বাংলাদেশের স্বাধীনতা ৪৬ বছর পেরিয়ে ৪৭-এ পা দিয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বিজয় দিবস উদ্যাপিত হয়েছে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ যুব সমাবেশ, আলোচনা সভাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিএনপি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিজয় মিছিল বের করেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিজয় দিবস উদ্যাপন করেছে।
তবে এই আনুষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে যে বিষয়টি চিন্তা করা দরকার সেটি হলো গেল ৪৬ বছরে আমরা কতটা এগিয়েছি, কতটা পিছিয়েছি। §এ কথা ঠিক যে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন, সেই ঝুড়িটি আর নেই। বাংলাদেশের ঝুড়ির তলা এখন অনেকটা শক্ত। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনামূলক চিত্র দেখলেও এ কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.২৮ শতাংশ আর পাকিস্তানের ৫.২৮ শতাংশ। মানুষের গড় আয়ু বাংলাদেশের ৭১.৬ বছর, পাকিস্তানের ৬৭ বছর। বাংলাদেশে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৫.৯৫ কোটি, পাকিস্তানে ৫.৭৪ কোটি, যদিও পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি। বেকারত্ব বাংলাদেশে ৪.২ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫.৯ শতাংশ। সাক্ষরতা বাংলাদেশে ৭১ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৮ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি বাংলাদেশে ১.৩৭ শতাংশ, পাকিস্তানে ১.৮৬ শতাংশ। শিশুমৃত্যু বাংলাদেশে হাজারে ২৮, পাকিস্তানে ৬২। বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছে। পাকিস্তানে ১ হাজার ৬২৯ ডলার, বাংলাদেশে ১ হাজার ৬১০ ডলার। এ ক্ষেত্রেও আমরা শিগগিরই পাকিস্তানকে অতিক্রম করব। তবে অনেক আগেই করা যেত, যদি দুর্নীতির লাগামটা একটু টেনে ধরা যেত।
আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অনেক অর্জনই আমাদের আশ্বস্ত করে। সামাজিক উন্নয়নও চোখে পড়ার মতো। কিন্তু যে বিষয়ে আমরা বেশি দুর্বল, সেটি হলো রাজনীতি। গত ৪৬ বছরে রাজনীতিতে এমন সব ঘটনা ঘটেছে, যা ঘটার কথা ছিল না। গত ৪৬ বছরে কথিত সেনাবিদ্রোহ তথা ক্ষমতা দখলের নামে দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে। জেলখানায় চার জাতীয় নেতা খুন হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চার সেক্টর কমান্ডারও মারা গেছেন একে অপরের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে। কেউ গুলিতে, কেউ প্রাহসনিক বিচারে।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা—জাতির পবিত্র আমানত। সবকিছু নিয়ে বিতর্ক হলেও এই দুটিকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার কথা। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেটিও বিতর্কিত করে ফেলেছেন। ৪৬ বছরে আমরা মুক্তিযোদ্ধার একটি নির্ভুল ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য তালিকা তৈরি করতে পারলাম না। যখন যে সরকার আসে, তারা নতুন একটি তালিকা তৈরি করে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকে বাদ পড়েন, অনেকে যুক্ত হন। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে আগেও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু বড় ধরনের অনিয়ম দেখলাম, যখন মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স বাড়ানো হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানসন্ততির জন্য চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হলো।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেখানো জাতির আরদ্ধ কাজ। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের আমরা শ্রদ্ধা করব, ভালোবাসব। কিন্তু সেই সম্মান ও ভালোবাসার প্রথম ও প্রধান উপায় হলো তাঁরা যে স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, সেটি যথাযথভাবে পূরণ করা। প্রতিবছর বিজয় দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে মন্ত্রী-নেতারা জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে শহীদদের স্বপ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু তারপরই সবকিছু ভুলে যান।
স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও ভারতে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হয়। তাঁদের কে কংগ্রেস, কে সিপিআই আর কে বিজেপির সমর্থক, সরকার সেটি বিবেচনা করে না। সেভাবে কখনো তালিকাও তৈরি হয় না। তারা বিবেচনা করে সাতচল্লিশের আগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে কার কী ভূমিকা ছিল।
কিন্তু আমাদের দেশে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে বিতর্ক হয়ে আসছে শুরু থেকেই। এক দল আরেক দলের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকার করে না। তারা ভুলে যায় যে মুক্তিযুদ্ধটা হয়েছে ১৯৭১ সালে। সেই সময় যাঁরা রণাঙ্গনে ছিলেন, যাঁরা জীবন বাজি রেখে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন, তাঁরাই এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি রাখেন। এখন কে কোন দল করেন, সেটি বিবেচ্য হতে পারে না।
অথচ তা-ই হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারের আমলে ছয়-ছয়বার তালিকা তৈরি হয়েছে। সম্ভবত সামরিক শাসক এরশাদই প্রথম তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেন। পরে বিএনপি এসে আরেকটি তালিকা করে। আওয়ামী লীগ এসে আরেকটি। এখন সপ্তম তালিকা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে।
পাবনার সুজানগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক দুই কমান্ডার মো. দলিল উদ্দিন মিয়া ও আমিন উদ্দিন মোল্লা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আ ক ম মোজাম্মেল হকের কাছে একটি আবেদনপত্র দিয়ে বলেছেন, তঁাদের উপজেলায় ১০ ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ না করে ভুয়া সনদ নিয়েছেন। মন্ত্রী মহোদয় সেই দরখাস্তে পাবনা জেলা প্রশাসককে সম্বোধন করে লিখেছেন, ‘বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। দয়া করে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।’ এ রকম বহু অভিযোগ ও আবেদন জমা আছে মন্ত্রণালয়ে, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে। কিন্তু ফল পাওয়া গেছে খুব কম ক্ষেত্রেই। আবার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল কোনো সিদ্ধান্ত দিলেও মানছেন না অনেকে। একটি উপজেলায় যদি ১০ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেওয়ার অভিযোগ আসে, তাহলে সারা দেশে অভিযোগের সংখ্যাটি ভাবুন।
কয়েক দিন আগে একজন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তাও, এসেছিলেন প্রথম আলো অফিসে। তিনি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বলেন, সেখানে অন্তত ১৪ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছেন। এ বিষয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কাছে নালিশও করেছিলেন। একটি অফিসের কথাই বা বলি কেন। ২০০৯ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে সরকারি দায়িত্ব পালন করছেন, এমন কর্মকর্তার সংখ্যা ২৭১ জন। এর মধ্যে কতজন সঠিক আর কতজন ভুয়া সনদ নিয়েছেন, সেটি দেখার দায়িত্ব সরকার ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের।
বিএনপি আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি করেছিলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী। বিএনপি সরকার সেটি গ্রহণ করে। তখন আওয়ামী লীগও এই প্রস্তাব সমর্থন করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার বিষয়ে তারা একমত হতে পারেনি। বিএনপি যে তালিকা করেছিল, আওয়ামী লীগের অভিযোগ, তাতে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তালিকা বিশুদ্ধকরণের নামে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগও একটি তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। সেই তালিকার কাজ এখনো চলছে।
ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, সনদ দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারি হয়েছে। সরকার গঠিত কমিটিতেই অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার হদিস পাওয়া যায়, যার মধ্যে খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ছয়জন সচিবও ছিলেন। তবে সব বড় কেলেঙ্কারি হয়েছিল বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা নিয়ে। তাঁদের যে স্বর্ণপদক দেওয়া হয়েছিল, পরবর্তীকালে দেখা গেছে সেগুলোতে ১২ আনাই খাদ। প্রথম আলোয় এই রিপোর্ট প্রকাশিত হলে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায়নি। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বদলেছেন। আবার যাঁর আমলে মন্ত্রণালয়ে এই কেলেঙ্কারি হয়েছে, তিনিই মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স নিয়ে সরকার একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেক আলোচনার পর ঠিক হয়েছিল, ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর হতে হবে। সম্প্রতি একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেছেন, ১৩ নয়, সাড়ে ১২ করতে হবে।
এসব দেখেশুনে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার বাসিন্দা ও ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবুল হোসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, ‘মৃত্যুর পর আমাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেবেন না।’ তাঁর ক্ষোভ, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের নামে যেখানে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে তিনি এই মর্যাদা নিতে পারেন না।
আবুল হোসেন বলেছেন, ‘একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার বিবেকের তাড়না আছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বীর উপাধি পেয়ে যাচ্ছেন। এর প্রতিবাদস্বরূপ বীর উপাধি বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যত দিন বেঁচে আছি, একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই। আর দাফনের সময় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নেব না। কারণ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও তো দাফনের সময় একই মর্যাদা পাবেন।’
ইউএনও বলেছেন, ‘আমার মনে হয় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে অনিয়মের অভিযোগে তিনি কষ্ট পেয়েছেন। তিনি সেই অভিযোগ থেকে এসব চিঠি দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করা হচ্ছে।’
কিন্তু এই কষ্ট তো ব্যক্তিগত নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও বীরত্ব। যাঁদের বীরত্ব ও লড়াই আমাদের স্বাধীনতাকে সম্ভব করেছিল, তাঁদের তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা নাম লেখালে সেটি জাতির জন্য যে কত বড় লজ্জার, সে কথা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় না বুঝলেও মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হোসেন বুঝেছেন। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নকল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তির এন্তার অভিযোগ এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকারের আমলেই। প্রতিকার কী?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।