আমাদের ছোটবেলায় যে কিশোর গ্যাংটি হিরো হয়ে উঠেছিল, তার নাম ‘তিন গোয়েন্দা’। সেবা প্রকাশনীর কিশোর থ্রিলার সিরিজটি অনেক পড়ুয়ারই থ্রিলের তৃষ্ণা মেটাত। সেই সময়ে আরও বড়দের নায়ক ছিল মাসুদ রানা, দস্যু বনহুর কিংবা হুমায়ূন আহমেদের বাকের ভাইয়ের মতো নৈতিক বীরেরা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক লড়াইয়ের এই প্রেরণা হয়তো মুক্তিযুদ্ধ থেকেই এসেছিল। উঠতি বয়সীদের সামনে তখন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রোল মডেল ছিল। নব্বইয়ের দশকে আমরা যখন সদ্য তরুণ, তখন রাজধানী থেকে জেলা শহর অবধি অজস্র গানের দলের ব্যান্ড গড়ে উঠেছিল।
সবাই নয়, কিন্তু যারা আলাদা হতে চাইত, পরিবারের বড়দের দেখিয়ে দেওয়া পথের বাইরে নিজস্ব কিছু করার ইগো যাদের জোরালো, তারা হয় ছাত্ররাজনীতি করত, নয়তো ব্যান্ড কালচারে ঢুকে যেত। আর ছিল ফুটবল কিংবা ক্রিকেট ক্লাব। ছিল শীতকালীন ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও ছিল একই রকমের। উঠতি বয়সী সন্ত্রাসীদের তখন হাতে গোনা যেত।
কিন্তু বাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, প্রযুক্তিকেন্দ্রিক জীবন ও বিনোদন, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, পারিবারিক বন্ধন আলগা হওয়া, বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার তালে তালে আমরা দেখলাম, রাজনীতি ও অর্থনীতির অপরাধীকরণ। প্রবল ইগোকেন্দ্রিক দাপুটে নেতারা রাজনীতির লাগাম হাতে নিলেন। অপরাধ, রাজনীতি এবং কালোটাকার তিন টিক্কা সমাজ-সভ্যতা-ন্যায়কে টেক্কা দিল। মাফিয়াতান্ত্রিক রাজনীতির অজস্র চক্র গড়ে উঠল, এদের মধ্যে চলল নেটওয়ার্কিং এবং নৃশংস প্রতিযোগিতা।
কিশোর চক্রগুলোর গ্যাংয়ে রূপান্তরিত হওয়া আর বাংলাদেশে মাফিয়াতন্ত্রের বিস্তার একই তালে ঘটল। দাপট, দমন, ইগো প্রদর্শন হলো নতুন ‘হিরো’দের ব্র্যান্ডমার্ক। এদের দরকার ছিল অনুগত পদাতিক, খুদে মাস্তান। অন্যদিকে সমাজ-পরিবার-রাষ্ট্রের প্রতি হতাশ কিশোরদের দরকার ছিল ‘ব্যাটা’ হয়ে ওঠার সুযোগ, যেখানে অস্ত্র থাকবে, নেশা থাকবে, টাকা থাকবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিশোর গ্যাংদের ওপর প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এই বক্তব্য সমর্থন করে। দেখা যায় এলাকার রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা তাঁদের মাদক ও দাপটের কারবারে কিশোর গ্যাংগুলোকে ব্যবহার করে। বিনিময়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা পায় এলাকার কিশোরদের সমীহ, অনেক কিশোরীর আকর্ষণ এবং উঠতি বয়সের দরকারি আত্মবিশ্বাস। অস্ত্র ও নেশার আকর্ষণ তো মেটেই।
সুতরাং বাংলাদেশে অপরাধ ও সহিংসতার যে সামাজিক জলবায়ু ছিল, কিশোর গ্যাংগুলো তারই অশান্ত বর্ণালি। এটা একটা প্রজন্মগত সমস্যা। এর সঙ্গে জড়িত মাফিয়া রাজনীতি, মাদক, অস্ত্র, সন্ত্রাস এবং ব্যাটাগিরি সংস্কৃতি। কিন্তু বাকি সব বাদ দিয়ে তাদের ‘তুই অপরাধী রে’ বলে দাগিয়ে দেওয়ায় কেবল পুলিশি সমাধানেরই ঝোঁক বেড়েছে। অভিভাবকেরাও মনে করেছেন কিছুটা শাস্তি ও পুলিশি শাসন তাঁদের সন্তানদের বখে যাওয়া থেকে বাঁচাবে। কিন্তু সমস্যাটার জন্ম যখন পারিবারিক আবহে তথা সমাজে, তখন সমাজতাত্ত্বিক সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি থাকার দরকার ছিল। পুলিশের হাতে ক্ষমতা দিয়ে অভিভাবকেরা নিজেদের ব্যর্থতা ও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। কিশোরেরা যখন পরিবারে অসন্তুষ্ট বা বঞ্চিত, যখন তাদের মনের চাহিদার দিকে উদাসীন থেকে বাবা-মায়েরা তাদের কেবল ভবিষ্যতের উন্নত উপার্জনকারী হিসেবে গড়ে তোলায় ব্যস্ত, তারা যখন পরিবার বা সমাজ থেকে অনুকরণীয় কিছু না পায়, তখন তাদের মনে প্রশ্ন জাগে: কে আমি, কী আমার লক্ষ্য?
গবেষণা বলছে, সাধারণত ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেরা কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখায়। তাদের যারা কাছে টানে, তারা বোঝায়: দাপট নিয়ে চলবা, তাহলে সমীহ পাবা, ঝামেলার সমাধান করবা গায়ের জোরে, অস্ত্রের জোরে। ওই বয়সের লক্ষণই হলো, মা-বাবা-ভাইবোনের বাইরে কিছু করে দেখানো, কিছু বন্ধু বানানো, সারাক্ষণ উত্তেজনা ও রোমাঞ্চ খোঁজা। কেবল ভিডিও গেমের রোমাঞ্চে তাদের মন ভরে না। আত্মবিশ্বাসের টানাপোড়েনও ওই টিন বয়সেরই বৈশিষ্ট্য। পরিবারকে যাদের নিরানন্দ মনে হয়, বাইরের বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ-উত্তেজনায় তারাই ঝোঁকে বেশি।
আর এখন তো স্কুল বন্ধ প্রায় দেড় বছর। বড় গ্রুপের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ নাই। কেবল হাতে রইল মোবাইল, তার ভেতরের টিকটক, ইউটিউব, ফেসবুক, লাইকির মতো ওয়েবসাইট। উঠতি বয়সীদের বাড়তি হরমোন খরচের আর তো কোনো উপায় খোলা নেই। খেলার মাঠ নেই, লাইব্রেরি নেই, টুর্নামেন্ট নেই, ক্লাবগুলো মাফিয়াদের দখলে। ভালো ছেলে হয়ে থাকলে মাথা নিচু করে চলতে হয়, মেয়েরা পাত্তা দেয় না, বড় ভাইয়েরা ফিরেও তাকায় না। গ্যাংবাজি শেয়ার ব্যবসার মতো—যেদিকে ফায়দা, সবাই সেখানে ছুটবে। অনেক কিশোর-তরুণ সুশীল বালক হওয়ার চেয়ে দুষ্ট হিরো হওয়াতেই আনন্দ পাবে। কেননা, আমাদের সমাজে মন্দ বীরদেরই সংবর্ধনা দেওয়া হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারাই বড় নেতা, প্রশাসক, ব্যবসায়ী কিংবা সেলিব্রিটি হন। গ্যাংয়ের সদস্য হওয়া এভাবে হয়ে ওঠে এক কাঙ্ক্ষিত পরিচয়। কে আমি, কী আমার লক্ষ্য, কী আমার আদর্শ; এই কিশোরসুলভ প্রশ্নের এটাই তার বিকল্প জবাব। কারণ, এই জবাবটাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও সুলভ।
কিশোর গ্যাংগুলো রাষ্ট্রের কাঠামোগত সন্ত্রাসের প্রতিবিম্ব। ‘গ্যাং-কালচার’ ভয়ের শাসনেরই প্রতিধ্বনি। তারা হয়ে ওঠে বড় মাফিয়াদের অনুকৃতি বা মিনিয়েচার। দমন ও সংশোধনের কাজ জারি থাকুক। কিন্তু এই গভীর সামাজিক ও প্রজন্মগত ব্যাধির নিরাময় পুলিশি পন্থায় হওয়ার নয়।
সমাজ নবীনদের সামনে যে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য দেয়, সেটা পূরণের পথে বাধা ও বৈষম্য দেয় তার চেয়েও বেশি। গ্যাংবাজি সন্ত্রাস সেসব বাধা ডিঙিয়ে সুযোগের অভাব কাটিয়ে বন্ধু, বিলাস ও বলশালী মর্যাদা উপভোগের রাস্তা খুলে দেয়। যখন সমাজ নেই, তখন রাস্তার গ্যাং তার বিকল্প সমাজ। মারপিট তার জমাট হতাশা নিষ্কাশনের চ্যানেল। হয়তো এই হতাশার জন্ম তার পরিবারের অবস্থা নিয়েই।
কিশোর গ্যাংগুলো রাষ্ট্রের কাঠামোগত সন্ত্রাসের প্রতিবিম্ব। ‘গ্যাং-কালচার’ ভয়ের শাসনেরই প্রতিধ্বনি। তারা হয়ে ওঠে বড় মাফিয়াদের অনুকৃতি বা মিনিয়েচার। দমন ও সংশোধনের কাজ জারি থাকুক। কিন্তু এই গভীর সামাজিক ও প্রজন্মগত ব্যাধির নিরাময় পুলিশি পন্থায় হওয়ার নয়। পুলিশের কাজ লক্ষণ নিয়ে। সমস্যার উৎস নির্মূল সমাজ-রাষ্ট্র, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক-রাজনৈতিক নেতাদের কাজ। কিশোর গ্যাংয়ের বিগ ব্রাদারদের ক্ষমতার পাইপলাইন কাটা পড়লেই গ্যাংবাজির প্রতাপ তলানিতে নেমে আসবে। সব জেনেও তাহলে গণহারে কিশোরদের দৌড়ানির ওপর রাখার কারণ কী? যে কিশোরেরা সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনে দেশের বাতিঘর হয়ে উঠেছিল, আজ কেন তাদের এমন ‘অপরাধী’ চিত্রায়ণ?
সমাধানের উদাহরণটা এবার দেওয়া যাক। ম্যানচেস্টার ইংল্যান্ডের এক শিল্পশ্রমিকের শহর। ১৯ শতকের মাঝামাঝি এই শহরে তরুণ গ্যাংগুলোর ছোরা-সন্ত্রাসের মহামারি দেখা যায়। ১৮৯০ সালের দিকে শহরটির কিছু দূরদর্শী মানুষ একটা বুদ্ধি করলেন। তাঁরা শহরজুড়ে শ্রমিক যুবকদের ক্লাব তৈরি করে বস্তিবাসী যুবকদের খেলা ও বিনোদনের সুযোগ করে দিলেন। তরুণ বয়সের গরম রক্ত সুস্থ খাতে বয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে মাস্তানি ছেড়ে দিল। মাস্তানির উন্মাদনার জায়গা নিল ফুটবল ‘উন্মাদনা’। সে সময়ই ওই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাব। বাকিটা ইতিহাস।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।