২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

একজন গণমানুষের ব্যাংকার

লুত্ফর রহমান সরকার
লুত্ফর রহমান সরকার

জনসম্পৃক্ততার জন্য তিনি গ্রাহক সমাবেশ প্রচলন করেছিলেন। গ্রাহক তথা জনসাধারণের সামনে দাঁড় করিয়ে তিনি ব্যাংকারদের অন্তর্মুখিতা ভেঙে দিতেন। ১৯৭৬ সালে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে অগ্রণী ব্যাংকে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতা ও কর্মক্ষেত্রের পরিধি বিস্তৃত হলো।

একটি ছোট্ট ঘটনা মনে পড়ছে। স্বাধীন দেশে পল্লি অঞ্চলে শাখা বিস্তার এবং কৃষিসহ গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঋণদান সরকারের ঘোষিত নীতি। অথচ ব্যাংকগুলো চলছে পাকিস্তানি আমলের বুক অব ইনস্ট্রাকশনের ভিত্তিতে। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ওই বইতে ‘কৃষিকাজে ঋণদান নিষেধ ও শাস্তিযোগ্য’ লেখা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সাহেব আমাকে অনুরোধ করলেন স্বাধীন দেশের নীতিমালার আলোকে অগ্রণী ব্যাংকের জন্য নতুন করে যুগোপযোগী বুক অব ইনস্ট্রাকশন প্রণয়ন করার জন্য। আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। ওই ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন ফজলুর রহমান। তিনি আমাকে বলেন, ‘তোমার তো দুঃসাহস কম না। জানো, পাকিস্তানি কয়েকটি ব্যাংকের বুক অব ইনস্ট্রাকশন (বিবিআই) লিখেছিলেন বিদেশি পরামর্শক। যেখানে ডেভিল ঢুকতে ভয় পায়, তুমি সে পথে হাঁটতে চাইছ?’ সরকার তাঁকে থামিয়ে বললেন, ‘দায়িত্ব আমার। খালেদ আমার তত্ত্বাবধানে বিবিআই  লিখবে।’ আমার জেদ চেপে বসল। সরকার সাহেবের তত্ত্বাবধানে নয়, বরং তাঁর প্রোটেকশনে থেকে তিন মাস দিনরাত পরিশ্রম করে স্বাধীন দেশের উপযোগী করে যে বিবিআই প্রণয়ন করেছিলাম, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে সেটাই পূর্ণাঙ্গ রচনা। পরবর্তী সময়ে পরিবর্ধিত সংস্করণও প্রকাশ করেছিলাম। 

অনেক স্মৃতি ভিড় করছে। স্বাধীনতার পরই আমরা কজন তরুণ ব্যাংকার ভারতের প্রশিক্ষণব্যবস্থা দেখার জন্য বোম্বে গিয়েছিলাম। লুৎফর রহমান সরকার, সৈয়দ আলী কবির, মোস্তফা ওয়ায়েজসহ বেশ কয়েকজন। ভারতীয় ব্যাংকাররা আমাদের সংবর্ধনা দিলেন এক সন্ধ্যায়। বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর নৈশভোজের আয়োজন ছিল। সাংস্কৃতিক পর্বের শুরুতে ভারতীয়রা তাঁদের জাতীয় সংগীত গাইলেন। তারপর আহ্বান জানালেন আমাদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের জন্য। আমরা কেউ গায়ক নই। মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। সরকার সাহেব দৃপ্ত পদে স্টেজে উঠে আমাদের ডাকলেন। আমরা সম্ভবত দুজন স্টেজে উঠেছিলাম। জাতীয় সংগীতের চার লাইন গেয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের সম্মান রক্ষা করলাম। তাঁর নেতৃত্বগুণে সেযাত্রায় বেঁচে গেলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে স্কুলছাত্রদের ব্যাংকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াসে জনাব সরকার স্কুল ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটিয়েছিলেন। ক্ষুদ্রঋণ বিতরণেও তাঁর সাফল্য ছিল। কৃষিঋণ বিতরণে তিনি উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। খুব সফল না হলেও শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাব খোলার সূচনা তিনি করেছিলেন। রিকশাচালকদের রিকশামালিক বানানোর লক্ষ্যে তিনি ব্যাপকভাবে রিকশা-ঋণ দিয়েছেন। ঠেলাগাড়ির চালকদেরও ছোট ছোট ঋণ দিয়েছেন। ভ্যানচালকদের ঋণদানে তিনিই গতি সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে এভাবেই গণমুখিতা ফুটে ওঠে।

শিক্ষার প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। ছাত্রদের প্রায়োগিক শিক্ষা প্রদান এবং কর্মসংস্থানেও তাঁর ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। বাণিজ্য অনুষদের ছাত্রদের শিক্ষা শেষে তাঁদের প্রায়োগিক শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে তিনিই প্রথম ব্যাংকে ব্যাপকভাবে ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম চালু করেছিলেন।

বুয়েট, মেডিকেল ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাংকে বেশ কিছু প্রকল্পের প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তিনি করেছিলেন। মূল সার্টিফিকেট জমা রেখে বিনা জামানতে ঋণ প্রদানের প্রচলন তাঁরই কীর্তি। তাঁর প্রবর্তিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘বিকল্প’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় অনেক ডেন্টাল ক্লিনিক, ডাক্তারদের চেম্বার, ক্ষুদ্র ব্যবসা স্থাপিত হয়েছিল। অনেক বাস রাস্তায় নেমেছিল। ছাত্রদের মালিকানায় ট্যাক্সিক্যাবও চালু হয়েছিল অনেক। স্বচ্ছতার সঙ্গে ছাত্র নির্বাচন করা হতো এ প্রকল্পে। অভিযোগ রয়েছে, জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার রাজনৈতিক দল গঠনের সুবিধার্থে তাঁদের পছন্দমতো ছাত্র নির্বাচনের প্রস্তাব করলে লুৎফর রহমান সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরশাদ সরকার রুষ্ট হয়ে সামরিক আইনে বিচার করে তাঁকে জেলে পাঠায়। উল্লেখ্য, এরশাদ সরকার তখনকার প্রবীণ, সৎ, দক্ষ ও সজ্জন ব্যাংকারদের জেলে পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ আলী কবির, মুশফিকুস সালেহীন, সুলেমান চৌধুরীর মতো প্রথিতযশা ব্যাংকাররা। সেরা ব্যাংকারদের বদনাম দেওয়াটা ব্যাংক বিরাষ্ট্রীয়করণের কৌশল ছিল কি না, এ নিয়ে নিবিড় গবেষণা হতে পারে। 

জেল থেকে বেরিয়ে লুৎফর রহমান সরকার ব্যক্তি খাতের ইসলামী ব্যাংক ও প্রাইম ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেছেন পরবর্তীকালে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার লুৎফর রহমান সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরশাদ সরকার তাঁকে যেভাবে অপদস্থ করেছিল, তার কিছুটা হলেও মোচনের প্রয়াস ছিল এই নিয়োগে। গণমানুষের ব্যাংকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে পদায়ন সুধী মহলে সমাদৃত হয়েছিল।

লুৎফর রহমান সরকার পেশাগত লেখা ছাড়াও রম্যরচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ছড়া লিখেছেন। লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা তথা লেখক সৃষ্টির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। 

 নবপ্রজন্মের ব্যাংকাররা ভুলতে বসেছিল এই খ্যাতিমান অগ্রজকে। অনেক দিন পর তাঁর উত্তরসূরি গভর্নর আতিউর রহমান বুঝি বিবেকের দায় অনুভব করলেন। ২০১০ সালে ৮ ডিসেম্বর তাঁরই উদ্যোগে ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স এবং ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে সব ব্যাংকের পক্ষ থেকে লুৎফর রহমান সরকারকে সম্মাননা জানান হোটেল র‌্যাডিসনে এক মনোরম সন্ধ্যায়। লুৎফর রহমান সরকার এসেছিলেন হুইলচেয়ারে বসে। হুইলচেয়ার বসিয়েই স্টেজে তোলা হয়েছিল তাঁকে। হুইলচেয়ারে বসেই মাইকের সামনে সামান্য দুকথা বলতে পেরেছিলেন। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মুখের চিরচেনা হাসিটি ছিল অমলিন। সম্মাননা জানানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। আর বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘সম্মাননার যোগ্য আমি নই। যা করেছি, দায়িত্ব পালনের জন্যই করেছি।’ শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, গণমানুষের প্রতি এমন দায়িত্ববোধ কজনের থাকে। প্রাণচঞ্চল, সদা হাস্যমুখ, বিনয়ী এবং কর্মমুখর এই মানুষটি এরপর আর জনসমক্ষে আসেননি।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশব্যাংক।