সৃষ্টির সূচনা থেকেই প্রাণীর প্রধানতম তাগিদ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। খাদ্যশৃঙ্খল গড়ে তুলতে গিয়েই মানুষ ভেবেছে তার অন্য সব চাহিদার কথা। সভ্যতার শুরু থেকেই যত আন্দোলন-সংগ্রাম, তার মূলে কাজ করেছে মানুষের প্রধানতম স্বার্থ—খাদ্য। তাই যুগে যুগে অধিকার আদায়, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনসহ সব সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল খেয়ে-পরে নিষ্কণ্টক জীবনযাপনের স্বপ্ন। বহু আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে এই বাংলার মানুষ তখন স্বাধীনতার কঠিন তাগিদ অনুভব করে, যখন তার খাদ্য গ্রাস করে অন্যরা, যখন তার নিজস্ব অর্জন আর অস্তিত্ব লুটে নিতে চায় অন্য কেউ, যখন তার অস্তিত্ব হয়ে পড়ে বিপন্ন। দীর্ঘ ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও ২৪ বছরের পাকিস্তানি শোষণ বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রাম অনিবার্য করে তোলে। আর ঐতিহ্যগতভাবে কৃষক পরিবারেরই সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন হাল ধরেন সাত কোটি মানুষের।
আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের বীর সেনানী যাঁরা, তাঁদের কেউ কৃষকের সন্তান, কেউ কৃষক। কেউ শহীদ হয়েছেন দেশমাতৃকার জন্য, আর কেউ টিকে আছেন স্বাধীনতার স্বপ্ন-সাধ মিলিয়ে দেখার জন্য। আসলে কি হিসাব মেলাতে পারেন তাঁরা? এই একই প্রশ্ন নিয়ে গত এক দশকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুুক্তিযোদ্ধা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। কৃষক বারবারই যেন হোঁচট খেয়েছেন স্বপ্ন আর বাস্তবতাকে মেলাতে গিয়ে। তাঁদের স্বাধীনতার স্বপ্ন-সাধ বারবার ধুলায় মিশেছে। এমন উদাহরণ আজ অসংখ্য। একাত্তরের যে কৃষকের সহায়-সম্পত্তিসহ অনেক কিছু ছিল, আজ তিনি ভূমিহীন, হতদরিদ্র। রাষ্ট্রব্যবস্থা জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তার কথা ভেবেই কৃষি উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেয়, কিন্তু গুরুত্ব পায় না গ্রামীণ কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নের ইস্যু।
সঠিক পরিকল্পনা ও সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক মতানৈক্য, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনসহ দেশের সবকিছুতেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হতে হয় কৃষককে। রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান শক্তি কৃষি উৎপাদন তথা খাদ্যনিরাপত্তা হলেও সেই শক্তির পেছনের নিয়ামক যে কৃষক শ্রেণী, তারা বরাবরই থেকে যায় অবহেলিত। মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বাঙালি জাতিকে শোকে স্তব্ধ করে দেয়। কারণ, এই দিনেই হারিয়ে যায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানগুলো। যাঁরা নিজেদের অর্জন ও অধ্যয়ন দিয়ে পৌঁছেছিলেন সমাজের সুউচ্চ চূড়ায়। তাঁরা সব সময় চেয়েছেন ক্ষুধামুক্ত, চিন্তার দারিদ্র্যমুক্ত এবং সমৃদ্ধ দেশ। যাঁরা নিজের জীবন দিয়ে পূরণ করে গেছেন স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ। তাঁরা যেন বলে গেছেন, আমরা চলে যাচ্ছি, কিন্তু থেকে যাচ্ছে আমাদের আত্মবিশ্বাস আর ভেতরের শক্তি।
এ মুহূর্তে মনে পড়ছে কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তি ও ঘটনার কথা। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপ্লবী কৃষকনেতা লির কথা কি আপনাদের মনে আছে? যিনি ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বিবেচনায় সে বছর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কৃষক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিবাদ ছিল কৃষককে বঞ্চনার বিরুদ্ধে। ২০০৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মেক্সিকোর কানকুনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে হাজারো মানুষ ও গণমাধ্যমের সামনে আত্মাহুতি দেন লি। সে সময় লি বলেছিলেন, সংগ্রামী আত্মার মৃত্যু নেই। লির ওই আত্মত্যাগ সারা বিশ্বের কৃষককে শেখায়, অধিকার আদায়ের জন্য প্রকাশ্য প্রতিবাদের বিকল্প নেই।
বিপ্লবী হো চি মিনের দেশ ভিয়েতনামে একটি নীতিই কৃষিকে উঠিয়ে দেয় উন্নয়নের চূড়ান্ত শিখরে। বিপুলভাবে বাড়িয়ে দেয় খাদ্য উৎপাদন। এই নীতিই হচ্ছে ভূমি সংস্কার নীতি, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা যায় ‘দোই মোই’। অর্থাৎ ১৯৮৮ সাল থেকে ভিয়েতনাম সংঘবদ্ধ কৃষি আবাদের সমাজতান্ত্রিক নীতি থেকে সরে দাঁড়ায়। অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যক্তির ভূমি মালিকানা দিয়ে দেওয়ার কারণে কৃষক নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখার যেমন সুযোগ পান, একইভাবে প্রথম বছরেই খাদ্যঘাটতির দেশটি পরিণত হয় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম খাদ্য রপ্তানির দেশে।
ড. নরম্যান বরলোগ কিংবা ড. সয়ামি নাথানের মতো বিজ্ঞানীরা এই পৃথিবীবাসীকে খাদ্যের প্রশ্নে নিশ্চিন্ত করেছেন ১৯৬০-এর দশকে। তাঁদের ডাক দেওয়া সবুজ বিপ্লব আজকের দিনেও যেন অনন্য এক মন্ত্র। বিখ্যাত চিকিৎসক দম্পতির ছেলে ড. সয়ামি নাথানের হওয়ার কথা ছিল ডাক্তার। কিন্তু ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষ বা বেঙ্গল ফেমিন তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়া যায়—এমন কোনো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করার। পরে তিনিই হয়ে ওঠেন পৃথিবীর বিখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী। ৮৮ বছর বয়সেও ড. সয়ামি নাথান ভাবেন এই বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে।
সারা বিশ্বে আজকের খাদ্যবিপ্লবের পেছনে অবদান রয়েছে মাও সে তুংয়ের দেশ চীনের। চীনের হুনান প্রদেশের চাংসায় মাও সে তুংয়ের জন্মভিটায় আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল ২০০৬ সালে। কৃষির মতো মহৎ পেশা ও চেতনাই যে প্রকৃত বিপ্লবীর জন্ম দেয়, ওই বাস্তুভিটা সে-কথাই মনে করিয়ে দেয়। মনে হয়, কৃষক পরিবারের সন্তানই তো হতে পারে জাতির মহানায়ক।
চীনের আরেক সূর্যসন্তান ইয়ান লং পিং, যিনি হাইব্রিড ধানের জনক হিসেবে বিশ্বময় পরিচিত। অসামান্য কীর্তির কারণে চীন যাঁকে দেবতাজ্ঞান করে, সেই ইয়ান লং পিং ১৯৩১ সালে জন্মেছিলেন দরিদ্র কৃষক পরিবারে। মাটির ঋণ শোধ করতে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল চীনকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পাশাপাশি সারা বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তায় যোগ করেন অনন্য এক শক্তি। তাঁর আবিষ্কৃত হাইব্রিড ধান আজ আবাদ হচ্ছে বিশ্বের সব কটি ধান উৎপাদনকারী দেশে।
আমাদের দেশে সবুজ বিপ্লবের বাতাস পৌঁছে যায় ষাটের দশকেই। আর খাদ্যনিরাপত্তার ভবিষ্যৎ পথকে মসৃণ করার জন্য স্বাধীনতার আগে ও পরে আত্মনিয়োগ করেন এই মাটির বড় বড় সংগ্রামী নায়ক। মাটির যোদ্ধারা। প্রয়াত অধ্যাপক হাসানুজ্জামান, ড. কাজী এম বদরুদ্দোজাসহ বহুসংখ্যক বিজ্ঞানী, সম্প্রসারক মগ্ন হন এ দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার নিরন্তর প্রয়াসে। তাঁদের সেই অমূল্য অবদানের স্বীকৃতিই স্বাধীনতার ৪২ বছরে আমাদের সবচেয়ে গর্বের গল্প। একাত্তরে যখন সাত কোটি মানুষ, তখন এ দেশে যে জমিতে উৎপাদিত হতো মাত্র এক কোটি টন খাদ্যশস্য, ২০ লাখ টন আমদানি করতে হতো। আজ ১৬ কোটিরও বেশি মানুষ, খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় সোয়া তিন কোটি টন। এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে?
কয়েক দিন আগে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। বিশ্বের মানুষের শান্তি-নিরাপত্তার পাশাপাশি গত ৩০ বছর সারা বিশ্বের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই মহান নেতার ছিল অসামান্য অবদান। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক জোসে গ্রাজিয়ানো দ্য সিলভা এক শোকবাণীতে বলেছেন, ম্যান্ডেলা বিশ্বাস করতেন, ক্ষুধার্ত পুরুষ, নারী বা শিশু কখনো স্বাধীন নয়। তিনি মনে করতেন, ক্ষুধা দূর করা মানে শুধু খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রশ্ন নয়, ক্ষুধা দূর করা মানে সেই রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা পূরণ করা, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ দেশের সম্পদের উৎস ও সর্বোচ্চ সেবার কাছে যেতে পারবে। যার মাধ্যমে সে সহজেই জোগাড় করতে পারবে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য।
কৃষক জমি কর্ষণ করেন, ফসল ফলান। আমাদের মুখে খাদ্য তুলে দেন। দেশ ও দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে তাঁর ভূমিকাই সবার আগে। একজন কৃষকের জীবন মানেই একটি সংগ্রামের ইতিহাস। সে ইতিহাসকে আজকের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সুশীল সমাজ, নতুন প্রজন্ম থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক কীভাবে মূল্যায়ন করছেন, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার কৃষিকে খাটো করে দেখছি মানে—স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী বীর শহীদদের অবমাননা করছি। দেশকে যাঁরা প্রতিদিন স্বপ্নবান করে তোলেন—অনেক অশান্তি আর নৈরাজ্যের পরও শেষ শক্তিটুকু, আশ্রয়ের জায়গাটুকু টিকিয়ে রাখেন—সেই মাটির মানুষের দিকে তাকিয়েই মানবতাবাদী নেতারা বিপ্লব গড়ে তোলেন, বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন নতুন কিছু, শিক্ষাবিদ-সমাজকর্মীরা আঁকেন পরিবর্তনের রূপরেখা। আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন সেই পরিবর্তনেরই একেকজন নায়ক। তাঁদের সবার প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা একাত্তরের সব শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি।
শাইখ সিরাজ: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই।
[email protected]