মানুষ যখন আবেগাপ্লুত থাকে, তখন কখনো সত্যটা বেরিয়ে আসে। আদালতে দেওয়া বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জোড়া জবানবন্দিতে দেশের শাসনব্যবস্থার প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত এবং প্রকৃত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। এতে মনে হয় তিনি নিজের, পরিবারের সদস্যদের এবং দলের অবস্থার পরিবর্তন চান, বিদ্যমান ব্যবস্থার নয়।
আমরা তাঁর দুটি জবানবন্দি পড়েছি এবং তা থেকে তাঁর বিচারাধীন বিষয়ে দেওয়া মতামত বাদ দিয়ে শুধু রাজনৈতিক মন্তব্যের দিকে নজর দেব। তিন মাস লন্ডনে থেকে সে দেশের গণতন্ত্র, দল পরিচালনা ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার কোনো কিছু তিনি বুঝে এসেছেন এবং তার প্রয়োগ তিনি করতে চান, সেটা জানতে পারলে স্বস্তি পেতাম। কিন্তু এসব আমাদের রাজনীতির শাস্ত্রে ও সংস্কৃতিতে এখনো অভাবনীয়। যা হোক, লন্ডন থেকে তাঁর ফেরার পরদিন ১৯ ও ২৬ অক্টোবর তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দুটি আলাদা জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু এতে তাঁর সুযোগ ছিল নিজের দুঃখ-কষ্টের বিবরণ দিতে গিয়ে দেশের বিচারব্যবস্থার আইনি ও অবকাঠামোগত দুর্দশা তুলে ধরার। এবং তা দূর করতে গিয়ে তিনি কী করবেন, সেটি পরিষ্কার করার। কিন্তু তিনি নিজেকে আবারও ‘আমিত্ব ও আমার’ মধ্যেই আবদ্ধ রাখলেন। এর ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেন না। সর্বশেষ জবানবন্দিতে ‘আমি’ কথাটি ২১ বার এবং ‘আমার’ কথাটি ৩৬ বার এসেছে।
প্রশ্ন উঠবে, এ আর নতুন কী, এটাই তো আমাদের সংস্কৃতি ও ভবিতব্য; এর উত্তর হলো, আর কত কী ঘটলে তবে এই ব্যূহ ভাঙবে।
তীক্ষ্ণ চোখে দেখলে সত্যি তিনি একটি শব্দও নতুন বলেননি। এই যুক্তি, এই আবেগ, এই ক্ষোভ এবং এই রাগ আমরা হাড়ে হাড়ে চিনি। তাই বলে তাঁর প্রতি অন্যায্য আচরণ করা হলেও সহানুভূতিশীল হব না? নিশ্চয় হব। কিন্তু তাঁকে মানবিক গণ্ডির বাইরে যেতে দিতে মন সায় দেবে না।
আমরা মনে রাখব, অনেক সময় রাজনীতিবিদের পক্ষে আদালতে দেওয়া বিবৃতির একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য থাকে। সেই বিবেচনাতেই খালেদা জিয়ার জবানবন্দির রাজনৈতিক অংশের এই বিশ্লেষণ। তাঁর বক্তব্যে কোনো অনুশোচনা, আত্মসমালোচনা বা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারার জন্য কোনো আক্ষেপ নেই। বরং তিনি এই ধারণাই দিয়েছেন, যেখানে যা আছে, তা-ই থাকবে, শুধু বিএনপি ক্ষমতায় গেলেই হলো।
অনেক সময় দেখেছি, কেউ কেউ বলেন, সাংবাদিকতা হলো প্রধানত সরকারের ভ্রান্ত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে কথা বলা। দিনকাল যা পড়েছে, সেটা আপনারা যখন পারেন না, তখন বিরোধী কণ্ঠস্বর, যখন যেটুকু উচ্চারিত হয়, তাকে বিদ্ধ করতে উতলা হন কেন? দুর্বল করে রাখা বিরোধী দলকে আরও দুর্বল করলে তো সরকারের ভ্রান্তি ঘোচে না, বরং তাকে আরও উৎসাহিত করা হয়। এই যুক্তির কোনো ভিত্তি নেই, বলব না। তবে এটাও বলব, দুটি ভ্রান্তি মিলে কখনো কোনো শুদ্ধতা বা ন্যায্যতা তৈরি করে না। তা ছাড়া খালেদা যখন বলেন, জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে নিজেকে ‘একাকার’ করেছেন, তখন জনগণের মুক্তির পথে হাঁটবেন না কেন? কেন ভুল ধারণা দেবেন, তাদের ক্ষমতায়ন আর জনমুক্তি সমার্থক। রূপকল্প ২০৩০-এর মতো এ পর্যন্ত সংস্কারের যেসব আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে ভুগছে।
তাই বৃহত্তর গণ্ডিতে দাঁড়িয়ে বলব, ওই দুটি জবানবন্দির রাজনৈতিক দিকগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে যে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার তিনি এখনো একজন প্রচণ্ড সমর্থক। ক্ষমতায় গেলে এই ব্যবস্থার খোলনলচে তিনি পাল্টাবেন না।
এর বিপরীত ধারণা আমাদের দিতে চাইলে তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড (যেমন পথে পথে বিপুল সমাবেশ ঘটলে সংস্কারের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলা, সংস্কারের অ্যাজেন্ডাকে জনপ্রিয় ও বিশ্বাসযোগ্য করা) এবং বক্তৃতা-বিবৃতিতে পরিষ্কারভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলতে হবে। সামনে নির্বাচন। তাই ক্ষমতাসীন সরকারসহ যার যত বেশি নির্বাচনে ভালো করার সম্ভাবনা, তাদের কাছে শুনতে চাইব, আমরা ক্ষমতায় এলে বিচারক নিয়োগে শুধু কাগুজে আইন করব না, সব থেকে মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের একটি স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়োগদানের ব্যবস্থা চালু করব। দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় পারতপক্ষে মধ্যম মানসম্পন্ন ব্যক্তিদের উঁচু পদে বসাতে অগ্রাধিকার দেব না। যাতে অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা আসেন, সে জন্য বিচার বিভাগের বাজেট কয়েক গুণ বাড়াব, বিচারকদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণের বেশি করব, অর্থাৎ উন্নত বিশ্বের মতো করব।
‘তিন–তিনবারের প্রধানমন্ত্রী’ কথাটি বিএনপির চেয়ারপারসন ২০১৪ সালের আগে এ রকম গর্বের সঙ্গে আওড়িয়েছেন বলে মনে
পড়ে না। তবে এখন আমরা তাঁর কাছে অনুশোচনা বা ভুলের স্বীকারোক্তি শুনতে চাই। মাসদার হোসেন মামলার রায় তাঁর সরকারই পদ্ধতিগতভাবে প্রতিহত করেছিল। ‘ক্ষমতাসীনেরা কিসে তুষ্ট, কিসে রুষ্ট, সে কথা মাথায় রেখে বিচারকদের চলতে হচ্ছে। রায়, সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ প্রদানে বিচারকদের তোয়াক্কা করতে হচ্ছে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর।’ এ রকমের ভূরি ভূরি উক্তি আমাদের রাজনৈতিক অভিধানে আছে। কিন্তু বিচার বিভাগের সংস্কারে কোনো বিশ্বস্ত অঙ্গীকার নেই। যাঁদের এটা বোঝা দরকার, তাঁরা এটা আদৌ বোঝেন কি না, সে প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
অধস্তন আদালতে দেওয়া খালেদা জিয়ার জবানবন্দি পড়ে আমাদের মনে পড়ল, ২০০১ সালে একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে তিনি বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে বিচার বিভাগ পৃথক্করণ অধ্যাদেশ জারি করবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। ওই অধ্যাদেশে সই দেওয়ার আগমুহূর্তে তিনি মিথ্যা বলে তা ঠেকিয়েছিলেন। এখন সেই আদালতে আদালতের স্বাধীনতা প্রশ্নে তাঁর ক্রন্দন কী করে মানুষের চোখকে আর্দ্র করতে পারে? কেউ বলবেন, আপনাদের এত শখ কেন? কে কবে সত্যিকারের স্বাধীনতা দেবে? খামোখা অবাস্তব কথা বলেন কেন?
সত্যি, আমাদের জাতীয় রাজনীতিটা এখনো এই গর্তে পড়ে আছে। শুধু তাঁকে বিচ্ছিন্নভাবে দোষ দেব না, এই আমাদের নিয়তি। তবু এটা বারবার লিখব, প্রতিবাদের প্রবণতা দেখাব, কারণ নিরঙ্কুশ ক্ষমতাচর্চার মনোভাব না পাল্টালে দেশের পরিবর্তন আসবে না। ৫ জানুয়ারির একটি একতরফা নির্বাচন অনেক বড় বাধা। কিন্তু একমাত্র সেটাই কি সভা করতে না দেওয়ার মতো আজকের অসহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক ঘাটতির জন্য দায়ী? অবশ্যই আমরা আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ কামনা করি। বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে খালেদা জিয়ার বৈধ স্বার্থ রক্ষা না পেলে, তাঁর সভা-সমাবেশের অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে আমরা উদ্বিগ্ন হব। ফেনীতে তাঁর গাড়িবহরে সর্বশেষ হামলার ঘটনা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। এ রকম ঘটনা সব সময়ের জন্য বর্জনীয় ও নিন্দনীয়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, এ রকম হামলা কার আমলে কত বেশি বা কম, তা তর্কের বিষয়, কিন্তু কোনো আমলই এমন ধাঁচের হামলা-মামলা থেকে মুক্ত নয়।
এই বৃত্তটা ভাঙতে হবে। যাঁরা বলবেন, এখন এটা বলার সময় নয়, আগে বাঁচুন, শ্বাস নিন, তারপর না হয় বলবেন, এই যুক্তিও নতুন নয়। সুতরাং, যখনই দেখব উচিত কথা বলা হয়নি, বলতে সচেষ্ট হব। কারও অপারগতা বিবেচনায় উদাসীন থাকব না। যথাসাধ্য প্রতিবাদে সরব হব।
আমাদের রাজনীতিতে সেই ফরাসি রাজা ষষ্ঠ¤ লুইয়ের প্রেতাত্মা ঘোরাঘুরির মধ্যে থাকে। লুই বলেছেন, ‘আমিই রাষ্ট্র।’ সেই ধ্বনি
যেন প্রতিধ্বনিত: আমিই গণতন্ত্র। আমিই আইনের শাসন। আমি কষ্টে থাকলে গণতন্ত্র কষ্টে থাকে। আমি বন্দী হলে আইনের শাসনটাই বন্দী হয়। কারণ, আমি আর আমি নেই। জনগণে ‘একাকার’ হয়ে গেছি। কিন্তু বাস্তবতা কি তা–ই বলে?
আমরা সকৌতুকে লক্ষ করি, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবলের মামলা দুটি এক-এগারোর সরকারের আমলে দায়ের করা হয়েছিল, সে কথা তিনি এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট করেছেন যে, ওই একই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতির মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে। আসলে দুঃখটা তাঁর এখানেই।
প্রক্রিয়াগত দিক থেকে জিয়া চ্যারিটেবলের চেয়ে জিয়া অরফানেজের মামলা এগিয়ে আছে। দোষী হলে এর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন। আগামী ১০০ দিনের মধ্যে এই মামলার রায় হলেও হতে পারে। কিন্তু প্রসিকিউশনের হিসাব-নিকাশ যা বলবে, তার প্রভাব থাকবে।
২০০৮ সালের ৩ জুলাই জিয়া অরফানেজ মামলাটি দায়ের করা হয়। ১৯৯১ সালের ৯ জুন ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংক প্রায় ৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকার অনুদান দিয়েছিল। অভিযোগ হলো, ওই তহবিলের ২ কোটি ১০ লাখ টাকা তছরুপ হয়েছে। গত প্রায় এক দশকে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা ওই মামলায় আদালত স্থানান্তর, অভিযোগপত্রের বৈধতা, বিশেষ আদালতের এখতিয়ার নিয়ে আলাদা প্রজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা, অধিকতর তদন্ত, সাক্ষীদের পুনরায় জেরার মতো বিষয়ে অন্তত অর্ধডজন হাইকোর্ট বেঞ্চে অন্তর্বর্তী আদেশের জন্য গেছেন। তবে শুধু একটি রুলের আদেশের বেশি পাননি বলে জানি। অবশ্য বেঞ্চ দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার নজিরও তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ ১১ জন সাক্ষীর পুনঃ জেরার অনুমতি এবং বিচার স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের কাছে প্রতিকার চেয়েছিলেন। ৩০ অক্টোবর সর্বোচ্চ আদালত তাতে ‘নো অর্ডার’ দিয়েছেন। স্থগিতাদেশ দেননি। এখন এ মামলা চলতে বাধা নেই।
একজন সাধারণ বিচারপ্রার্থীর পক্ষে এই সময়সাপেক্ষ মূল্যবান অনুশীলন চালানো সম্ভব নয়। বেগম জিয়া বলেছেন, ‘আলোচ্য মামলাটি দায়ের এবং এর সকল কার্যক্রম ও পরিণতি কেবল ফৌজদারি বিধিবিধান, আইনকানুন ও বিচারব্যবস্থার মধ্যেই সীমিত নয়।’ তিনি সম্ভবত এটা বিবেচনায় নেননি যে, সাধারণ মানুষ দেদার সাজানো মামলায় পড়েন। প্রকৃত বাদীরাও সুবিচার না পেয়ে নিরন্তর গুমরে কাঁদেন। এক জিয়া অরফানেজ মামলা থেকে বাঁচতে তাঁর পক্ষে যে প্রক্রিয়ায় প্রায় দশক-দীর্ঘ আইনি লড়াই করা সম্ভব হয়েছে, সেটা আর কতজনের পক্ষে সম্ভব হতো? তিনি যা বলেননি সেটা হলো, এটা সেই রাষ্ট্র, যার শাসনপদ্ধতি গঠনে তিনিও কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷