তাঁদের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। চাকরির কথা বলে টাকা নিয়ে তারা এই শ্রমিকদের আটকে রেখেছে, এক কাজের কথা বলে অন্য কাজ করিয়েছে, তাঁদের প্রাপ্য বেতন কেড়ে নিয়েছে। এত রকম দুর্ভোগে ভুগে কোনো কোনো শ্রমিকের মৃত্যুও হয়েছে।
এই অপকর্ম তারা করেছে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে, রাজধানীতে দপ্তর খুলে। তখন আমাদের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হুশ হয়নি। এখন যখন ভিয়েতনামে শাস্তিভোগ, নির্যাতন, প্রবঞ্চনায় ভুগে এই লোকেরা ফিরেছেন, তখন পুলিশ তাঁদের কারাগারে পুরেছে। ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের সংলাপ মনে পড়ে, ‘সে পুলিশ এমনই পুলিশ, বেছে বেছে আমাদের ধরে, ওদের কিচ্ছুটি বলে না।’
এই প্রবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ভিয়েতনামে বাংলাদেশি দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। প্রবাসের দৈবের বশে বিপদে পড়লে তো দূতাবাসে না গিয়ে ক্যাসিনোতে যাবে? প্রতিকার চাইতে তো তাঁরা স্বদেশি দূতাবাসেই ধরনা দেবেন, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকার বিহিত তাঁরা আর কার কাছে চাইবেন? নইলে দূতাবাসগুলি আছে কেন? বলা হচ্ছে, তাঁরা অপরাধ করেছেন। প্রবাসে কাজের জন্য ভিসা পেয়েছেন, সেই কাজ না পেয়ে হয়তো অন্য কাজ করেছেন। এই বেকায়দায় পড়ার জন্য কি এই শ্রমিকেরা দায়ী? হ্যাঁ, ভিয়েতনামের আইনে এসব অপরাধ। কিন্তু যখন ক্ষমা করে ভিয়েতনাম তাঁদের ফেরত পাঠিয়েছে, তখন আবার অসহায় মানুষগুলোকে মোকদ্দমায় ফেলা কেন? শাস্তি যা পাওয়ার তা তো সর্বস্ব খুইয়ে খালি হাতে ফেরত আসার মাধ্যমে তাঁরা পেয়েছেন। তাহলে মড়ার উপর আবার খাঁড়ার ঘা কেন?
অভিযোগ তোলার কথা ছিল প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু তারা বিষয়টি বুঝলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবুঝ—দুর্বলের ওপর বলপ্রয়োগে তাঁরা মনে হয় সিদ্ধহস্ত। এই লোকেরা অবৈধভাবে যাননি, বিধিমোতাবেকই ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট নিয়েই গিয়েছেন। কিন্তু করোনার কারণে সেসব কাজ আর পাননি। দোষটা রিক্রটিং এজেন্সির, কিন্তু শাস্তি পাচ্ছে গরিব মানুষ। এখনো এ রকম অবস্থায় বিভিন্ন দেশেই পড়ে রয়েছেন হাজারো বাংলাদেশি কর্মী। সম্প্রতি এ রকম দুর্দশার প্রতিবাদ করায় মালয়েশিয়ায় এক বাংলাদেশি কর্মী নিপীড়িত হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন।
আমরা প্রবাসী শ্রমিকের ডলার দেখিয়ে গর্ব করব, সেই ডলার ব্যয় করে বাহবা কুড়াব, কিন্তু তাঁদের মানুষ গণ্য করব না; এ কেমন বিচার! প্রবাসে যাঁদের দাসের জীবন, দেশও তাঁদের সঙ্গে তেমন আাচরণই করবে? গত ১০ বছরে ২৬ হাজার ৭৫২ কর্মীর লাশ এসেছে বিদেশ থেকে। ২০১৯ সালের প্রথম নয় মাসে এসেছে প্রায় তিন হাজার লাশ—এসবের মধ্যে মাত্র ৫ ভাগের মৃত্যুর কারণ স্বাভাবিক। গবেষণা বলছে, প্রবাসে থাকা কোটি শ্রমিক বেদম খাটুনির ফলে অকালমৃত্যুর ঝুঁকিতে। আর প্রায়ই তো সরাসরি মরার খবর আসে। এ বছরই লিবিয়াতে গুলিতে নিহত হয়েছেন ২৬ জন।
আর এখনকার অবস্থা? প্রতিদিন ফিরছেন দুই হাজার প্রবাসী কর্মী। ছুটিতে এসে এসে আটকা পড়েছেন দুই লাখ। ভিসা করেও যেতে পারেননি এক লাখ। এপ্রিল-আগস্ট পর্যন্ত ফিরেছেন এক লাখ, পাঁচ মাসে যেতে পারেননি নতুন তিন লাখ। ১ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশফেরত কর্মীর ওপর জরিপ করে আইওএম বলছে, জীবিকাসংকটে আছেন দেশে ফেরা ৭০ শতাংশ প্রবাসী কর্মী। ৫৫ শতাংশের ওপর রয়েছে ঋণের বোঝা।
বাংলাদেশের উন্নতির মূলে যে দুই ধরনের শ্রম, তার একটা খাটা হয় পোশাকশিল্পে, আরেকটা বিদেশে। সস্তায় তাঁরা শ্রম বেচেন বলে, মানুষ হিসেবেও তাঁরা সস্তা, তাঁদের জীবনটাও সস্তা, তাঁদের নাগরিক অধিকারও ফকফকা? না হলে বিদেশে প্রতারণার শিকার স্বদেশী নাগরিকদের কেউ এভাবে জেলে পোরে?
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও কবি
[email protected]