এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা স্বল্প পরিচয়েই মনে দাগ কাটেন। এম মুজিবুল হক—বাংলাদেশের সাবেক কেবিনেট সেক্রেটারি, যিনি ১২ জানুয়ারি, ২০১৪ সালে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন—ছিলেন তাঁদের একজন। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৫২ সালে, যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন নামকরা ছাত্র। তিনি হলের ভিপি হয়েছেন, হল নির্বাচনে, পরবর্তীকালের প্রখ্যাত আওয়ামী লীগের নেতা আবদুস সামাদ আজাদকে পরাজিত করে। ১৯৫২ সালেরই কোনো একসময়ে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সলিমুল্লাহ্ হলের চায়ের দোকানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত হিসেবে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলাম এবং আমার এখনো মনে আছে, সুদর্শন এই মানুষটির গভীর গলার আওয়াজ, স্পষ্ট বাচনভঙ্গি আর ব্যবহারের উষ্ণতা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। পরের বছরগুলোতে, তাঁর সঙ্গে জীবনের চলার পথে, বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা হয়েছে এবং যতই তাঁকে জেনেছি, ততই তিনি মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছেন।
১৯৩০ সালে বরিশালের বানারীপাড়ায় জন্ম নেওয়া মুজিবুল হক ছিলেন আমার চেয়ে মাত্র চার বছরের বড়; কিন্তু তবু কিছুদিনের জন্য হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। তাঁর প্রয়াণে কি স্কুল কি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সরাসরি আর কোনো শিক্ষক বেঁচে নেই। ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগদানের আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। আমার মনে পড়ে, ক্লাসে আমরা ইংরেজিতে কথা বলে যেন ইংরেজি বলার জড়তা কাটিয়ে উঠি, সেটাই ছিল তাঁর প্রচেষ্টা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক, কারাবাসেও ছিলেন কিছু সময়ের জন্য এবং ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে বহু বছর পরে হলেও সোহ্রাওয়ার্দী পুরস্কারে পুরস্কৃত করে স্বীকৃতি জানানো হয়েছিল।
মুজিবুল হক ছিলেন একজন আদর্শ সরকারি কর্মকর্তা, যিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন স্থানে, এসডিও এবং ডিসির পদ অলংকৃত করেছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর এতই সুনাম ছিল যে তখন অনেক কনিষ্ঠ কর্মকর্তাই তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চাইতেন। আমার ছোট ভাই ইনাম আহমদ চৌধুরী ছিল তাঁদের একজন, যে ১৯৬১ সালে শিক্ষানবিশ সিএসপি কর্মকর্তা হিসেবে অনেক চেষ্টা করে রাজশাহীতে পোস্টিং নিয়েছিল। কারণ, মুজিবুল হক রাজশাহীর ডিসি ছিলেন। তার চাকরিজীবনের প্রথমেই মুজিবুল হকের সান্নিধ্য ছিল এক প্রীতিদায়ক অভিজ্ঞতা, এই কথাটি ইনাম প্রায়ই বলে থাকে।
আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় মুজিবুল হক ছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রসচিব। সেই সময়ে তাঁর ভূমিকার জন্য তিনি টিক্কা খানের রোষানলে পড়েন। কথিত যে টিক্কা খান তাঁকে বলেছিলেন, বাঙালি কর্মকর্তাদের ‘শুদ্ধি’ অভিযান কি তিনি স্বরাষ্ট্রসচিব মুজিবুল হককে দিয়েই শুরু করবেন। যা-ই হোক একাত্তরের মার্চ/এপ্রিল মাসেই তাঁকে ইসলামাবাদে বদলি করে দেওয়া হয়। নামকাওয়াস্তে তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যদিও কোনো অর্থপূর্ণ দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়নি। সেই সময়ে পাকিস্তান সরকার দ্য বিট্রেয়েল অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতকতা শীর্ষক একটি প্রোপাগান্ডা ছবি তৈরি করে, যাতে উল্লেখ ছিল, পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে কিছু বাঙালি সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তার ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ নজির। এই ছবিটি দেখতে বাঙালি কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করা হতো। ছবিটি দেখতে গিয়েছিলেন মুজিবুল হক। তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরই তদানীন্তন উপসচিব নুরুল হোসেন খান। ছবিটি দেখার পর বেরিয়ে এসে মুজিবুল হক একটি বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, ‘বাপ কা বেটা’! ‘কে তিনি’, তাঁকে প্রশ্ন নুরুল হোসেন খানের। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, দৃপ্তকণ্ঠে ছিল মুজিবুল হকের উত্তর।
পাকিস্তান থেকে ১৯৭৩ সালে আফগানিস্তান আর দিল্লি হয়ে গোপনে বাংলাদেশে পাড়ি জমালেন মুজিবুল হক। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাসচিব হিসেবে নিযুক্তি দিলেন। তার পর থেকে একজন আদর্শ এবং দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে মুজিবুল হক অধিষ্ঠিত ছিলেন বিভিন্ন পদে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের কেবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। প্রশাসনিক বিষয়াদিতে তাঁর ছিল গভীর অভিজ্ঞতা। যখন বাংলাদেশে মাত্র ১৬টি জেলা ছিল, তখনো তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নগরায়ণ ত্বরান্বিত করে সেগুলোকে ‘উন্নয়ন কেন্দ্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ভাবনা পোষণ করতেন। দেশের সব মহকুমাকে জেলা হিসেবে পরিণত করার আদি ভাবনাটি বোধ করি তাতেই নিহিত ছিল।
মুজিবুল হকের একটি বিশেষ গুণ ছিল তাঁর স্পষ্টবাদিতা এবং তিনি যা বলতে অথবা বোঝাতে চাইতেন তা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায়, বাংলা অথবা ইংরেজিতে প্রকাশ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল।
১৯৮৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বসে থাকেননি মুজিবুল হক। স্বাস্থ্য উন্নয়ন ক্ষেত্রে তাঁর ছিল বিপুল আগ্রহ এবং ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ছিলেন। সম্পৃক্ত ছিলেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে।
জনপ্রশাসন ট্রেনিং কেন্দ্র, বাংলাদেশ জাতীয় পে-কমিশন এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে সরকারি কর্মকাণ্ডে সহায়ক ভূমিকা পালনের জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন। ইউনিসেফের ঢাকা অফিসের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ আমি প্রত্যক্ষ করেছি, যখন আমি ব্র্যাকের উপদেষ্টা ছিলাম। তিনি ২০০৫ সালে বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা পদক’ লাভ করেন।
তাঁর জীবনের শেষ দু-তিনটি বছর তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে নিজেকে সক্রিয় কর্মকাণ্ড থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেছেন। কিছুটা লোকচক্ষুর অন্তরালে।
তাঁর তিরোধানে বাংলাদেশ একজন মূল্যবান নাগরিককে হারাল আর আমরা যারা তাঁর নৈকট্য লাভে ভাগ্যবান ছিলাম, হারিয়েছি একজন উদার, উষ্ণ হূদয় মানুষকে, যাঁর অনুপস্থিতি আমরা নিবিড়ভাবে অনুভব করি।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব।