ক্ষমতার ছায়ায় ধর্ষক প্রতিপালন!

প্রথম সারিতে বাঁ থেকে সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম ও শাহ মাহবুবুর রহমান দ্বিতীয় সারিতে বাঁ থেকে অর্জুন লঙ্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান
সংগৃহীত

করোনাতেও থেমে নেই পুরুষতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাচর্চার ধার। সমতল কী পাহাড়ে বাড়ছে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা। স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক তরুণীকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। গত শুক্রবার রাতে সিলেট নগরীর টিলাগড় এলাকায় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে এ ঘটনা ঘটে। করোনা পরিস্থিতিতে ছাত্রাবাস বন্ধ ছিল।

তবে ছাত্রাবাসের ওই কক্ষ ২০১২ সাল থেকে ছাত্রলীগের দখল করা কক্ষ হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ উঠেছে, ওই কক্ষে থাকা ছাত্রলীগের একটি পক্ষের ছয়-সাতজন কর্মী এ ঘটনায় জড়িত। কক্ষটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যেই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবারই। তবে ধারণা করা হচ্ছে, কক্ষটি বর্তমানে যাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, তারা ব্যাপক ক্ষমতাধর।

কীভাবে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা একে অন্যকে সমর্থন দেয়, তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীদের দ্বারা নারীর ওপর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে।

এখন প্রশ্ন হলো, যখন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, তাহলে কীভাবে ছাত্রাবাস খোলা থাকে এবং সেখানে সুনির্দিষ্ট একটি কক্ষের সামনে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে? সেই প্রতিষ্ঠানপ্রধান হয়তো যুক্তি দিতে পারেন যে এ ধরনের ঘটনা যেকোনো জায়গাতেই ঘটতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় সেই ছাত্রনেতাদের সেখানে আসা-যাওয়া ও প্রবেশ এটাই প্রমাণ করে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখন আর কর্তৃপক্ষের হাতে নেই। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ বহু আগ থেকেই হয়তো চলে গেছে ছাত্রনেতাদের হাতে। কলেজের প্রিন্সিপালরাও এদের হাতে জিম্মি।

এমন তো নয় যে এই ছাত্ররা জানে না যে ধর্ষণ অপরাধ? এমনও নয় যে তারা বোঝে না যে এ ধরনের অপরাধ করার কারণে তাদের পরিবার সামাজিকভাবে হেয় হবে। তারা সবাই জানে, বোঝে। তবে সবচেয়ে বড় যে বোঝাপড়া, সেটা হলো—তারা জানে তারা ক্ষমতাসীন দলের লোক, তাদের জন্য আইন হয়তো প্রযোজ্য হবে না। কিংবা তাদের বেশি দিন জেলে থাকতে হবে না। এ ঘটনার জন্য তাদের কর্তৃত্ব, ক্ষমতা কিংবা কদর কমবে না; বরং লোকজন তাদের আরও ভয় পাবে, আরও তোয়াজ করবে। আর এই তোয়াজ–সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে তারা আরও ক্ষমতাবান হয়ে যাবে।

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের গণধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে দফায় দফায় উঠেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৮ সালের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল; সেখানেও দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল ছাত্রলীগের সে সময়কার কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। তিন মাস আন্দালনের ফল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে।

তবে এখনকার হিসেব একটু ভিন্ন। এখন ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের কারও কোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলে, তাতে তারাই বাধা হয় যাদের নাকি বিচারের ব্যবস্থা করবার কথা। এতে আসলে লাভবান হচ্ছে ধর্ষক ও নিপীড়কেরা। তারা জেনে গেছে, এই রাষ্ট্রে তারা ধর্ষণ করেও রেহাই পাবে। কারণ, তারা ক্ষমতাসীন দল করে। তারা আরও জানে, কীভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে বাদীকে মানসিকভাবে দুর্বল করা যায়, ভীত করা যায়। তাই তারা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর ভর করে পুরুষতান্ত্রিক সর্বোচ্চ ক্ষমতার ‘আনন্দ’ নিতে বারবার উৎসাহিত হয়।

আর তাতেই আরও শঙ্কায় পড়ে এ দেশের নারীরা। যদি জানে অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের, তখন অনেকে মামলা করতে ভয় পায়। তাতে আরও পোয়াবারো হয় অপরাধীদের। তাদের অপরাধ আর ঠেকায় কে? ‘আইন সবার জন্য সমান’ কিংবা ‘কেউই ছাড় পাবে না’—দলীয় নেতাদের এ ধরনের বুলি যে কতটা হাস্যকর, তা প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা ধর্ষণই জানান দেয়।

এখন পর্যন্ত এই দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জনমতের চাপে কয়েকজন ধরা পড়বে, কিন্তু ক্ষমতার ছায়ায় ধর্ষক তৈরির যে কারখানা, সেটা বন্ধ করা যাবে কীভাবে?

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]