চৈনিকেরা তাদের প্রতিটি নববর্ষের জন্য একটি করে প্রাণী বেছে নেয়—একটি চীনা বছর যদি হয় ড্রাগনের নামে, আরেকটি হবে সারমেয়র নামে। প্রাণীদের তালিকায় বাঁদর আছে। ইঁদুরও আছে। তাদের বিশ্বাস, প্রাণীদের প্রতীকী মূল্য অনুযায়ী বছরটি গুণান্বিত হবে। এ বছর ঘোড়ার বছর। হয়তো এ বছর সামরিক পরাক্রম দেখাতে পারবে বর্ষপালনকারী সব দেশ। তবে কোনো দুই দেশের মধ্যে মারামারি না লেগে গেলেই হয়।
আমাদের নববর্ষের জন্য আমরা কোনো প্রাণী অথবা পাখি, এমনকি পতঙ্গ প্রতীকও বরাদ্দ রাখিনি। বাংলা নববর্ষের কেতাবি সূচনা হয়েছিল বাদশাহ আকবরের সময়। উদ্দেশ্য ছিল, খাজনা আদায়ে সুবিধা আনা। শিগগিরই দেখা গেল, শস্যচক্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন হয়ে দাঁড়িয়েছে সৌরবছরের পয়লা বৈশাখ সৌরবন্ধনীতেও। বঙ্গাব্দ প্রচলনের পেছনে বাদশাহি এলান থাকলেও নববর্ষের দিনটি ছিল বাঙালির একান্ত নিজস্ব। এর একটা আলাদা মহিমা সব সময় ছিল। তার পরও সেই মহিমার ব্যাপক প্রকাশ ঘটার জন্য; সর্বজনীনভাবে, জাঁকজমকের সঙ্গে দিনটির উদ্যাপনের জন্য অনেক দিন বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হলো।
একটি পরাধীন জাতির কোনো উদ্যাপনই সর্বৈব সুন্দর হয় না—সবচেয়ে সুখের উদ্যাপনের পেছনেও একটা বেদনা যেন জেগে থাকে, নতুবা ক্রোধ। গত শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত নববর্ষ উদ্যাপনে প্রচ্ছন্ন একটি বেদনা ছিল। ষাটের দশকে সে জায়গায় আসে ক্রোধ। স্বাধীনতার পর আসে আনন্দ। এখন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। বাংলাদেশের জন্ম না হলে নববর্ষ থাকত ম্রিয়মাণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করে না, তাদের কাছে নববর্ষ তাই একটা ভুলে-থাকলে-ভালো হয় ধরনের দিন, সুযোগ পেলে ভন্ডুল-করে-দেওয়া-যায় ধরনের উৎসব। রমনার বটমূলে এ জন্য তারা বোমা মেরেছিল। এ মহলটি বরাবরই নববর্ষের উদ্যাপন ভন্ডুল করতে চায়। ভন্ডুল করার হুমকি দেয়।
কিন্তু এই হুমকি উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ ঘর থেকে বেরোয়। উৎসব করে। দেশের জন্য কিছু একটা করার সংকল্প নেয়। এবং সারা দিন প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মেলায়। এবার যাঁরা সারা দিনমান উৎসবের রংকে উজ্জ্বল রাখবেন, তাঁরা এ দেশের জেগে থাকা তরুণ। তরুণেরাই এই উৎসবের প্রাণ। তাঁরা পথে নামলে দিনটি সুন্দর হয়, রং ছড়ায় সবখানে, গান বাজে। তাঁরা নববর্ষের প্রাণ। তাঁদের পেছনে যাঁরা উৎসবের ভিত্তিটি গড়ে দেন, তাঁরা এ দেশের কৃষক, যাঁরা মাটিতে প্রাণ ফোটান। তাঁরা সারা বছর সবুজের সাধনা করেন, সেই রং সোনালি হলে তাঁদের মুখে হাসি ফোটে। নববর্ষের আসল রং সেই সবুজ-সোনালি। প্রথম রোপণ থেকে নবান্ন পর্যন্ত রঙের এই চক্রটি পূর্ণতা পায় নববর্ষে এসে, যখন তা লাল-সাদায় এসে মেশে। এই নতুন রং নতুন করে জাগিয়েছেন তরুণেরা, তাঁদেরও আগে আমাদের তাঁতি আর বুননশিল্পীরা।
আমাদের নববর্ষের কোনো প্রাণী প্রতীক নেই, কিন্তু প্রাণ প্রতীক আছে। সেই প্রতীক আমাদের প্রাণ ফোটানোর শিল্পীরা, আমাদের কৃষকেরা; সপ্রাণ তরুণেরা এবং নকশায়, সুতার কাজে যাঁরা প্রাণ জাগান, সেই তাঁতি আর বুননশিল্পীরা। গঞ্জের ব্যবসায়ীরা, যাঁরা লাল মলাটের হালখাতায় নতুন বছরকে স্বাগত জানান। আমাদের খই-মুড়ি-বাতাসা-মণ্ডা প্রস্তুতকারীরা, মাটির পুতুল আর খেলনার নকশাকারীরা, কুমারেরা।
কে নেই এই প্রাণের উদ্যাপনে? একসময় একটু নিভৃতেই চলত এই উৎসব—নিভৃতে, অর্থাৎ শহরের মানুষদের অলক্ষ্যে, গ্রামের চিরাচরিত শান্ত পরিবেশে যদিও চোখ-কান আর রসনার জন্য নানা আয়োজন নিয়ে নিজের মতো ঢাকঢোল বাজিয়ে হাজির হতো নববর্ষ। এখন শহর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জ—সারা দেশে চলে প্রাণের জোয়ার। কিন্তু জোয়ারের মূল শক্তিটা তারুণ্য। চৈত্র শেষ হয়, আর সব তরুণের মনে উৎসবের রং জমে। প্রকৃতিতে সময়টা খুব কঠোর, দারুণ অকাব্যিক। গরমে গা পোড়ে। তালু জ্বলে, তেষ্টায় ছাতি ফাটে। কিন্তু উৎসবের জোয়ারে তাতে বিন্দুমাত্র টান পড়ে না। একদিকে কঠোর, ভীষণ ও কড়ির শাসন, অন্যদিকে আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর স্নিগ্ধতার প্লাবন। এই বৈপরীত্যের সহাবস্থান শুধু এ দেশেই সম্ভব, যেহেতু এই বৈপরীত্য ধারণ করে এ দেশের তারুণ্য।
দুই.
নববর্ষ ঘটা করে উদ্যাপন করে পাহাড়িরা, রাখাইন ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষেরা। পাহাড়ে নববর্ষকে উপলক্ষ করে চলে নানা উৎসব, জলক্রীড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেই ষাটের দশকের শেষ বছরে বান্দরবান গিয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, বৈশাখের প্রথম দিনটা পানি দিয়ে উদ্যাপন করাটা যেন প্রকৃতি চক্রকেই আবাহন জানানো। পরে দেশ স্বাধীন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলে দেখা গেল, তরুণেরা নববর্ষ উদ্যাপন শুরু করেছেন এবং পানি ছিটাচ্ছেন একে অন্যের ওপর। সূর্য সেন হলেও আমরা ঘটা করে সে উৎসবে শামিল হলাম। আমাদের এক বন্ধু ছিল, ভয়ানক আমোদপ্রিয়, তাকে সবাই চেয়ারম্যান বলে ডাকত। এক নববর্ষের দিন চেয়ারম্যান সবাইকে টেক্কা দিতে এক ট্রাক নিয়ে হাজির। সেই ট্রাকে আমরা পানিভর্তি বালতি-মগ নিয়ে উঠে সারা ক্যাম্পাসে পানি খেলেছি। এখনো সাদা-কালো কিছু ছবি আছে সেই পানি উৎসবের। রংও মাখতাম আমরা। তবে ধুয়ে পরিষ্কার করা যায়, তেমন রং। রং দিয়ে একটা শার্ট নষ্ট করার মতো বিলাসিতা তখন কারও ছিল না।
আমরা একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে গেলাম। বৈশাখের প্রথম দিনও আমাদের কক্ষপথ থেকে দূরে চলে গেল। তারপর এল দীর্ঘ একটা অনিশ্চিত সময়।
পেছন ফিরে তাকালে এখনো পরিষ্কার অনুভব করি, আমাদের সেই বার দুয়েক পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের পেছনে আনন্দের সঙ্গে আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল, একটা প্রাণের উচ্ছ্বাসে সবাইকে জড়ানো। একাত্তরের স্বজন হারানোর কষ্ট তত দিনে কিছুটা সহ্য করতে শুরু করেছে সবাই। নতুন দেশটা নিয়ে আশা বাড়ছে, হতাশাও বাড়ছে। যে নতুন যাত্রার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম; তা বিলম্বিত হচ্ছিল। তাতে অনেকে বাগড়াও দিচ্ছিল। সেই হতাশার একটা রাজনৈতিক প্রকাশ ছিল, সামাজিক একটা প্রকাশও ছিল। সামাজিক প্রকাশের একদিকে ছিল ক্রোধ, অন্যদিকে এ থেকে মুক্তির নানা উপায় খোঁজার ইচ্ছা। নববর্ষ উদ্যাপন সে রকম এক মুক্তির সন্ধান দিল। এ ছিল তরুণদের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটানোর একটা উপলক্ষ। এর কলেবর ও শক্তি যে দিনে দিনে বাড়বে, এ তো অবধারিতই ছিল।
আশির দশকে সামরিক ও স্বৈরশাসন, গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তার ওপর খড়্গ নেমে আসাকে প্রতিহত করতে তরুণেরা পথে নেমেছিলেন। তরুণেরা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হচ্ছিলেন, যদিও তাতে পদে পদে বাধা ছিল। সামাজিকভাবে সংগঠিত হওয়ার জন্যও একটা পথ তাঁরা শিগগিরই করে নিলেন। পয়লা বৈশাখে তাঁরা হাজারে হাজারে পথে নেমে এলেন। যেদিন সকালে ঢাকায় ছায়ানটের অনুষ্ঠানের পর চারুকলা থেকে বেরোল মঙ্গল শোভাযাত্রা, যোগ হলো নববর্ষের কৃত্যের তালিকায়, সেদিন বোঝা গেল, তারুণ্য কী বাণী দেশের মানুষকে জানাতে চায়। সে বাণী ছিল: জেগে ওঠো দেশের মানুষ। মানুষও জাগল।
তিন.
নববর্ষের আকর্ষণ দিন দিন বাড়ছে; বাড়ছে এর কৃত্যের তালিকাও। এই বাড়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে দৃশ্যমাধ্যম। এই মাধ্যমটি একটি আয়নার মতো। এতে নিজেকে দেখা যায়, আবার আশপাশের সবাইকে অথবা সবকিছুকে দেখা যায়। সিরাজগঞ্জের নববর্ষের অনুষ্ঠান এখন নেত্রকোনার অথবা সুধারামের মানুষ দেখে; নেত্রকোনা ও সুধারামের নববর্ষের অনুষ্ঠান দেখে সিরাজগঞ্জের মানুষ। এই দেখার মধ্য দিয়ে তারা একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। এখন দৃশ্যমাধ্যমের কল্যাণে এবং এর মধ্যস্থতায় সারা দেশে এক আশ্চর্য সমাবেশ ঘটছে পয়লা বৈশাখের দিনে। দৃশ্যমাধ্যম
এই উৎসবে জাঁকজমক এনেছে, বৈচিত্র্য এনেছে। কয়েক বছর থেকে দেখছি, তরুণেরা গিটার হাতে ড্রাম বাজিয়ে গান গাইছেন সারা দেশে এবং হাজার হাজার তরুণ অংশ নিচ্ছেন তাঁদের আনন্দচর্চায়।
এখন নববর্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘরে না থাকার দিন। বিরামহীন উদ্যাপনের দিন। আমরা বাঙালিরা উৎসবের জন্য অধীর হয়ে থাকি। তাই শোকের দিন একুশে ফেব্রুয়ারিকেও আমরা একটা উদ্যাপনের দিন করে ফেলেছি—শহীদদের আত্মদানের শক্তিকে উদ্যাপনের। তার রং দিয়েছি সাদা-কালো। বিজয় দিবসে আমরা উদ্যাপন করি লাল-সবুজকে, পয়লা ফাগুনে হলুদ-কমলাকে। একদিন রংধনুর সব রং আমরা আরও অসংখ্য উদ্যাপনের মধ্যে ছড়িয়ে দেব।
পৃথিবীর আর কোনো জাতি তার স্বাধীনতার ৪৩ বছরে এতগুলো উৎসবের নবায়ন এভাবে রঙের মধ্য দিয়ে, গানের মধ্য দিয়ে, সারা দিনের আরও নানা নৃত্যের মধ্য দিয়ে করতে পারেনি। আমরা পেরেছি। উৎসবপ্রিয় এই জাতি একদিন উৎসবের সংখ্যা, বৈচিত্র্য ও অভিঘাতের বিচারে সবাইকে হয়তো পেছনে ফেলে যাবে।
তরুণেরা যে এভাবে উৎসব আবিষ্কার বা পুনরাবিষ্কার করছেন, তার মূল কারণটি যদি কেউ শনাক্ত করতে চান, তাঁকে যেতে হবে দুটি সূত্রের কাছে—এর প্রথমটি তারুণ্যের স্বাভাবিক প্রাণশক্তি, এর উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং দ্বিতীয়টি নতুনত্বের প্রতি, প্রাণশক্তির বাধাহীন প্রকাশের প্রতি, পরিবর্তনের প্রতি, সৌন্দর্য, মানবিকতা, সাম্য এবং স্বাধীনতার প্রতি এই তারুণ্যের সহজাত সমর্থন ও নিষ্ঠা। আপাতদৃষ্টিতে তারুণ্যের উৎসব নিয়মমাফিক একটি বিষয় হলেও এর গূঢ় তলে কার্যকর এ দুই শক্তি এবং সেসব থেকে উদ্ভূত নানা কার্যকারণ ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা হাজির করে। এ জন্য এক নববর্ষে রমনা বটমূলে বোমা ফেটে প্রাণহানি হলে পরের বৈশাখে সারা প্রাঙ্গণ ছেয়ে যায় মানুষে। নিয়মমাফিক হলে ভয় থাকত, দ্বিধা থাকত, মানুষ দূরে থাকত। নিয়মমাফিক নয় বলে, প্রাণের টান থেকে এ উদ্যাপন উদ্ভূত বলে, মানুষ বাধা মানে না।
এই উদ্যাপনের শক্তিকে সম্মান জানাতে হবে শক্তিমানদের, দেশের মঞ্চে পুতুলখেলার সুতা নাড়েন যাঁরা তাঁদের, নানা মত ও উগ্রপথের যাঁরা পসরা সাজিয়ে বসেন সারা বছর তাঁদের এবং তরুণদের নিজেদের, বস্তুগত নানা কাজে, ক্ষমতার নানা অপচর্চায় যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁদের। অন্যদিকে, পয়লা বৈশাখের শক্তিকে মানুষের জন্য, পরিবর্তনের জন্য, সাম্য আর মানবিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য যাঁরা ব্যবহার করবেন, তাঁরা টিকে থাকবেন, তাঁরা প্রতিবছর তারুণ্যের উৎসবে যোগ দিতে পারবেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।