সবুজ শ্যামল বৃক্ষ জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। প্রকৃতি ও পরিবেশের রক্ষাকবচ বৃক্ষ। হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গিয়ে যে অক্সিজেন আমাদের কিনতে হয় চড়া মূল্যে, বৃক্ষ তা সরবরাহ করে বিনা মূল্যে। পূর্ণ বয়স্ক একটি বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে। বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডের বেশি ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে বৃক্ষ। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ, বায়ুদূষণ রোধসহ শত শত টন কার্বন শোষণ করে বৃক্ষ পরিবেশ অক্ষত রাখতে অপরিমেয় অবদান রাখছে। এসবই বৃক্ষের পরিবেশগত মূল্য।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ অনুসারে যেকোনো প্লটে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবনের চারপাশে খোলা জায়গা ছেড়ে দিয়ে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) বজায় রাখা বাধ্যতামূলক। বহুতল ভবন নির্মাণে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ১৯৯৩ অনুসরণ করাও বাধ্যতামূলক। ভবনের সামনের/চারপাশের খোলা জায়গা কোনো অবস্থাতেই পাকা না করে সেখানে উপযুক্ত প্রজাতির ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানোর নির্দেশনাও আছে। ২০১১-১২ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট অভিযানে বহু আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবন নির্মাতাদের উচ্চ অঙ্কের জরিমানা দণ্ড দিয়ে ভবনের সবুজায়নে ভবননির্মাতাদের বাধ্য করেছিলাম। অ্যান্টিবায়োটিকের মতো সুফল বয়ে আনা এই অভিযান পরিচালনার পথে প্রচণ্ড প্রতিকূলতাকে রুখেছিলাম প্রশাসনিক দৃঢ়তা নিয়ে। মহৎ এই অভিযান অসমাপ্ত রেখে এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পরিবেশ ধ্বংসের জন্য শিল্প-কারখানার মালিকদের সমান্তরালে ভবনের মালিকেরাও দায়ী। ঢাকার সিংহভাগ ভবন নির্মাণে অধিকাংশ প্লটে একটি কলাগাছ রোপণের স্থানও রাখেন না স্বপ্ন সাধের ভবননির্মাতারা। অথচ গৃহসজ্জার উপকরণ ক্রয়ে কতিপয় ভবনমালিকের অর্থ অপচয়ের যে মহা-আয়োজন, ভবনে গাছ লাগানোর বিষয়টি তাদের যেন একেবারেই অপ্রয়োজন। নগর প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজউক, পরিবেশ অধিদপ্তর, গণপূর্ত বিভাগ এবং সিটি করপোরেশন পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে যতটা শক্তিসামর্থ্যহীন, তার চেয়েও বেশি উদাসীন ও গতিহীন।
পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে ‘সবুজ ঢাকা’ গড়তে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে ঢাকা হবে বসবাসের অনুপযোগী। ঢাকার পরিবেশ থেকে একে একে গাছপালার বিদায়ে বায়ুদূষণ নগরজীবনের অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত সূক্ষ্ম বস্তুকণা, ধুলাবালি ও কার্বন পরিবেশকে দূষিত করায় স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণ মস্তিষ্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনকি পড়াশোনায় মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি কমায়। নাগরিকদের অবসাদগ্রস্ততা ও অস্থিরতা এবং বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের যে উগ্রতা ও হিংস্রতা, তার অনেক কারণের মধ্যে রয়েছে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা। আবার প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে গভীর সংযোগ রয়েছে সামাজিক শান্তির। ঢাকার নাগরিকদের যে পরিমাণ সবুজ পরিবেশ প্রয়োজন, বলধা গার্ডেন, রমনা পার্ক কিংবা চন্দ্রিমা উদ্যানের সীমিত বৃক্ষরাজি দিয়ে তা কি মেটানো সম্ভব? সবুজের এই অভাব প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিশাল এক অভিঘাত। ফলে জলবায়ুতে অনুভূত হচ্ছে তার বিরূপ প্রভাব। ভবননির্মাতাদের আহ্বান জানাই, ভবনের জন্য নির্ধারিত ভূমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করুন এবং পরিবেশ আইনের নির্দেশনা মেনে প্রকৃতিকে তার অন্তর্ভুক্ত করুন। স্থপতিদের কাছে নিবেদন, গাছপালা দিয়ে ঢাকা শহরকে ঢেকে ঢাকার মানচিত্র স্নিগ্ধ সবুজে পরিণত করুন।
নগর উন্নয়নে প্রযুক্তিনির্ভরতার সঙ্গে প্রয়োজন প্রকৃতিনির্ভরতা এবং পরিবেশবান্ধবতা। প্রকৃতিকে বর্জন করে আবাসনবিপ্লবের নামে নগরায়ণ টেকসই হবে না। পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকার অনেক এলাকায় গৃহস্থালি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যে সফলতা এনেছে, তা অনুসরণ করে রাজউক ঢাকার ভবনগুলোকে ‘সবুজ ভুবনে’ পরিণত করার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন রাজউকের কড়া অনুশাসন এবং প্রকৌশলী-স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদদের পরিবেশ আইনের কঠোর বাস্তবায়ন।
আবাসন প্রকল্পগুলোতে হাসপাতাল, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শপিং মল এবং কমিউনিটি সেন্টারের কথা বলা হলেও গাছপালার কথা বলা হচ্ছে না। নির্মাণাধীন ভবনের আশপাশের খোলা জায়গা গাছপালায় আচ্ছাদিত না করলে সে ভবনকে রাজউকের ছাড়পত্র না দেওয়ার শর্ত বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি ভবন নির্মাণের অনুকূলে ‘গ্রিন সার্টিফিকেট’ অর্থাৎ ভবনটি গাছপালাযুক্ত পরিবেশবান্ধব কি না, তা আইনে অপরিহার্য করতে হবে। এ আইন না মানলে ‘গ্রিন ট্যাক্স’ কার্যকর করতে হবে।
নির্মাণ ব্যয়ের একটি অংশ পরিবেশ রক্ষার বাজেটে অন্তর্ভুক্ত এবং কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। ভবনের আশপাশে খোলা জায়গা না থাকলে ভবনের ছাদেও বাগান দিয়ে আচ্ছাদিত করে পরিবেশ রক্ষা সম্ভব। এতে ভবনগুলো প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে মুক্ত ও শীতল থাকবে এবং ভবনের আশপাশে কার্বন শোষিত হয়ে নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত করবে। গাছপালাবেষ্টিত ভবন শীতল থাকলে এসির ব্যবহার কমে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সহায়ক হবে। পরিবেশের প্রতি অবজ্ঞায় রাজধানী ঢাকা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে বৃক্ষহীন ভবনের জঙ্গলে। ঢাকা ধ্বংসের চূড়ান্ত পরিণতি ঠেকাতে এখনই প্রয়োজন পরিবেশ সচেতনতা, আইন মেনে চলা এবং নগর পরিকল্পনায় দূরদর্শিতা।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: সাবেক পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) পরিবেশ অধিদপ্তর, বর্তমানে এমডি, মিল্ক ভিটা।
[email protected]