২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

খেলার মাঠে রাজনৈতিক চেতনা

প্রথমা প্রকাশন এবিএম মূসার আত্মজীবনীর কাজ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসে, তখনই তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। ফলে তাঁর জীবদ্দশায় এটি প্রকাশিত হতে পারেনি। এবিএম মূসার প্রকাশিতব্য আত্মজীবনী বেলা যে যায়-এর নির্বাচিত অংশ প্রথম আলোয় প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় কিস্তি

এবিএম মূসা
এবিএম মূসা

আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে নানা পর্বের স্বাধিকার আন্দোলনের উল্লেখ করা হয়েছে বারবার। এই স্বাধিকার আন্দোলনের শুরু বায়ান্নর ভাষার জন্য সংগ্রাম, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, তারপর উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে—এসবই হচ্ছে উত্তপ্ত রাজনৈতিক আন্দোলন। এর বাইরেও আরেকটি চেতনার কথা শুধু তত্ত্বভিত্তিক বলে অভিহিত করা হয়। অথচ রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে এর অসামান্য অবদান রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার ভিত্তিও হচ্ছে এই চেতনা, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রধানত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের কথাই বলা হয়,
যদিও পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের মধ্যে ফারাক ছিল সব ক্ষেত্রে। এমনই একটি ক্ষেত্র খেলাধুলার জগৎ।
বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন ছয় দফা নিয়ে সারা দেশ উত্তাল, অর্থনৈতিক অবিচারের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার, তখন খেলার জগতেও বৈষম্য নিয়ে আন্দোলন চলছিল। এই আন্দোলনের খবর বাইরে কেন, খেলাধুলার অঙ্গনেরও অনেকেই জানতেন না। এর নাম ছিল ক্রীড়াক্ষেত্রে বৈষম্য অবসানের আন্দোলন। পুরো ষাটের দশকেই এই আন্দোলন চলেছে, যাতে শুধু ক্রীড়াজগতের নয়, বাইরের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েন। এই আন্দোলনের খবর খেলার পাতায় সীমাবদ্ধ থাকত বলে অনেকের নজরে পড়ত না। তাই বাইরের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা অথবা উৎসাহ তেমনভাবে আন্দোলনকারীরা পাননি। তাঁদের সংগ্রাম তাঁরা একাই চালিয়ে গেছেন।

ক্রীড়ার জগতে এই সংগ্রামের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের নাম শুনলেই অনেকে এর গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। কেউ বিশ্বাস করবেন কি, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় গভর্নর পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেল আজম খান এই আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন! এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা জহিরুদ্দিন, ক্রীড়াবিদ এস এ মহসিন, শাহজাহান প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাংবাদিক এস এ মান্নান লাড়ু ভাই ও আমি স্বয়ং এই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলাম। বাঙালি আমলাদের মধ্যে ছিলেন সিএসপি সিদ্দিকুর রহমান, তৎকালীন ঢাকার কমিশনার গিয়াসউদ্দিন আহমদ চৌধুরী ও আরও অনেকে। বিস্তারিত আলোচনা করলে তখনকার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে, এ রকম আরও অনেক নাম এসে যাবে।
দুর্ভাগ্যবশত খেলার মাঠের সেই নীরব বিপ্লবের কাহিনি কখনো কারও আলোচনায় আসে না। অথচ দেশের সার্বিক স্বাধিকার আন্দোলনে এর জোরালো প্রভাব ছিল। কারণ, খেলার মাঠে ফুটবল, সাঁতার ও ক্রিকেটে যে হাজার হাজার দর্শক আসতেন, তাঁরাও পরোক্ষভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কারণ, খেলাধুলায় বৈষম্য ও খেলার মাঠে পক্ষপাত তাঁদের মনে যেমন গভীর ছাপ ফেলে, তেমনি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও ক্রোধেরও সঞ্চার করে। এঁরাই খেলার মাঠ থেকে রাস্তায় নেমেছিলেন।
খেলার মাঠ থেকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার যে ঘটনাটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, যা এখনো অনেকের মনে থাকার কথা। তা হচ্ছে, একাত্তরে ঢাকা স্টেডিয়ামের সেই ঐতিহাসিক দিনটি— একাত্তরের ১ মার্চ। সেদিন হাজার হাজার দর্শক স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা দেখছিলেন। খেলা চলছিল শুধু পশ্চিমাদের নিয়ে গঠিত পাকিস্তান দলের সঙ্গে কমনওয়েলথ একাদশের। এমন সময়, অর্থাৎ বেলা একটার দিকে রেডিওতে খবরে বলা হলো, ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকবেন না। ঢাকায় ৩ মার্চ থেকে অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল, যে অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে জেতার পর পাকিস্তানের সংবিধান তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রাখবেন। যে মুহূর্তে রেডিওতে ঘোষণা শোনা গেল, স্টেডিয়ামের ৩৫ হাজার দর্শক উত্তেজিত হয়ে এক দল মাঠে ঢুকে পড়লেন, আরেক দল বাইরে বেরিয়ে এলেন। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হলো আকাশ-বাতাস। পাকিস্তানি খেলোয়াড়েরা দৌড়ে ড্রেসিং রুমে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। পরে পুলিশি পাহারায় তাঁদের হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দর্শকেরাই কিছুক্ষণ আগে খেলা দেখার সময় চিৎকার করে হাততালি দিয়ে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিচ্ছিলেন।
খেলার মাঠের এই ঘটনার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন খেলাধুলার সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ পেত। এর অবশ্য কারণও ছিল। যেকোনো খেলার সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা হতো। অনেক সময় তাঁরা পক্ষপাতের শিকার হতেন। এ ছাড়া ক্রীড়াক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও যে বৈষম্য ছিল, তা সবার নজরে পড়ত। বিশেষ করে, পশ্চিম পাকিস্তানি কোনো দলের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানি দলের খেলার সময় উত্তেজনা বৃদ্ধি পেত। সরাসরি একটি প্রাদেশিকতার মনোভাব গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলের দর্শকদের মধ্যে। এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো ঘটত কায়েদে আজম আন্তপ্রাদেশিক ফুটবল অথবা ক্রিকেট প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে। পূর্ব পাকিস্তানি দলের সঙ্গে পাঞ্জাব বা বেলুচিস্তানের ফুটবল দলের খেলা ঢাকায় হলে উত্তেজনা বাড়ত। কোনো কোনো বছর প্রতিযোগিতার সময় গ্রহণ করা অন্যায় সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষও বেধে যেত, মাঠে গোলমাল বাধত। অনেকটা এখনকার মোহামেডান-আবাহনীর খেলার ক্ষেত্রে যেমন হয়, ঠিক তেমনভাবে। এভাবে খেলার জগতে উগ্র প্রাদেশিকতার জন্ম নেয়, স্বভাবতই যার প্রভাব তৎকালীন রাজনীতির ওপর পড়েছিল অথবা
এর উল্টোটাও বলা যায়, রাজনৈতিক জগতে তখন যে অসন্তোষ ছিল, তারই ছোঁয়া লেগেছিল ক্রীড়াজগতেও।
পূর্ব পাকিস্তানে এ সময় বিরূপ মনোভাব কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তার আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়, ঢাকার মাঠে পশ্চিম পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের সম্পর্কে যে মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল, তার বিবরণ তুলে ধরার মাধ্যমে। একসময় ঢাকা ফুটবল লিগে পশ্চিম পাকিস্তান, বিশেষ করে করাচি থেকে খেলোয়াড় আমদানি করা হতে থাকে। এসব খেলোয়াড়ের অনেকেই ছিলেন নিগ্রো বংশোদ্ভূত করাচির কাছে মাকরান এলাকার। তাঁদের মাকরানি নামে অভিহিত করা হতো। বেশ কয়েকজন মাকরানি ফুটবলার, বিশেষ করে দুই ভাই আবিদ ও মুসা ঢাকার মাঠে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন তাঁদের চমৎকার খেলার জন্য। এই মাকরানিদের প্রথম আমদানি করেছিল ভিক্টোরিয়া ক্লাব। সমস্যা দেখা দিল একজন-দুজন করে পুরো ১১ জন মাকরানিকে নিয়ে ক্লাবটি দল গঠন করার পর। এটাই কাল হলো ভিক্টোরিয়া ক্লাবের জন্য।
অন্যদিকে, ভিক্টোরিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান স্পোর্টিংয়ে ছিলেন সবাই স্থানীয় অর্থাৎ বাঙালি খেলোয়াড়। সুতরাং যখনই মোহামেডান বনাম ভিক্টোরিয়ার খেলা হতো, তখনই মনে হতো, পূর্ব পাকিস্তানিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এ রকম ক্ষেত্রে দর্শকদের প্রায় অনেকে ভিক্টোরিয়ার সমর্থক হয়েও মোহামেডানের প্রতি দুর্বল হয়ে যেতেন। এদিকে পত্রপত্রিকায়ও ভিক্টোরিয়ার অবাঙালি নিয়ে দল গঠন করার সমালোচনা হতে থাকে। কোনো কোনো পত্রিকা, বিশেষ করে অবজারভার-এ ভিক্টোরিয়াকে উল্লেখ করা হতো মাকরানি ইলেভেন বলে।
সর্বোপরি, পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠল, যখন জাতীয় অর্থাৎ পাকিস্তানি দল গঠনের সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে খেলোয়াড় বাছাইয়ে এসব অবাঙালি খেলোয়াড় প্রাধান্য পেতে থাকলেন। সবাই বাঙালি খেলোয়াড়দের বঞ্চনা করা হচ্ছে বলে শোরগোল করে উঠলেন। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে ভিক্টোরিয়া দল মাঠে নামলেই দর্শকেরা ‘দুয়ো-দুয়ো’ করে উঠতে থাকেন, নানা রকম টিটকারি দিতে থাকেন খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের। শেষ পর্যন্ত ঢাকার ফুটবল টিমে পশ্চিম পাকিস্তানি খেলোয়াড়ের সংখ্যা পাঁচজনের বেশি হতে পারবে না বলে সীমা নির্ধারিত হলো। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি খেলোয়াড় আমদানি করে ভিক্টোরিয়া সেই যে দর্শকদের বদনজরে পড়ল, তাতে ক্লাবটি একসময় খেলার জগতের প্রথম সারি থেকে হারিয়ে গেল।
খেলোয়াড়, দর্শক, ক্রীড়ামোদী ও ক্রীড়ানুরাগীদের মধ্যে যখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মনোভাব গড়ে উঠছিল, একই সঙ্গে ক্রীড়া সংগঠকদের মধ্যেও একটি বিশেষ ধারা কাজ করছিল। সেই ধারা গড়ে উঠেছিল ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ ও সামগ্রিকভাবে ক্রীড়া সংগঠনে বিদ্যমান বৈষম্যকে কেন্দ্র করে।
তখন খেলাধুলার জন্য অর্থ বরাদ্দ ও ক্রীড়াজগতে কর্তৃত্ব পুরোপুরি ছিল যথাক্রমে কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানি সংগঠকদের হাতে। কেন্দ্রীয় বাজেটে খেলাধুলার জন্য বরাদ্দের সামান্য মাত্র অর্থ আসত পূর্ব পাকিস্তানে। এই অর্থ সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ছিল প্রায় এক কোটির মতো, এখনকার হিসাবে ১০০ কোটি বলা যেতে পারে। তা থেকে পূর্ব পাকিস্তান পেত সাকল্যে মাত্র এক লাখ টাকা, অর্থাৎ বর্তমান হিসাবে কোটি খানেক। এই বরাদ্দ দেওয়া হতো পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনকে, যা ফেডারেশন ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, সাঁতার, অ্যাথলেটিকস ও অন্যান্য ক্রীড়া সংগঠনের মধ্যে বণ্টন করত। এসব সংগঠন আবার আলাদা ছিল না, ফেডারেশনেরই বিভিন্ন শাখা ছিল, যাকে ‘সেকশন’ বলা হতো। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ক্রীড়া বরাদ্দ ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিটি খেলার জন্য ছিল আলাদা ফেডারেশন ও স্বাভাবিকভাবেই আলাদা বরাদ্দ।
এসব বরাদ্দের ভাগ পেত না পূর্ব পাকিস্তান, সব টাকাই পশ্চিমে খরচ করা হতো। এই বৈষম্য একসময় এখানকার ক্রীড়া সংগঠকদের নজরে আসে, তাঁদের মধ্যে প্রথমে গুঞ্জন, পরে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের কর্মকর্তারা এ নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করতেন না। ফলে, ক্রীড়া সংগঠকদের মধ্যেও একটি বিদ্রোহী গ্রুপের জন্ম হয়। তারাই এগিয়ে এল ক্রীড়াক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।

আগামীকাল: মুক্তিযুদ্ধের মিডিয়া সেন্টার
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।