সিলেটে পরপর দুই দিনে ৮ থেকে ১০ বার ভূমিকম্প অনুভূত হলো, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ (এইচবিআরসি) বিষয়টি অতি গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করছে এবং কিছু বিষয় সবার সঙ্গে শেয়ার করার প্রয়োজন মনে করছে। আমরা গণমাধ্যমে দেওয়া বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ থেকে দুটি বিষয় জানতে পারি। প্রথমত, ছোট ছোট ভূমিকম্প কোনো বড় ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা হতে পারে এবং দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিনের সঞ্চিত পীড়নশক্তির কিছুটা অবমুক্ত হয়ে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য ভূমিকম্পের মাত্রা ও তীব্রতা কমিয়ে দিতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে এইচবিআরসির বিশ্লেষণ নিম্নরূপ:
সাধারণত কোনো বড় বা মাঝারি ভূমিকম্পের আগে ও পরে কিছু ছোট ভূমিকম্প হতে দেখা যায়, যাকে আমরা প্রি-শক ও আফটার-শক বলে থাকি। এই প্রি ও আফটার-শক মূল ভূমিকম্পের কত আগে বা কত পরে হবে, বিষয়টা নিশ্চিত বলা যায় না। সেই বিবেচনায় আমরা এই ভূমিকম্পগুলোকে একটা মাঝারি বা বড় ভূমিকম্পের পূর্বসতর্কতা হিসেবে বিবেচনায় নিতে পারি।
দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিনের সঞ্চিত পীড়নশক্তির কিছুটা অবমুক্ত হয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ভূমিকম্পের মাত্রা কমিয়ে দেওয়ার ধারণাকে বেঠিক বলেও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের শক্তি কমিয়ে আমাদের কতটুকু নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একটু বিস্তারিত বললে বলতে হয়, রিখটার স্কেলের মাত্রাসংখ্যা, কম্পন ও শক্তি নিঃসরণের ধারণা থেকে আমরা যা পাই তা হলো, প্রতি ১ মাত্রা বৃদ্ধির জন্য মাটির কম্পন ১০ গুণ বৃদ্ধি পেলেও পীড়নশক্তি নিঃসরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ৩২ গুণ এবং প্রতি ২ মাত্রা বৃদ্ধির জন্য শক্তি বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০০০ গুণ।
অর্থাৎ একটা ৪ মাত্রার ভূমিকম্পে যে শক্তি নির্গত হয়, তার চেয়ে ১০০০ গুণ বেশি নির্গত হয় একটা ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে এবং একটা ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে নির্গত শক্তির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ গুণ বেশি। সুতরাং ছোট ছোট ভূমিকম্পে কতটুকু পীড়নশক্তি অবমুক্ত হবে, তার মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়।
অতএব, গত দুদিনের ভূমিকম্পগুলোকে আমরা একটা বড় বা মাঝারি ভূমিকম্পের সতর্কতা সংকেত হিসেবে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে আমি মনে করি। এ ক্ষেত্রে আমাদের অন্তত তিন স্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। প্রথমত, জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় প্রস্তুতি পরিকল্পনা; দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্প দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা এবং তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় যে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে সেটা প্রধানত সব স্তরের মানুষের ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাসে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় আগাম প্রস্তুতি। সচেতনতা বৃদ্ধির মধ্যে অন্যতম হতে পারে ভূমিকম্পের আগে, ভূমিকম্প চলাকালে ও ভূমিকম্পের পরে করণীয় সম্পর্কে ‘দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি’ (স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টার) নির্দেশনার ব্যাপক প্রচার।
স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভবনসহ সব জীবন রক্ষাকারী সেবা (বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি প্রভৃতি) নিরাপদকরণ। অধিকন্তু বিদ্যুৎ বা গ্যাসলাইন যেন কোনো অবস্থাতেই দুর্যোগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে না তোলে, সেদিকে নজর দেওয়া।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: ১. চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ‘বিস্তারিত প্রকৌশলগত মূল্যায়ন’ বা ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট (ডিইএ) করে প্রয়োজনে ‘শক্তি-বৃদ্ধি কার্যক্রম’ (রেট্রোফিটিং প্রোগ্রাম) হাতে নেওয়া। শক্তি-বৃদ্ধি কার্যক্রমে অবশ্যই সরকারি সহায়তা প্রদানের নীতিমালা গ্রহণ করা দরকার। ২. বিদ্যমান গ্যাসলাইনগুলো কোনোমতেই ভূমিকম্প সহনীয় নয়, যা বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্যোগের কারণ হবে। অতএব, সব গ্যাসলাইন ভূমিকম্প সহনীয় করা।
৩. ভূমিকম্পের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, যা উন্মুক্ত গ্যাসের সংস্পর্শ পেলে ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। সুতরাং আগুন লাগার কারণ এবং আগুন ছড়ানোর কারণ বন্ধ করা গুরুত্বপূর্ণ। অতি অল্প খরচে এবং অতি অল্প সময়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ (Auto-trip) হওয়ার ডিভাইস সংযোজন করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। ৪. স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় জাতীয়ভিত্তিক এবং একক প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ভূমিকম্পে সাড়াদান কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা দরকার। ৫. দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালার বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ। তা ছাড়া আমাদের কোনো ‘ভূমিকম্প দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা’ নেই, ফলে জরুরি ভিত্তিতে ভূমিকম্প দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
মোহাম্মদ আবু সাদেক নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ।