২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

তাহলে বাবরি মসজিদ কেউ ভাঙেনি?

বাবরি মসজিদ

এ ধরনের শিরোনাম বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত সংবাদ এবং মতামতে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। তবু আমি আবার এ শিরোনামই ব্যবহার করলাম। ৩০ সেপ্টেম্বর বুধবার লক্ষ্ণৌর সিবিআই বিশেষ আদালত বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলার রায় দিয়েছেন। মসজিদ ধ্বংসের অভিপ্রায়ে চক্রান্ত, পরিকল্পনা ও প্ররোচনার অভিযোগে ২৭ বছর আগে মামলা হয়েছিল বিজেপির কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ ৪৯ জনের বিরুদ্ধে। তাঁদের মধ্যে ১৭ জন আগেই মারা গেছেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বাকি ৩২ জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। খালাসপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতী ও কল্যাণ সিংয়ের মতো নেতারা।

প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদও এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল না বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। সিবিআইয়ের দেওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণ অপরাধ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট মনে করেননি আদালত। মসজিদ ধ্বংসের কারণ হিসেবে আদালত স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষকে দায়ী করেছেন। আর যাঁরা এ কাজটা করেছেন, তাঁরা সমাজবিরোধী। অভিযুক্তরা তাঁদের বরং থামানোর চেষ্টা করছিলেন, আদালতও তা–ই মনে করেন।

সমাজবিরোধীদের কাজ কী করে ‘স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষ’ হতে পারে, এ প্রশ্ন উঠতে পারে। আর হঠাৎ করে এই জনরোষ কেন সৃষ্টি হলো, তা-ও একটা গবেষণার বিষয়। মসজিদ ধ্বংসের পূর্ববর্তী দিনগুলোতে পরিকল্পিত উপায়ে ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল আরএসএস, বিজেপি এবং তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো। ১৯৯০ সালে লালকৃষ্ণ আদভানির রাম রথযাত্রা দিয়ে এর শুরু। পরবর্তী দুই বছর যত বিষাক্ত বক্তব্য আদভানি, উমা ভারতী, রিতাম্বরা গং দিয়েছেন, তা-ও সবার জানা। সর্বশেষ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে বিপুলসংখ্যক ‘করসেবক’কে জড়ো করা হয় অযোধ্যায় মসজিদ ধ্বংসের সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে। মসজিদ ধ্বংসের পর এই নেতাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ এবং মিষ্টি বিতরণের ছবি গণমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু বিজ্ঞ জজ ভাষণগুলো ‘অস্পষ্ট’ এবং অডিও ও ভিডিও টেপগুলোর ‘সত্যাসত্য তদন্ত করা সম্ভব হয়নি’ বিধায় তা বিবেচনায় নেননি।

‘বাবরি মসজিদ কেউ ভাঙেনি?’ শিরোনামে দিল্লি থেকে আশীষ গুপ্ত লিখেছেন, ‘১৯৯২–এর ডিসেম্বরে গঠিত লিবেরহান কমিশন ২০০৯ সালে তাদের রিপোর্ট পেশ করে বলেছিল, দীর্ঘ এবং বিশদ পরিকল্পনার ফল এই ধ্বংসকাজ। আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অর্থ জোগাড় করা হয়েছিল এবং কে কোন কাজ করবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। যে হাতিয়ার নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল মসজিদ ভাঙার বাহিনী, তা পরিকল্পনা ছাড়া অসম্ভব।’ বিচারপতি লিবেরহান আদালতের এই রায়কে ‘সম্পূর্ণ প্রহসন’ বলে অভিহিত করেছেন।

আমার মনে হয়, এই রায়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলায় তাঁদের শাস্তি হয় এমন সংস্কৃতি আমাদের অঞ্চলে গড়ে ওঠেনি আর ভারত তার ব্যতিক্রম নয়।

বাবরি মসজিদ-সংক্রান্ত মূল মামলার রায়টিও পর্যালোচনার দাবি রাখে। ১৫২৮ সালে নির্মাণের পর থেকে ভারত ভাগ পর্যন্ত স্থাপনাটি মসজিদ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। শুধু ১৮৮৫ সালে রঘু বীর দাস নামের এক পুরোহিত এখানে রামের জন্ম হয়েছিল বলে দাবি করে মসজিদের স্থাপনার বাইরে একটি ছাউনি নির্মাণের অনুমতি চান ফৈজাবাদ জেলা আদালতে। আদালত তা নামঞ্জুর করেন। দেশভাগের পর ১৯৪৯ সালে রাতের আঁধারে মসজিদে বালক রামের (রাম লালা) একটি মূর্তি স্থাপন করেন কেউ। পরদিন দাবি করা হয়, রাম নিজে তাঁর মূর্তি অধিষ্ঠিত করেছেন। শান্তি রক্ষার্থে মসজিদে তালা লাগায় প্রশাসন। এ নিয়ে তিনটি মামলা হয়।

—১৯৫০ সালে রামচন্দ্র দাস এবং আরও কতিপয় ব্যক্তি মূর্তিটি যথাস্থানে রক্ষা করা এবং সেখানে পূজা অনুষ্ঠানের অনুমতি চান;

—১৯৫৯ সালে নিরমোহি আখড়া নামের প্রতিষ্ঠান রামমন্দির নির্মাণের জন্য মসজিদের পুরো সম্পত্তির দখল চায়;

—১৯৬০ সালে সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ড মসজিদের সম্পত্তির দখল চেয়ে আবেদন করে।

১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো আদালতের পক্ষ থেকে পক্ষপাতিত্বের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন স্থানীয় আদালত পূজার জন্য মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। মামলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ রায় হয় ২০১০ সালে। এর মধ্যে তো উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মসজিদ ভেঙেই ফেলেছে। এলাহাবাদ হাইকোর্ট সম্পত্তিটিকে তিন ভাগ করে তা নিরমোহি আখড়া, সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ড এবং ‘রাম লালা’কে প্রদানের রায় দেন। এ রায়ে আদালত পৌরাণিক চরিত্র রামকে সম্পত্তির মালিকানা মামলার একটি পক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেন, যা সম্ভবত অভূতপূর্ব! রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয় সুপ্রিম কোর্টে। ৯ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট তার চূড়ান্ত রায় দেন। রায়ে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে রামমন্দির নির্মাণের জন্য পুরো সম্পত্তি বোর্ডকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে বেশ কিছু অসংগতি ও স্ববিরোধিতা পরিলক্ষিত হয়। এক. সাড়ে চার শ বছর ধরে এই স্থাপনা মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এটাকে কম গুরুত্ব দিয়ে, কবে কে কখন এখানে পূজা করেছিল, সেই খণ্ড খণ্ড সূত্রকে প্রবল গুরুত্ব দেওয়া হয়। দুই. ১৯৪৯ সালে মসজিদের ভেতর মূর্তি স্থাপন এবং ১৯৯২ সালে মসজিদের ধ্বংস সাধন উভয়ই ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয় রায়ে। অথচ যে উদ্দেশ্যে এই অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে, আদালত তার পক্ষেই রায় দিয়েছেন। তিন. আদালত মানুষের অনুভূতির কথা উল্লেখ করেছেন। জমির মালিকানা নির্ধারণের মামলায় অনুভূতির মতো বিমূর্ত বিষয়ের অবতারণা অভিনব সংযোজন। তা ছাড়া অনুভূতি তো দুপক্ষেই থাকতে পারে।

বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদসহ আরও অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছিল। স্বাগত জানিয়েছিলেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও। রাজীব গান্ধীর আমল থেকেই উগ্র হিন্দুত্ববাদ সামাল দিতে নরম হিন্দুত্ববাদের পথে হেঁটেছে কংগ্রেস দল। তাতে অবশ্য লাভ তেমন হয়নি, বরং সেক্যুলার ভোট পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ছোট দলের দখলে গেছে।

ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন অবশেষে সফল হতে চলেছে। বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর রামমন্দির নির্মাণকাজের উদ্বোধন হলো ভূমি পূজন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠানটি হয় ৫ আগস্ট ২০২০ তারিখে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ অন্য বিশিষ্টজনেরা।

রামমন্দিরেই কি শেষ হবে সাম্প্রদায়িক সংঘাত? রামমন্দির নিয়ে সংঘাত যখন তুঙ্গে, তখন থেকেই মথুরার কৃষ্ণ জন্মভূমি এবং আরও কিছু প্রাচীন মসজিদ দখলের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলো। অযোধ্যার সাফল্য ও অভিযুক্তদের দায়মুক্তি তাদের নতুন করে উৎসাহিত করবে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

কিছু মসজিদ ভেঙে ফেলা কিংবা তার ওপর মন্দির নির্মাণের তাৎপর্য শুধু এরূপ কার্যকলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং এ-সংক্রান্ত রায়গুলোর মধ্যে ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত নিহিত রয়েছে। ভারতবাসী গর্ব করে যে তাদের দেশ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। ভারতে নিয়মিত নির্বাচন হয় এবং সে নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয়। তবে গণতন্ত্র মানে তো শুধু নির্বাচন নয়, শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী হতে হবে। অসাম্প্রদায়িকতা তেমনই এক প্রতিষ্ঠান, আইনের শাসন এবং বিচারব্যবস্থা তেমনই এক প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় সামাজিক–রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে অসাম্প্রদায়িকতা অনেকটাই অপসারিত। বিপদাপন্ন মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল আদালত। অনেক প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয়ের মধ্যেও ভারতীয় বিচারালয় ছিল অন্যতম উজ্জ্বল প্রতিষ্ঠান। বাবরি মসজিদের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি রায়ে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার সেই ঔজ্জ্বল্য দৃশ্যমান হয়নি।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হোক, এটা আমাদের নিজেদের দেশের জন্য যেমন চাই, তেমনি চাই প্রতিবেশী ভারতের জন্যও। কারণ ভারতে যা কিছু ঘটে, আমরা চাই বা না চাই, তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে আমাদের দেশেও।

মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব