কাঠগড়ায় কবি এবং 'হাম দেখেঙ্গে'র আওয়াজ
১৯৮৫ সালের ঘটনা। লাহোর স্টেডিয়ামে তৈরি মঞ্চে ধীরে ধীরে উঠে এলেন ইকবাল বানো। তাঁর পরনে কালো শাড়ি! এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘পূজারিণী’ কবিতার শ্রীমতী; চরম বুদ্ধ-বিরোধী রাজা অজাতশত্রুর নিষেধ অমান্য করে, মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে যে স্তূপে অর্ঘ্য সাজাতে চলেছেন।
সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউল হক পাকিস্তানের নারীদের জন্য ‘হিন্দুয়ানি পোশাক’ শাড়ি পরা নিষিদ্ধ করেছিলেন। নিষিদ্ধ করেছেন বিখ্যাত প্রগতিবাদী উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের গান বা কবিতার চর্চা। সামরিক শাসকের সেই ফরমানকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ৫০ বছরের এক সাহসী গজলশিল্পী ইকবাল বানো মঞ্চে উঠলেন শাড়ি পরে। তিনি গাইবেন সেই নিষিদ্ধ কবি ফয়েজের গান, যিনি মারা গেছেন এক বছর আগে। হাজার হাজার দর্শকপূর্ণ স্টেডিয়ামে দর্শকের উল্লাসধ্বনির মধ্যে ইকবাল বানো গেয়ে উঠলেন,
হাম দেখেঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে
লাযিম হ্যায় কি হাম ভি দেখেঙ্গে;
আমরা দেখব, আমরা দেখব
নিশ্চিত জানি, আমরাও দেখব;
এই গান সব স্বৈরাচারীর নিশ্চিত পতনের এক সদর্প ঘোষণা। সব দেশের শাসিত -শোষিত মজলুম জনগণের জন্য এক আশা-জাগানিয়া গান। আমাদের চোখের সামনেই স্বৈরাচারের পতন ঘটবে। অত্যাচার নির্মমতার পাহাড় তুলার মতো উড়ে যাবে। শাসকদের মাথার ওপর আকাশে বিজলি চমকাবে। একপর্যায়ে ইকবাল বানোর চড়া স্বরে যেন শোনা গেল স্লোগানের দৃঢ়তা:
স্ব তাজ উছালে জায়েঙ্গে
স্ব তখ্ত গিরায়ে জায়েঙ্গে
সকল মুকুট ছুড়ে ফেলা হবে
সকল সিংহাসন গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
৫০ হাজার দর্শকের স্টেডিয়াম উন্মত্ত হয়ে উঠল। মুহুর্মুহু স্লোগান উঠতে লাগল, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।
২
অরুন্ধতী রায়ের লেখা পড়েই আমি ইকবাল বানোর এই গান সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারি। অরুন্ধতী রায় গোপনে ভারতের ছত্তিশগড় এলাকার জঙ্গলে সশস্ত্র সংগ্রামরত ‘নকশালি’ আদিবাসীদের সঙ্গে থেকেছিলেন কয়েক দিন। সেই দুঃসাহসী অভিজ্ঞতার বর্ণনা তিনি লিখেছিলেন ভারতের ‘আউটলুক’ ম্যাগাজিনে। ভয়াবহ সেই অভিযানে তিনি সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর আইপ্যাড, যাতে অন্যান্য গানের সঙ্গে ছিল ইকবাল বানোর কণ্ঠে গাওয়া ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের সেই বিখ্যাত গান ‘হাম দেখেঙ্গে’। পুলিশের তাড়া খেয়ে জঙ্গলে পালানো, পড়ে মার খেয়ে খেয়ে রুখে দাঁড়ানো সেই আদিবাসীরাও তাদের স্বপ্নের প্রতিধ্বনি শোনে সেই গানে। ইকবাল বানোর কণ্ঠে বিখ্যাত হওয়া এই গানটির অডিও ইউটিউবে পাওয়া যায়। (https://www.youtube.com/watch?v=dxtgsq5oVy4) ।
৩
সম্প্রতি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের এই ‘হাম দেখেঙ্গে’ গানটি হিন্দু ধর্মানুভূতির জন্য আপত্তিকর কি না, তা দেখার জন্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি), কানপুর একটি কমিটি করেছে! গত ১৭ ডিসেম্বর আইআইটি, কানপুরের ছাত্রছাত্রীরা ভারতের বিতর্কিত সিটিজেনশিপ (এমেন্ডমেন্ট) অ্যাক্টের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করেন। তাঁরা ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের বিখ্যাত ‘হাম দেখেঙ্গে’ গান গেয়ে গেয়ে মিছিল করেছিলেন। একজন শিক্ষক অভিযোগ তুলেছেন, এই গান নাকি অন্যদের অর্থাৎ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে! এই হাস্যকর অভিযোগ আইআইটি কর্তৃপক্ষ আমলে নিয়ে এই কমিটি গঠন করেছে। এই ঘটনায় ভারতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষকের সাংস্কৃতিক মান সম্পর্কে যেমন একটি ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি বোঝা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকলে কোনো উচ্চাঙ্গের শিল্পের মর্ম অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৪
জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হটিয়ে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতা দখল করার পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক পাকিস্তানকে ইসলামীকরণের উদ্যোগ নেন। সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক অধিকার খর্ব করে হরেক রকম কালাকানুন জারি করা হয়। দেশ থেকে হিন্দু সংস্কৃতির, অনৈসলামিক সংস্কৃতির প্রভাব নির্মূল করার জন্যও ফরমান জারি করা হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে ১৯৭৯ সালে মার্ক্সবাদী কবি ফয়েজ আহমেদর ফয়েজের ‘হাম দেখেঙ্গে’ নামের এই নাজম বা বিশেষ ঢংয়ের কবিতাটি লিখেন। জিয়াউল হকের রোষানলে পড়ে উর্দু ভাষার এই অসাধারণ কবিকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল।
পরবর্তী আলোচনার সুবিধার্থে ‘হাম দেখেঙ্গে’ কবিতাটি ও তার অনুবাদ (আক্ষরিক) উদ্ধৃত করছি:
হাম দেখেঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে
লাযিম হ্যায় কি হাম ভি দেখেঙ্গে;
ওহ্ দিন কে জিস কা ওয়াদা হ্যায়
জো লহু-ই-আযলমে লিখ্খা হ্যায়
হাম দেখেঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে
আমরা দেখব, আমরা দেখব
নিশ্চিত জানি, আমরাও দেখব;
সেই দিন, যার প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে
ভাগ্যলিপিতে যা লিখা হয়েছে,
আমরা দেখব, আমরা দেখব
জব যুল্ম-ও-সিতাম কে কোহ-এ-গারান
রু-ঈ কি তারাহ উড় যায়েঙ্গে।
হাম মেহকুমন কে পাও তলে
ইয়ে ধর্ত্রি ধর্ ধর্ ধারকেগি
যেদিন নির্যাতন ও নির্মমতার পাহাড়
তুলার মতো উড়ে যাবে
আমাদের মতো শাসিতদের পদভারে
ধরিত্রীর হৃদয় ধরফর করে উঠবে
আওর আহল-এ-হাকাম কে স্র ওপ্র
যব্ বিজ্লি কার কার কারকেগি
আর শাসকের মাথার উপর আকাশে
কড় কড় করে বিজলি চমকাবে
য্ব আরজ-এ-খোদা কে কা’বে সে
স্ব বুত উঠায়ে জায়েঙ্গে
হাম আহল-এ-সাফা মারদুদে-এ-হারাম
মসনদ পে বেঠায়ে জায়েঙ্গে
স্ব তাজ উছালে জায়েঙ্গে
স্ব তখ্ত গিরায়ে জায়েঙ্গে
যখন খোদার ঘর কা’বা থেকে
সকল মিথ্যার মূর্তি সরিয়ে ফেলা হবে;
মসনদে বসানো হবে এই আমাদেরকেই,
এত দিন পবিত্র স্থান থেকে যারা নির্বাসিত ছিলাম।
সকল মুকুট ছুড়ে ফেলা হবে
সকল সিংহাসন চুরমার করে দেয়া হবে।
বাস্ নাম রাহেগা আল্লাহ কা
জো গায়েব ভি হ্যায় হাযির ভি
জো মানযার ভি হ্যায় নাযির ভি
উঠেগা আন-আল-হক্ কা নাড়া
জো ম্যায় ভি হুঁ আওর তুম ভি হুঁ
আওর রাজ-করেগি খাল্কে খুদা
জো ম্যায় ভি হুঁ আওর তুম ভি হুঁ
শুধু টিঁকে থাকবে আল্লাহর নাম
যিনি অদৃশ্য আবার দৃশ্যমানও বটে
যিনি এক দৃশ্য আবার সেই দৃশ্যের দর্শকও।
আওয়াজ উঠবে ‘আমিই তো পরম সত্য’-
যা আমিও বটে, তুমিও বটে।
আর রাজত্ব করবে যারা ঈশ্বরের সৃষ্টি
যা আমিও বটে, তুমিও বটে।
৫
এই কবিতায় কবি রূপক হিসেবে কাবা থেকে মূর্তি অপসারণের যে কথা বলেছেন, তা আক্ষরিক অর্থে মূর্তিপূজার বিরোধিতা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ নেই। উচ্চাঙ্গের কবিতার মর্ম বুঝতে এমন স্থূল সরলীকরণ চলে না। আর লেনিন পুরস্কার বিজয়ী কমিউনিস্ট কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ যে একজন আইকনোক্লাস্ট বা মূর্তিবিনাশী কালাপাহাড় ছিলেন না, সে খবর কারও অজানা থাকার কথা নয়। তাঁর পবিত্র মাতৃভূমি থেকে জিয়াউল হক জিয়ার ও তাঁর চেলা চামুণ্ডাদের মতো বিদেশি সরকারের পুতুলদের উৎখাত হওয়ার অনিবার্যতাকে বোঝাতেই বুঝি তিনি কাবা থেকে মূর্তি সরানোর রূপকটি ব্যবহার করেছেন।
এই কবিতায় আধ্যাত্মিকতা কোনো প্রসঙ্গই নয়। সুফিদের ঈশ্বর-তত্ত্বের মাধ্যমে কবি প্রকারান্তরে মানুষকেই সামনে নিয়ে এসেছেন। এখানে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ প্রথমে বলেছেন, শুধু স্রষ্টার বা আল্লাহর নাম টিকে থাকবে। তারপর ‘আন-আল-হক’ তত্ত্বের মধ্য দিতে স্রষ্টা আর সৃষ্টিকে আমি-তুমিতে বিলীন করে দিয়ে সাধারণ মানুষের রাজত্বের কথা বলেছেন।
দশম শতাব্দীর ইরানি সুফি সাধক মনসুর হাল্লাজ নিজের মধ্যে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে বলেছিলেন ‘আন-আল-হক’ বা ‘আমিই পরম সত্য’। সুফিবাদ, মরমিবাদে মূল সুর সৃষ্টি আর স্রষ্টার মধ্যে মিলন। বৈষ্ণব মতে তা-ই জীবাত্মা আর পরমাত্মায় মিলন। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের এই গান নিয়ে বিতর্কের পর ভারতের বিখ্যাত গীতিকার ও কবি জাভেদ আখতার এই ‘আন-আল-হক’ এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘এ হলো ‘অহম-ব্রহ্ম’, যা হিন্দু দর্শনের কথা।
জুলুমের বিরুদ্ধে জনগণের চিরায়ত স্বপ্নের কথাই বলেছে ফয়েজের এই কবিতা। তাই যেখানেই মানুষ অত্যাচারিত হবে, সেখানেই কারও না কারও মনে পড়বে এই কবিতার কথা। তাই বারবার প্রতিবাদীদের গলায় উঠে আসে এই গান। আর সেজন্যই তা অনেকের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
চৌধুরী মুফাদ আহমদ: প্রাবন্ধিক।
[email protected]