আপনি মানেন আর না মানেন, খিচুড়ি বাঙালির বাপের সম্পত্তি। তেল আর জল মিশ না খাক, বাংলায় চাল-ডালের এই মিলমিশ যে ঈশ্বরী পাটনির আমল থেকে, তা ঐতিহাসিক সত্য।
বাংলায় খিচুড়ির জয়বাদ্য শোনা যায় সেই আলেক্সান্ডারের ‘সত্যিই সেলুকাস’ জমানা থেকে। উত্তর আফ্রিকার বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতা চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে লেখা ভ্রমণকাহিনিতে বলেছেন, তিনি এই ‘দোজখ-ই-পুর নিয়ামতে’ (‘প্রাচুর্যপূর্ণ নরক’, অর্থাৎ কিনা বঙ্গদেশ) মুগ ডাল আর চাল দিয়ে ‘খিসরি’ (Khisri) তৈরি হতে দেখেছেন। বতুতার পর এ দেশে আসা রুশ পর্যটক নিকিতিনের লেখাতেও খিচুড়ির কথা এসেছে। বাদশাহ আকবরের সময় আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’-তে সাত কিছিমের খিচুড়ির রেসিপি দিয়েছেন। বীরবল কীভাবে খিচুড়ি রান্না করে আকবরকে নীতিকথা শিখিয়েছিলেন, তা ‘বীরবলের গপ্প’-তে আছে।
কিন্তু যেহেতু বাঙালি ডিভ্যালুয়েশনে অন্ধবিশ্বাসী, সেহেতু তার কাছে খিচুড়ি তো খিচুড়ি—কোনো দিশি মালেরই দাম নেই। তার সব আদর্শই বিদেশি। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূলধন বিদেশি; ধানের চাষ যে ধানের চাষ—তারও আদর্শ বিদেশি। আমাদের সিনেমার আদর্শ আলমগীর কবির বা জহির রায়হান নয়—ত্রুফো-গদার কিংবা হালের আব্বাস কিয়োরোস্তামি। থিয়েটারের আদর্শ শিশির ভাদুড়ি নন—রুশ স্তানিস্লোভস্কি। নৃত্যগীতের আদর্শ কত্থক বা ভরতনাট্যম নয়—ইউরোপীয় সুইং। তাই আমাদের খিচুড়ির রাঁধুনির আদর্শ মা-খালা বা জগা বাবুর্চি নন। সেই আদর্শও বিদেশি।
পশ্চিমা দেশে ‘কেজেরি’ (kedgeree) নামে যে জিনিসটা হোটেল-রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়, তা আদতে আমাদেরই খিচুড়ি। ‘ঠাকুর’ যেমন করে ‘টেগোর’, ‘দত্ত’ যেমন করে ‘ডাট’ হয়েছিল, সেই একই কায়দায় ভিক্টোরীয় যুগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ অফিসারদের হাত ধরে খিচুড়ি ইংল্যান্ডে পৌঁছে বিলাতি উচ্চারণে ‘কেজেরি’ হয়ে গেছে। ডিভ্যালুয়েশনের কারণে সেই খিচুড়ি রান্না শিখতে এখন আমাদের বিদেশে যাওয়ার কথা মনে পড়েছে।
কাগজে বেরিয়েছে, সরকার প্রাথমিক পড়ুয়া শিশুদের দুপুরে খাওয়ানোর কর্মসূচি নিয়েছে। সে অনুযায়ী শিশুদের খিচুড়ি ও বিস্কুট দেওয়া হবে। সেই খিচুড়ি রান্নার দায়িত্ব যাতে জগা-মগার হাতে পড়ে জগাখিচুড়ি না হয়, সে জন্য কর্মকর্তারা মারাত্মক গবেষণা করেছেন। কীভাবে খিচুড়ি রান্না করতে হবে, কীভাবে সেই খিচুড়িতে ওড়ং ডুবিয়ে প্রথমে গামলায় এবং গামলা থেকে তা অতি সন্তর্পণে থালায় ঢালতে হবে—এসব শিখতে ৫০০ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানোর একটি সানুনয় প্রস্তাব করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। পরিকল্পনা কমিশন অনুমোদন দিলেই বিষয়টি ‘আধা খ্যাঁচড়া অবস্থা’ থেকে বের হয়ে একটি কমপ্লিট পর্যায়ে উঠে আসবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, ডিপিই, পরিকল্পনা কমিশন এবং বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের কর্মকর্তারা বিদেশি হেঁশেল থেকে খিচুড়ি বিশেষজ্ঞ হওয়ার এই দুর্লভ সুযোগ পাবেন।
ডিপিই বিদেশ থেকে খিচুড়ির ট্রেনিং নেওয়ার জন্য মাত্র পাঁচ কোটি টাকা চেয়েছে। এ ছাড়া একই ট্রেনিং দেশে বসে দেওয়ার জন্য আরও চেয়েছে ১০ কোটি টাকা। খিচুড়ি রান্নার জন্য তেল-নুন ও থালা-বাটি কেনা বাবদ আরও যে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, সেগুলোর অঙ্ক মেলানোর চেয়ে পাটিগণিতের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ১০ তলা বিল্ডিংয়ে ওঠা সোজা। সে কারণেই হয়তো পরিকল্পনা কমিশন এই প্রকল্প থেকে বিদেশযাত্রা বাতিল করার কথা বলেছে। তবে পরিকল্পনা কমিশনের মাথায় রাখা দরকার, ‘মানি ইজ ডাস্ট’।
কারণ, এর আগে নদী-নালা-পুকুরের দেশ বাংলাদেশ থেকে পুকুর কাটার কায়দা শেখার জন্য একটি প্রকল্পের ১৬ কর্মকর্তাকে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা খরচা করে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বোয়িংয়ের এক উড়োজাহাজ ডেলিভারি নিতে দুই দফায় ৪৫ জনের মার্কিন মুল্লুক ঘোরার ঘটনাও আমরা দেখেছি। একটি ক্যামেরা কিনতে তিনজনের বিদেশ যাওয়া, নলকূপ খনন শিখতে একাধিক কর্মকর্তার বিদেশে সফর—এ ধরনের খবর হামেশাই আসে। এর মধ্যে খিচুড়ি কী দোষ করল, বুঝতে পারছি না।
খিচুড়ির খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসামাজিক অণুজীবের মতো ভাইরাল হওয়ায় একটা ভার্চ্যুয়াল জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় গতকাল বিষয়টি খোলাসা করার চেষ্টা করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম-আল-হোসেন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলছেন, খিচুড়ি রান্না শেখার জন্য নয়, আসলে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থাপনা দেখতে কর্মকর্তাদের বিদেশ পাঠানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে সাধারণ মানুষ বলাবলি করছে, ‘খিচুড়ি রান্না ও পরিবেশন করা দেখতে যাওয়া’ আর ‘স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থাপনা দেখতে যাওয়া’—আসলে দুইয়ের মধ্যে তফাত বিলাতের ‘কেজেরি’ আর আমাদের ‘খিচুড়ি’র মতো।
এটি ঠিক, যেকোনো প্রকল্পে দেশে-বিদেশে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের বিধান রয়েছে। এই বিধান যত দিন টিকিয়ে রাখা যাবে, তত দিন ভ্রমণভিত্তিক অভিজ্ঞতাপিপাসু কর্মকর্তাদের প্রকল্পনিষ্ঠা অদম্য থেকে যাবে। তত দিন পাবলিকের পয়সায় থালা-বাটি ধোয়ার অভিজ্ঞতা নিতেও বিদেশে যাওয়া যাবে।
আমাদের গড় আয় এবং আয়ু—দুটোই যেহেতু গড়গড়িয়ে বাড়ছে, সেহেতু এই সামান্য কটি টাকার জন্য খিচুড়ির বিদেশি অভিজ্ঞতা থেকে জাতিকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। আমাদের (তেলা) মাথায় রাখা দরকার, কর্মকর্তারা যদি তেল ছাড়া খিচুড়ি রান্নার রেসিপিটা শিখে আসেন, তাহলে বড় ভালো হয়। বিদেশে যদি তাঁদের পাঠানো সম্ভব না-ও হয়, তাহলে যেন ফুটপাতে বিক্রি হওয়া ‘বিনা তেলে রান্না পদ্ধতি’ বইটি অন্তত তাঁদের মুখস্থ করানো হয়। সেখানে তেল ছাড়াই খিচুড়ি রান্নার কায়দা বাতলে দেওয়া আছে। এটি করা গেলে আমরা অন্তত হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিমুক্ত একটি প্রজন্ম পেতাম।
শুনছি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া জগা’রা আজকাল নাকি লন্ডন-নিউইয়র্কের বাঙালিপাড়ায় ‘জগা’স খিচুড়ি’ নামে শোরুম খুলে বসেছেন। সেখানে সাহেবসুবোরা পর্যন্ত লাইন দিচ্ছেন। পরিকল্পনা কমিশন আপাতত ভ্রমণপিপাসু কর্মকর্তাদের সেই লাইনে দাঁড়াতে পরামর্শ দিতে পারেন। অবশ্য নিজের টাকায়।
সারফুদ্দিন আহমেদ: সাংবাদিক ও লেখক