জলবায়ু সহনশীলতায় গ্রামীণ নারীর ভূমিকা

>

২ নভেম্বর ২০১৯ প্রথম আলোর আয়োজনে এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘জলবায়ু সহনশীলতায় গ্রামীণ নারীর ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হলো।

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

যেকোনো দুর্যোগের আগে ও পরে পরিবারের নারীর ভূমিকাই থাকে মুখ্য। শিশুদের দেখাশোনা, খাবার সংরক্ষণ, জ্বালানি সংগ্রহ প্রভৃতি বিষয়ে নারীই ভূমিকা রাখেন।

সমাজে নারীর এসব কাজের মূল্য অনেক সময়ই দেওয়া হয় না। জলবায়ু সহনশীলতায় নারীর ভূমিকা ও করণীয় সম্পর্কে আজকের আলোচনা। এখন আলোচনার সূত্রপাত করবেন আইনুন নিশাত।

আইনুন নিশাত
আইনুন নিশাত

আইনুন নিশাত

জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য হলো, এর আচরণ নির্দিষ্ট নয়। অর্থাৎ যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে। এ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম বন্যা হতে পারত। তবে তা মোকাবিলায় বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল।

জাতিসংঘের বৈশ্বিক উষ্ণতাবিষয়ক আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) তথ্য অনুসারে সমুদ্রের পানি আগামী ১০০ বছরে ৮৮ সেন্টিমিটার বাড়বে বলা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি তারা একে পুনর্মূল্যায়ন করে ৮৪ সেন্টিমিটার বাড়বে বলে জানিয়েছে। 

আশার কথা হলো, এ পরিমাণ বাড়লেও আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, উপকূলজুড়ে বাংলাদেশের ভালো প্রস্তুতি আছে। আমরা ডুবে যাব না। কারণ, আমাদের ১৫ ফুট উঁচু বাঁধ আছে।

তবে আমাদের ভাবতে হবে লবণাক্ততা ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা নিয়ে। এ দুটোর পরিমাণ বেড়ে যাওয়াটা বিপদের কারণ হতে পারে। 

যশোর অঞ্চলে এ বছর বৃষ্টি হয়নি। পানির অভাবে সেখানে চাষিরা পাট পচাতে পারেননি। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ঠিকই বৃষ্টি হয়েছে। এটাই জলবায়ু পরিবর্তনের অনিশ্চিত আচরণ। জলবায়ু পরিবর্তনের আরও একটি অনিশ্চিত বৈশিষ্ট্য হলো স্বল্প সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়া। 

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রথমেই উপকূল অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, এ অঞ্চলে সবচেয়ে গরিব মানুষেরও বিশুদ্ধ খাবার পানি কিনে পান করতে হয়। দুর্যোগকালীন এ অঞ্চলে নারীদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয় বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি সংগ্রহ করা।

জলবায়ু পরিবর্তন এখনো  প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এটি কেবল শুরু হয়েছে। একে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের প্রথমেই নির্দিষ্ট করণীয় সম্পর্কে জানতে হবে। আমাদের কী করতে হবে, সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার।

বনশ্রী মিত্র নিয়োগী
বনশ্রী মিত্র নিয়োগী

বনশ্রী মিত্র নিয়োগী

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নারীসহ অন্য ভুক্তভোগীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার কাজ করে। আমরা সাধারণত সরাসরি কোনো সেবা দিই না। আমরা মূলত তাদের সক্ষম করে তোলার চেষ্টা করি। সরাসরি সেবা না দিয়ে এ কাজ করা খুব কঠিন। তারা কীভাবে নিজের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হবে, এসব বিষয় নিয়ে কাজ করি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের বাদ দিয়ে কিছুই করা যাবে না। নারীরা পরিবেশের মৌলিক সবকিছুর সঙ্গেই নিয়োজিত থাকেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, অধিকারসহ প্রভৃতি জায়গা থেকে তাঁরাই বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়। তারপরও এর প্রভাব শিশুদেরও ভোগ করতে হয়। তারা তাদের শৈশব হারায়। অনেক সময় মা–বাবাকেও হারাতে হয় তাদের।

দুর্যোগকালীন নারীর ভূমিকাই থাকে মুখ্য। তিনিই তাঁর সন্তানদের মুখে যেকোনো উপায়ে খাদ্য তুলে দেন। এ ছাড়া গৃহস্থালির সম্পদ রক্ষার বিষয়টিও নারীর দায়িত্বে থাকে। তাই নারীকে এসব বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। 

দুর্যোগকালীন সুপেয় পানি জোগাড় নারীকেই করতে হয়। দেখা যায়, পুরুষেরা বাড়ির বাইরে যান কাজের সন্ধানে। তাই নারীকেই পানি জোগাড় করতে হয়। আমরা দেখতে পাই, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নারীকেই বেশি বাধাগ্রস্ত করে। 

আমাদের দেশে নারীরা এমনিতেই অনেক ধরনের বঞ্চনা ও শোষণের শিকার হন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সে ক্ষেত্রে তাঁদের সামনে বাড়তি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তাই নারীকে অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ করতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কারণ, তাঁরা সচেতন হলে পরিবারের অন্যরা রক্ষা পাবে।

মাহবুবা নাসরীন
মাহবুবা নাসরীন

মাহবুবা নাসরীন

আমার পিএইচডি গবেষণায় দেখিয়েছি, দুর্যোগের সময় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যে ঝুঁকি, নারীরা তা সফলভাবে মোকাবিলা করছেন। তঁারা পরিবারের খাদ্যের জোগান দিচ্ছেন। যঁারা অসুস্থ, তাদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। তঁারা তঁাদের খাদ্য ও গবাদিপশু রক্ষা করছেন। 

এ সবকিছু এটা নির্দেশ করে না যে পুরুষ সদস্যরা আসলে কিছুই করছেন না, তাঁরা কাজের সন্ধানে বাইরে চলে যাচ্ছেন। সব সময় গৃহস্থালির কাজগুলো নারীই নিরন্তরভাবে করে যাচ্ছেন। 

দুর্যোগ সহনশীলতায় নারীকে নাজুক হিসেবে না দেখে তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতাকে দেখতে হবে। তঁাদের এ বিষয়টিতেই আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।

আমাদের একটি কঠোর শ্রম বিভাজন রয়েছে। অর্থাৎ, পানি আনা নারীর কাজ, পরিবারের খাদ্য জোগান দেওয়া নারীর কাজ ইত্যাদি। এগুলোকে আমরা ফলপ্রসূ কাজ বলি না। 

ন্যাশনাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম বাংলাদেশে শুরু হয়েছে সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায়। সেখানে যে বিষয়গুলো উপস্থাপনায় এসেছে, সেটি নিয়ে মাঠপর্যায়ে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি গবেষণার দিক দিয়েও আমরা সমৃদ্ধ। এগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজে লাগাতে পারি। 

ফিলিপ গায়েন
ফিলিপ গায়েন

ফিলিপ গায়েন

আমরা দু-তিন বছর ধরে মধুপুরে ৪৪টি গ্রামের সব পরিবারের ওপর জরিপ করেছি। এখানে মোগল আমলে গারো ও কোচরা ছিল। সেখানে এখন জনসংখ্যার পরিবর্তন হয়েছে। এখন এখানে ৬৫ শতাংশ বাঙালি ও ৩৫ শতাংশ হচ্ছে গারো। 

বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বত্রই এ পরিবর্তনগুলো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও এটা হয়েছে। আমাদের জরিপ অনুসারে, মধুপুরে যত কর্মক্ষম মানুষ আছে, তার ৮ শতাংশ গারো নারী ঢাকায় এসে বিউটি পারলারে কাজ করছেন। পারলারে কাজ করেন—এমন ৯৫ শতাংশ নারী গারো। গারো নারীরা পৃথিবীতে সহনশীলতার দিক থেকে একেবারেই আলাদা। 

কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মধুপুর তো প্রায়ই ধ্বংস হয়ে গেছে। মধুপুরে একসময় ৪৫ হাজার একরের জঙ্গল ছিল। এখন বন বিভাগের মতে, সাত–আট হাজার একর জমিতে গাছ আছে। অভিবাসন এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

জলবায়ু সহনশীলতায় আমাদের গ্রামীণ নারীরা যে ভূমিকা পালন করেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে ঝঁুকি নিয়ে কাজ করে যান।

গ্রামাঞ্চল থেকে নারী-পুরুষের অভিবাসন হচ্ছে। এখানে বিশেষ করে আদিবাসী নারী বিষয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনসহ আমরা যারা কাজ করি।

উপকূল অঞ্চলেও আমরা একসময় একটা জরিপ করেছিলাম। সে জরিপ অনুসারে, এক লাখ মানুষ চিংড়ি মাছের পোনা ধরে, যেটা আইনত নিষিদ্ধ। তবে এ মুহূর্তে কত মানুষ পোনা ধরে বলতে পারব না। তখন আমরা উপকূল অঞ্চলে অনেক ঘুরেছিলাম এবং ১ হাজার ৫০০ মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম একটা প্রশ্নপত্র ব্যবহার করে।

তারা সাধারণত দুবার চিংড়ির পোনা ধরতে নামে। প্রথমবার ভোররাতে ভাটার সময় এবং দ্বিতীয়বার দিনের বেলায়। সব মিলিয়ে তারা ১০ ঘণ্টা পানির মধ্যে থাকে। 

এদের অধিকাংশই হলো নারী ও িশশু। এতে তাদের স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হয়।

শাহীন আনাম
শাহীন আনাম

শাহীন আনাম

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগে নারীরা বড় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু আমরা বিষয়টি সম্পর্কে কতটুকু সচেতন? আমরা নারীকে শুধু গৃহস্থালির কাজ করতেই দেখি।

কিন্তু দুর্যোগকালীন নারীরা যে ভূমিকা রাখেন, তা অনেক বেশি কার্যকর। যেমন নারীরা যে মুঠো চাল সংগ্রহ করে রাখেন, দুর্যোগের সময় এটি অনেক বেশি কাজে লাগে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বিশেষায়িত না হলেও গ্রামীণ নারীদের নিয়ে আমরা অনেক দিন ধরে কাজ করছি। আমাদের একটি প্রচারাভিযান আছে ‘মর্যাদায় গড়ি সমতা’। এই অভিযানের মাধ্যমে আমরা নারীর সব অস্বীকৃত কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া এবং তঁাদের মর্যাদা দেওয়ার কথা বলি। কারণ, এসব কাজের স্বীকৃতি     না দিলে আমরা তঁাদের কাজের ব্যাপকতা বুঝতে পারব না।

নারীর ভূমিকা চিন্তা করেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতি গ্রহণ করা উচিত। রাষ্ট্র প্রতিবছরই ‘জেন্ডার রেসপনসিভ বাজেট’ প্রণয়ন করে। সেই বাজেটের মধ্যে এ বিষয়ের কতটুকুই–বা প্রতিফলন থাকে? 

একাডেমিশিয়ানরা কোন বিষয়ে তথ্য দিতে পারেন, সে ব্যাপারে এনজিওগুলো একটি মডেল দিতে পারে। কিন্তু শুধু রাষ্ট্রই এটিকে বাস্তবায়ন করে সামনের দিকে নিয়ে নিতে পারে। 

নারীর ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের সঙ্গে  কাজ করলে আমরা আসন্ন দুর্যোগে ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারব।

জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নারীরা একটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারেন। এই বিশ্বাস যেন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় থাকে, সে জন্য আমরা কাজ করছি। 

সৈয়দ মতিউল আহসান
সৈয়দ মতিউল আহসান

সৈয়দ মতিউল আহসান

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রামীণ মেয়েশিশুরা কী ধরনের সমস্যায় পড়ে ও কীভাবে তা থেকে উত্তরণে ভূমিকা রাখে, আমি সে সম্পর্কে বলব। উপকূলীয় কিছু অঞ্চল, সিরাজগঞ্জ বা কুড়িগ্রামে আমরা কিশোরীদের নিয়ে একটি কাজ করেছি। 

আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, পরিবেশের তারতম্যের কারণে কিশোরীদের মধ্যে একধরনের দুশ্চিন্তা কাজ করে। যেমন অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, অতিরিক্ত গরম, অনেক দিন ধরে একটানা গরম পড়া কিংবা গরমের সঙ্গে ঠান্ডা। এসবের ফলে তঁাদের স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা হয়।

মেয়েদের পিরিয়ডকালীন জলবায়ু পরিবর্তন তাঁদের মধ্যে একধরনের চাপ সৃষ্টি করে। এটি তঁার মনঃসংযোগ ও পড়ালেখার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটায়। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপমতে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কাজে আমাদের দেশে এ শতাব্দী শেষে ৭০ লাখ শিশু পুষ্টিহীনতার অপঘাতে মারা যেতে পারে।

ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্েটর (আইআইডি) সাম্প্রতিক একটি জরিপ অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় এবং পরিবেশ সংরক্ষণে নারীরা পুরুষের তুলনায় তিন গুণ বেশি কাজ করেন। কিন্তু নারীর এ কাজের তেমন কোনো মূল্যায়ন হয় না। 

আজ যে পরিবেশ নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা, তা আমরা পেয়েছি গ্রেটা থুনবার্গ নামের একজন কিশোরীর কাছ থেকে। গ্রেটা ১৫ বছর বয়সে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুইডেন সংসদের বাইরে প্রতিবাদ করে। 

গ্রেটার মতো অনেক স্বর্ণকিশোরী বাংলাদেশেও আছে। আমাদের কাজ হবে তাদের উৎসাহিত করা ও  তাদের শোনা। 

কারণ, আজ যারা শিশু–কিশোর, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা তারাই মোকাবিলা করবে। তাই তাদের সেভাবে গড়ে তোলা উচিত। পাশাপাশি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের লোকজন, একাডেমিশিয়ান, বিজনেস কমিউনিটিসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।  

শরমিন্দ নীলোর্মি
শরমিন্দ নীলোর্মি

শরমিন্দ নীলোর্মি

শ্রমশক্তিতে জড়িত নারীদের ৬৬ শতাংশ গ্রামীণ নারী। কৃষিতেও তাঁদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ২০১৭ সালের কৃষি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ১৫ বছরে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০৮ শতাংশ। অন্যদিকে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে ২ শতাংশ। 

পুরুষেরা অর্থনীতির অন্যান্য আকর্ষণীয় খাতে যুক্ত হওয়ায় কৃষিতে নারীর সংখ্যা বেড়েছে। গত ১৫ বছরে আমাদের কোনো খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়নি। খাদ্য উৎপাদনের গ্রাফ উচ্চমুখীই রয়েছে। অর্থাৎ, নারীরা পুরুষের জায়গায় খুব দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করছেন। এই তথ্য বিবেচনা করে জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়নে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে মোট ঋণের মাত্র ৮ শতাংশ নারীদের কাছে পৌঁছেছে। এই ৮ শতাংশের মধ্যে আবার এমনও আছে যে স্বামী ও স্ত্রী যৌথভাবে এ ঋণ নিয়েছেন। 

কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের ব্যাপকতা থাকলেও এ সূচকগুলো তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই এ ৮ শতাংশকে আগামী দুই বছরের মধ্যে দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য কৃষি সম্প্রসারণ সেবা ও  ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কীভাবে সচেতন করা যায়, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের ভাবা উচিত।

মো. আহসানুল ওয়াহেদ
মো. আহসানুল ওয়াহেদ

মো. আহসানুল ওয়াহেদ

কিছুদিন আগে আমি একশনএইডের একটি প্রকাশনায় দেখেছি, বাংলাদেশের কৃষিতে শ্রমশক্তির ৬৯ শতাংশই নারী। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, নারীরা অভিযোজন বা সহনশীলতার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা দেখি আমাদের সমাজে একজন নারীর সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকার, তথ্যের অধিকার ও অর্থনৈতিক অধিকার অনেক সীমিত। আর গ্রামীণ নারীদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি সীমিত। এ বিষয়গুলো নারীর ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

কিছুদিন আগে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে একজন কৃষি কর্মকর্তার কাছে জেনেছি, সরকারের নির্দেশ আছে যেকোনো প্রকল্পে ৩০ শতাংশ নারীকে যুক্ত করতে হবে। 

আমার মনে হয়, বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবা উচিত। এসব প্রকল্পে আরও বেশি নারীকে যুক্ত করা উচিত। এ বিষয়ে সরকার আরও ভেবে দেখতে পারে।

সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও মূলত প্রকল্পের কাজগুলো নিয়ে থাকে। এখানে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের পাশাপাশি তঁার কার্যকর অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের অনেক নারী কৃষক আছেন। কিন্তু যখন সরকারি কার্ড দেওয়া হয়, তখন আমরা দেখতে পাই নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। খাসজমিতে নারীর কোনো অধিকার নেই বললেই চলে। পুরুষের সম্পত্তির অধিকার আছে বলেই পুরুষ কৃষক কার্ড বেশি পান। নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে খাসজমিতে তাঁদের অধিকার পাওয়ার বিষয়ে জোর দিতে হবে।

ফারহানা হাফিজ
ফারহানা হাফিজ

ফারহানা হাফিজ

দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনে প্রতিবছর সৃষ্ট বন্যা, খরা ও সাইক্লোন মোকাবিলায় নারীরা দীর্ঘদিন থেকেই ভূমিকা রেখে আসছেন। পরিবেশগত ঝুঁকি ও নারীর ঝুঁকি সমান্তরালে চলে। 

নারীর ঝুঁকির পাশাপাশি নারীকে পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলায় যত বেশি সংযুক্ত করা যাবে, আমরা তত বেশি লাভবান হব। কারণ, নারীরা ব্যক্তিগত ঝুঁকি এবং নাজুকতার মধ্যেও দুর্যোগকালীন তাঁর দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করে যান। 

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মূল প্রভাব পড়ে জীবন–জীবিকায় এবং আমাদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর। 

আমাদের গ্রামীণ সমাজ কৃষিভিত্তিক সমাজ। এতে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও উপার্জনের নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়ে।

এ দুটির নেতিবাচক প্রভাবে নারীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। সে সময় তাঁর চাপ অনেক বেশি বেড়ে যায়। যেমন জ্বালানি সংগ্রহ, পানি সংগ্রহ ও খাবার সংগ্রহে তাঁকে অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়। 

উপকূলীয় অঞ্চলে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এগুলো পরিচালিত হয়। এতে নারীরা যে ধরনের জীবিকা বেছে নেন, তার সঙ্গে সরাসরি বাজারের সম্পর্ক নেই। 

এসব অঞ্চলে বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। তাই, তাঁর আয়ের নিরাপত্তা থাকে না। ফলে তিনি তাঁর পরিবারে কীভাবে ভূমিকা রাখবেন। তাই এসব প্রকল্পে নারীর জীবিকা নির্বাচনে গতানুগতিক পেশার বাইরে সরকারকে চিন্তা করতে হবে। এমন পেশায় নারীকে নিযুক্ত করতে হবে, যেন তাঁর আয়ের নিরাপত্তা থাকে।

সেলিনা শেলী
সেলিনা শেলী

সেলিনা শেলী

আমরা বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থা সরকারের সঙ্গে একত্র হয়ে ‘লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ’ নামক একটি প্রজেক্টে কাজ করছি। 

আমরা সাধারণত দেখি অনুদানের টাকা একেবারে প্রান্তীয় পর্যায়ে অনেক সময় পৌঁছায় না। আমাদের এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা অনুদানগুলো সরাসরি তাদের হাতে পৌঁছে দিই। 

এই অর্থ আমরা ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে দিই। আমরা কাজটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দিতে পারতাম। আমরা তা না করে ব্যাংকের মাধ্যমে দিচ্ছি। কারণ, ভবিষ্যতে যদি তাঁর সরকার থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ আসে, তখন যেন এর মাধ্যমে সহজেই তিনি ঋণ পেতে পারেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থ যেখানে যাওয়া উচিত সেখানেই যাক। কিন্তু আমরা প্রতিটি স্তরে অপব্যবহার, সিস্টেম লস দেখতে পাই। আমাদের আসলে দেখতে হবে যে তাদের আসলেই কী দরকার ও কী করা যেতে পারে। 

একজন গ্রামীণ নারী টাকা পেলেও খুব বেশি দূর এগোতে পারেন না। এটা দিয়ে তিনি হয়তো তাঁর অবস্থার সাময়িক কিছু উন্নতি করতে পারলেও দীর্ঘমেয়াদি কিছু সম্ভব হয় না।

দেশের প্রতিটি গ্রামের ধরন-প্রকৃতি আলাদা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু সহনশীলতা বাড়াতে হলে কোথায় কোন সম্পদ আছে, নারীর জন্য কীভাবে এর ব্যবহার করা যায়, তা দেখতে হবে। 

মাহবুবুর রহমান
মাহবুবুর রহমান

মাহবুবুর রহমান

জলবায়ু সহনশীলতায় গ্রামীণ নারীর ভূমিকার কিছু চমৎকার বিষয় এসেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, এ বিষয়গুলোতে আরও গবেষণা করা উচিত।
আমাদের খুব ভালোভাবে বিষয়গুলো নির্বাচন করতে হবে। 

যে কাজটা করা আমাদের বেশি দরকার, সে কাজটা আগে করতে হবে। সব সংস্থা, যারা এ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত, সবার এই ধরনের মানসিকতা নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।

আমরা ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যথেষ্ট ঝুঁকিতে আছি। এ ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় উন্নয়ন সহযোগীদের ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন সহযোগীদের কাজে এখন অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। 

এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ঢাকায় সুইডেন দূতাবাস ও সুইডেন সরকারের যে কার্যক্রম, তা উল্লেখ করার মতো। 

তৃতীয় পর্যায়ের দেশগুলোতে উন্নয়নের জন্য অনুদানের পাশাপাশি সুইডেন সরকারের কাজের দায়ভারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায়।

এখন আমাদের করণীয় হলো, গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জলবায়ুর পরিবর্তনবিষয়ক সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেওয়া। আর এসব কর্মসূচিতে সরকারের উচিত উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে একত্র হয়ে কাজ করা। 

এ কে এম রফিক আহাম্মদ
এ কে এম রফিক আহাম্মদ

এ কে এম রফিক আহাম্মদ

আমার বাড়ি সন্দ্বীপে। সত্তরের ঘূর্ণিঝড় আমি দেখেছি। তখন আমি শিশু। আমি দেখেছি, কীভাবে বস্তায় ভরে আমাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আগে আমার মা আমাদের টিউবওয়েলটিকে বস্তা দিয়ে বাঁধেন। তারপর তিনি ঘরের টিনের ওপর কিছু খাদ্য সংরক্ষণ করেন। কিছু খাদ্য মাটির নিচে চাপা দেন। এটা খুব স্বাভাবিক চিত্র। সব মিলিয়ে দুর্যোগকালীন নারীর ভূমিকা বোঝানোর জন্যই আমি এ কথা বললাম। 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মধ্যে শিক্ষাও একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। আমরা দেখি, স্কুলগুলো একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এগুলো তখন সাইক্লোন শেল্টাররূপে ব্যবহৃত হয়। শিশুরা তাদের মৌলিক অধিকার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। 

ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে বসবাসকারী মানুষেরা সঠিক সময়ে সেখানে যায় না। আমাদের মধ্যে এই সচেতনতা সেভাবে আসেনি। সবাই এড়িয়ে চলে বিষয়টি। এখন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে কীভাবে আরও ব্যবহারবান্ধব করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। 

একটি জেন্ডার পলিসি ইতিমধ্যেই হয়েছে। সম্প্রতি ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসির (নেপ) মিটিংয়ে আমি বলেছি, যেন জেন্ডার পলিসির বিষয়টিতে দৃষ্টিপাত করা হয়। 

এ বিষয়ে ইউএন উইমেনের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। আমি বলেছি, তাদের সহযোগিতাও আমাদের দরকার। 

আমরা যদি সরকারের কার্যক্রমের দিকে তাকাই, দেখবেন, যে ২৫টি মন্ত্রণালয় বিভিন্নভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কাজ করে, তারা জাতীয় বাজেটের প্রায় ৫৮ শতাংশ পায়। আর এর মধ্যে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিষয়ে যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে আমরা অনেক ধরনের ঘটনা দেখি। যেমন বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ইত্যাদি। 

আমি মনে করি, এগুলো মোকাবিলায় সুপেয় পানি নিশ্চিত করার পরেই জ্বালানির দিকটিতে দৃষ্টিপাত করা উচিত। দুর্যোগের সময় বেশি সংকটে পড়তে হয় নিরাপদ পানির। কলেরা, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন প্রকার অসুখ থেকে নিরাপদ থাকার উপায় হলো বিশুদ্ধ পানি। খাবার তৈরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্বালানির প্রয়োজন পড়ে। আর তা তখন দুষ্প্রাপ্য থাকে। তা ছাড়া এ সবকিছুই করতে হয় নারীকে।

ফিরোজ চৌধুরী

আজকের গোলটেবিল বৈঠকে জলবায়ু সহনশীলতায় নারীর ভূমিকা, তার গুরুত্ব ও করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উঠে এসেছে। 

সমন্বিতভাবে কাজ করলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সম্মানিত অতিথিদের প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।