‘গরু-ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ’—এ শিরোনামে ২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী অনেকের কাছে এটি ট্রলের বিষয় হয়ে ওঠে। গত এক দশকে মিঠাপানির মাছ, ইলিশ, গরু ও খাসির মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। এগুলো উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন প্রথম সারির একটি দেশ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ সাফল্য বেশ ফলাও করে প্রচার করে, উদ্যাপন করে। কিন্তু যে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হয়, সেটি হলো মাছ-গরু-ছাগল উৎপাদনে প্রথম দিককার একটা দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাজার থেকে গরু, খাসি, ইলিশ মাছ কেনার সামর্থ্য কত শতাংশ মানুষের আছে?
৯ এপ্রিল প্রথম আলো অনলাইনে ‘সন্তানদের গরুর মাংস খাওয়াইতে মন চায়, কিন্তু সামর্থ্য হয় না’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। পবিত্র রমজান উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে করে গরু, খাসি ও মুরগির মাংস এবং দুধ ও ডিম বিক্রির উদ্যোগ নেয়। সেখানে ঢাকার বাজারদর থেকে কিছুটা সুলভ মূল্যে সেগুলো বিক্রি হয়েছে। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যাচ্ছে, ‘মোহাম্মদপুরে এ রকমই একটা ভ্রাম্যমাণ গাড়ির পেছনে “গরুর মাংসের কেজি ৫৫০ টাকা” লেখা প্ল্যাকার্ড এবং মানুষের জটলা দেখে রিকশাচালক মো. আলমগীর সেখানে থেমে যান। এরপর বিক্রেতার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হলেন, সত্যিই গরুর মাংস এ দামে বিক্রি হচ্ছে কি না। পকেটে হাত দিয়ে মো. আলমগীর বিক্রেতাকে বললেন, আজ টাকা নেই সঙ্গে। কাল যদি বিক্রেতা আসেন, তাহলে তিনি কিনতে আসবেন।’
বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা যদি এমন হতো, যদি কেউ তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী গরু বা খাসির ২৫০ গ্রাম মাংস কিংবা ৪ টুকরা ইলিশ কিনতে পারতেন, তাহলে আরও কয়েক কোটি মানুষ নিজ আয়ের ওপর দাঁড়িয়েই বাজারে প্রবেশাধিকার পেতেন। এর বদলে সমাজের কয়েক শতাংশ উচ্চ আয়ের মানুষের জন্য বাজারব্যবস্থা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এটা কোনো অর্থেই গণতান্ত্রিক চর্চা নয়। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের ২৫০ বছরের ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে স্বাধীনতার ৫১ বছরেও আমরা কেন বেরিয়ে আসতে পারিনি?
প্রথম আলোর প্রতিবেদক রিকশাচালক আলমগীরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে মেয়েটা বলছে গরুর মাংস খাবে। ও ক্লাস এইটে পড়ে। রিকশা চালিয়ে এক কেজি গরুর মাংস কিনলে সারা দিনের কামাই শেষ। প্রতিদিনের কামাই দিয়ে তেল-চাল কিনতে হয়।’ প্রতিবেদনটি প্রথম আলোয় প্রকাশ হওয়ার পর কয়েকজন আলমগীরকে সহায়তা করেন। সে টাকা দিয়ে এক কেজি গরুর মাংস, পোলাওয়ের চাল এক কেজি ও মসলা কেনেন। অনেক দিন পর আলমগীরের ঘর খুশিতে ভরে ওঠে। দুই সন্তান, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে থাকেন মোহাম্মদপুরের লিমিটেড এলাকায়। কয়েক বছর আগে স্ট্রোক করেন। তাঁর একটি খাবারের হোটেল ছিল।
করোনা মহামারি ও অসুস্থতার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে চটপটির দোকান দেন। কিন্তু পোষাতে না পেরে তিনি এখন রিকশা চালান। মাসে ১৫ হাজার টাকার মতো আয় করেন। স্ত্রী একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করেন। দুজনের আয়েও কোনোরকমে খেয়েপরে চলে তাঁদের সংসার। চাল-ডাল-তেল-নুন-আনাজপাতি কিনতে, বাসাভাড়া দিতে কিংবা বাচ্চাদের স্কুলের খরচ জোটাতেই চলে যায় পুরো আয়। ভালোমন্দ বা বাচ্চাদের মুখে প্রাণিজ আমিষ তুলে দেওয়ার সামর্থ্য তাঁদের কোথায়?
শুধু আলমগীর নন, বাংলাদেশে কত শতাংশ মানুষের প্রয়োজনীয় আমিষ কেনার মতো সামর্থ্য আছে? শুনতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু রূঢ় সত্য হচ্ছে দেশে অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা গরু বা খাসির মতো প্রাণিজ আমিষ খেতে পারেন বছরে একবারই, সেটা কোরবানি ঈদে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাগলের সংখ্যা, মাংস ও দুধ উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। এ খাতে শীর্ষে রয়েছে ভারত ও চীন। বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আর ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। সামগ্রিকভাবে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ হচ্ছে ভারত ও চীন। আর গরু-ছাগল-মহিষ-ভেড়া মিলিয়ে গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ১২তম। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়। সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়।
উৎপাদনের এই অগ্রগতির চিত্রের বিপরীত চিত্রটাও জানা যাচ্ছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য থেকে। সেটি হলো, মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের পেছনের সারির একটি দেশ। বিশ্বে প্রোটিন গ্রহণের বার্ষিক গড় যেখানে ৪৮ দশমিক ২ কেজি, সেখানে ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা মাত্র ৪ কেজি। বৈশ্বিক গড় খাদ্যের গুণগত মান ও খাদ্য নিরাপত্তার বিচারে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার যে সূচক, তাতে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৭তম। বাংলাদেশে বিদ্যমান তীব্র আয়বৈষম্য এ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য সুষম খাদ্য প্রয়োজন। আর সুষম খাদ্যের জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ১ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন। শিশুদের জন্য প্রয়োজন প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ২ গ্রাম। কিন্তু প্রোটিন গ্রহণের বার্ষিক গড় যেখানে ৪ কেজি, সেখানে ঘাটতিটা তো দুস্তর। আবার মাথাপিছু হিসাবে একটা তো শুভংকরের ফাঁকি থেকেই যায়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গরু-ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণতার যতই বিজ্ঞাপন দিক না কেন, বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় সেটা অপ্রতুল। আবার যতটুকু উৎপাদিত হয়, তা-ও উচ্চমূল্যের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরেই তা থেকে যায়। বাজার ব্যবস্থাপনা ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণেও ইলিশ মাছ কিংবা অন্যান্য প্রাণিজ প্রোটিন কেনার ক্ষেত্রে বাজারে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত হন সাধারণ মানুষ। প্রশ্ন হচ্ছে, একজন আলমগীরকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের মুখে মাংস তুলে দিতে কেন অন্যের দান বা সহযোগিতা নিতে হবে? তিনি ও তাঁর স্ত্রী যে আয় করেন, তা থেকেই বাজার থেকে মাংস কিনতে পারবেন না কেন? তাঁকে কেন এক কেজি মাংস কিনতে বাধ্য করা হবে? বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা যদি এমন হতো, যদি কেউ তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী গরু বা খাসির ২৫০ গ্রাম মাংস কিংবা ৪ টুকরা ইলিশ কিনতে পারতেন, তাহলে আরও কয়েক কোটি মানুষ নিজ আয়ের ওপর দাঁড়িয়েই বাজারে প্রবেশাধিকার পেতেন। এর বদলে সমাজের কয়েক শতাংশ উচ্চ আয়ের মানুষের জন্য বাজারব্যবস্থা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এটা কোনো অর্থেই গণতান্ত্রিক চর্চা নয়। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের ২৫০ বছরের ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে স্বাধীনতার ৫১ বছরেও আমরা কেন বেরিয়ে আসতে পারিনি?
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক