ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, সংক্ষেপে টিআইবি সাংগঠনিকভাবে একটি এনজিও, কাজ করে বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বা টিআই-এর হয়ে। নানা কারণে নন্দিত ও নিন্দিত। বার্লিন থেকে টিআই জানাল, বিশ্বের ৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। সবদিকে ঢি ঢি পড়ে গেল। আওয়ামী লীগের শাসনামলে এমন একটি কলঙ্কের তিলক বাংলাদেশের ভাগ্যে জুটল? কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে, সে বছরই বাংলাদেশ এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং তালিকার নিচে একটা টীকা ছিল, যা কেউই বা কোনো গণমাধ্যম উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেনি; এমনকি টিআইবিও না। টীকায় লেখা ছিল, ‘সামগ্রিকভাবে সাতটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগৃহীত ১৪টি উৎস থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে এই সূচক তৈরি করা হয়েছে।’ টীকায় আরও লেখা ছিল, ‘বাংলাদেশের উপাত্ত শুধু তিনটি উৎস থেকে সংগৃহীত হয়েছে এবং এই উপাত্তগুলোর মধ্যে তারতম্য ব্যাপক। যদিও গড় স্কোর ০.৪ (১০-এর মধ্যে)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই স্কোরের ব্যবধান -১.৭ থেকে +৩.৮ পর্যন্ত বিস্তৃত, যা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ফলাফল গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’
তার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশে দুর্নীতি নেই। আলবত বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি আছে এবং টিআই প্রতিবছর এই ধরনের
সূচকও তৈরি করছে। একমাত্র জর্ডান ছাড়া অন্য কোনো আরব দেশ টিআইয়ের জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, থাকলে নিশ্চিতভাবে বেশ ওপরেই থাকত, এমনকি চ্যাম্পিয়নও হতে পারত। পরের বছর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন টীকা ছিল না এবং বিএনপি আমলের চার বছরই দুর্নীতির তালিকার শীর্ষে ছিল।
সম্প্রতি টিআইবি ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে। একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গত ৩০ জুন টিআইবি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকার কল্যাণে জনগণ জেনেছে। জনগণকে যা জানানো হয়েছে, তা হলো ১. নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতামূলক দুর্নীতির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভজনক পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে; ২. এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরম অনিয়ম ও দুর্নীতিগ্রস্ত; ৩. এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্টিফিকেট বিক্রয় হয় এবং তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জড়িত; ৪. সব কার্যক্রমে ট্রাস্টি বোর্ড হস্তক্ষেপ করে; ৫. শিক্ষার মান খারাপ; এবং ৬. সর্বোপরি সুশাসনের বড় অভাব।
টিআইবি দাবি করেছে, এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণপূর্বক প্রণীত একটি গুণগত ‘গবেষণা’। তারা আরও বলেছে, ‘তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ২২টি নির্বাচিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, সিন্ডিকেট সদস্য, শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তথ্য সংগৃহীত হয়েছে।’
এসব কাজে তারা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দলীয় আলোচনা; সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনের সভা ও নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয়কে পর্যবেক্ষণ করেছে। তারা এও বলেছে যে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর এই জরিপকাজ চালানো হয়েছে, তা দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাছাই করা হয়েছে এবং এই কাজ তারা ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সম্পন্ন করেছে। প্রতিবেদনে কিছু ভালো পর্যবেক্ষণ, মন্তব্য ও সুপারিশ থাকলেও তা পত্রপত্রিকায় বিন্দুমাত্র প্রতিফলিত হয়নি, বরং সংবাদটি প্রায় সংবাদপত্রে এমনভাবে প্রকাশিত হয়েছে, যাতে মনে হবে, এই মুহূর্তে দেশে উচ্চশিক্ষাঙ্গনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই খলনায়ক।
পুরো বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও উপাচার্যদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। শিক্ষামন্ত্রীর এমন উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার, কারণ তিনি বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন। সভায় সবাই বলেছেন, টিআইবির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এমন একটা ঢালাও মন্তব্যসূচক প্রতিবেদন সমগ্র খাতকে ÿক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তাঁরা এও বলেছেন, বিশেষ করে শিক্ষামন্ত্রী ও মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, টিআইবি থেকে কেউই তাঁদের অথবা তাঁদের দপ্তরের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে এই বিষয়ে কোনো আলাপ করেননি এবং প্রতিবেদনের কোনো কপিও তাঁদের কাছে প্রেরণ করেননি। সভায় এই প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং দাবি করা হয়, টিআইবি যদি ঢালাওভাবে আনীত অভিযোগগুলো প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। একই দিন প্রথম আলো কর্তৃক পরিচালিত পাঠক জরিপে ৬২ দশমিক ৪২ শতাংশ উত্তরদাতাও
এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। টিআইবি তাদের প্রতিবেদন ডাকযোগে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
এর আগে আমি প্রথম আলোতে লিখেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ার সংখ্যা কমছে। সে দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলোকে ‘ব্রিফকেস’ বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়, যেখান থেকে পাঁচ-সাত হাজার ডলার দিলে পিএইচডি ডিগ্রি পর্যন্ত পাওয়া যায়। বেশ কয়েকজন পাঠক আমার এই মন্তব্যে ÿক্ষুব্ধ হয়ে তা চ্যালেঞ্জ করেছেন। ওয়েবসাইটে গেলে তাঁরা আমার বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাবেন। ২৮ জুন থেকে ৪ জুলাইয়ে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ইকোনমিস্ট পত্রিকা যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষার হালফিল অবস্থা নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে তারা লিখেছে, ২০১২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ২ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ার সংখ্যা কমছে। ঠিক এমনই অবস্থা হয়েছিল বছর দশেক আগে যখন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে তাদের কিছু কলেজকে বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। চারদিক থেকে তীব্র প্রতিবাদের মুখে সে যাত্রায় তারা তা করা থেকে বিরত থেকেছে।
টিআইবির গবেষকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না করেও কয়েকটি প্রশ্ন তো করা যেতেই পারে। তারা ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর জরিপ চালিয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যাতে মোট বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ার ৬১ শতাংশ পড়ে। এগুলোর মধ্যে ১৮টি আছে, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ ভঙ্গ করে পরিচালিত হচ্ছে, যার বিরুদ্ধে মঞ্জুরি কমিশন ব্যবস্থা নিতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে। কারণ, এরা সবাই উচ্চ আদালতের আশ্রয় নিয়ে তাদের কর্মকাল পরিচালনা করছে। এই ধরনের মামলার সংখ্যা বর্তমানে ৪৫টি, যার মধ্যে একাধিক ফৌজদারি মামলাও আছে।
নির্বাচিত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এসব বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত কি না, তা পরিষ্কার নয়। দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স সর্বসাকল্যে ২২ বছর। এরই মধ্যে ১৭টি নিজস্ব ক্যাম্পাস কার্যক্রম পরিচালনা করছে আর ১১টি করছে আংশিকভাবে। ১৩টি ইতিমধ্যে নিজেদের জমি সংগ্রহ করেছে। এই বিষয়গুলো গণমাধ্যমে আসেনি। বিশ্বের অন্যতম সেরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডের বয়স ৪০০ বছর। অক্সফোর্ডের ৯০০। আর বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৯৪ বছরে পদার্পণ করল আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স কেবল ২২ বছর। ৪০০ বছরের বা ৯০০ বছরের পথ ২২ বছরে পাড়ি দেওয়ার কথা বললে তো হবে না।
উচ্চ টিউশন ফি নিয়ে টিআইবির বড় অভিযোগ। তারা প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়ভেদে টিউশন ফির ভিন্নতা লক্ষণীয়। বলেছে, ‘প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একক বেতন ও ফি-কাঠামো বাস্তবায়ন করতে হবে।’ এমন ব্যবস্থা দুনিয়ার কোথাও নেই। ফি নির্ভর করে প্রোগ্রামের মানের ওপর। প্রোগ্রামের মান ও সুযোগ-সুবিধা ভালো হলে ফি বেশি দিতেই হবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় আর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে মঞ্জুরি কমিশনের হিসাবমতে অন্যগুলোর মাথাপিছু পৌনঃপুনিক ব্যয় গড়ে ৭০ হাজার টাকার ওপর, যার প্রায় ৯০ শতাংশ সরকারি তহবিল থেকে ভর্তুকি হিসেবে আসে। অর্থাৎ, এগুলো জনগণের টাকা। অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকার থেকে কোনো অনুদান তো পাওয়ার প্রশ্নই আসে না, বরং যদি কোনো উদ্বৃত্ত (অপারেটিং সারপ্লাস) থাকে, তাহলে তার ওপর ১৬ শতাংশ কর দিতে হয়। এসব বিষয় টিআইবির প্রতিবেদনে স্থান পেলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ত। টিআইবি সুপারিশ করেছে, অর্থ কমিটিতে সরকারি কোনো প্রতিনিধি না থাকায় অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতার অভাব আছে। সরকারি প্রতিনিধি থাকলেই যে সবকিছু স্বচ্ছ হবে, তার গ্যারান্টি কী? দেখা গেছে, যেসব কমিটিতে সরকারি প্রতিনিধি আছেন, তাঁরা কদাচিৎ এসব কমিটির সভায় উপস্থিত থাকেন।
টিআইবি এই সেক্টরে ভয়াবহ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, উপঢৌকন গ্রহণ, বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে যোগসাজশ, না পড়িয়ে বা ক্লাস না নিয়ে অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রি, উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, ট্রেজারার নিয়োগে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ঘুষ প্রদান, যার মধ্যে মন্ত্রণালয় ও মঞ্জুরি কমিশনের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি বিষয়ে ঢালাও মন্তব্য করেছে। টিআইবির এই প্রতিবেদনের ফলে অথবা যেটুকু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তার কারণে একধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। দুজন মেধাবী ছাত্র এসে আমার কাছে জানতে চেয়েছে, তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো পাস করেছে। তারা এখন বিদেশে পড়াশোনার জন্য আবেদন করতে চায়, তবে টিআইবির এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর তারা শঙ্কিত। জনস্বার্থে টিআইবির উচিত সব ধরনের সন্দেহ ও বিতর্ক দূর করা, তাতে সবাই লাভবান হবে। কেউ বলবে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম নেই, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো নয়ই। সেসব অনিয়ম দূর করার জন্য মন্ত্রণালয় ও মঞ্জুরি কমিশন চেষ্টা করছে, তবে তাদেরও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়। তাই, যেকোনো বিষয়ে ঢালাও মন্তব্য করলে তা অনেক ÿক্ষতির কারণ হতে পারে। বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করেছে, তাকে আঁতুড়ঘরেই গলা টিপে হত্যা করাটা সমীচীন নয়।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।