ভাবছি টাইম মেশিন আবিষ্কার হলে ভালো হতো? অতীতে যাওয়া যেত। ভবিষ্যতেও।
কেন ভাবছি?
এই যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি হতে পারে বলে প্রিএম্পটিভ (আগাম) আক্রমণ করে বসল, তাতে আমরাও বিচলিত হলাম, এক মন্ত্রী চাকরি হারালেন, এক আমলা কারাগারে গেলেন, তখন যদি টাইম মেশিন থাকত, তাহলে আমরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে কানাডার আদালতের রায়টা দেখে যেতে পারতাম। কিংবা ধরুন, এখন যদি আমরা অতীতে যেতে পারি, তাহলে হয়তো আবুল হোসেন সাহেবের দাবি ‘আমি দুর্নীতি করিনি, আমি পরিষ্কার’ ওই কথাটাকে সমর্থন দিতে পারতাম।
প্রিএম্পটিভ কথাটা আমরা প্রথম শুনি বড় বুশ যখন ইরাক আক্রমণ করতে গেল, তখন। ইরাক আমাদের ভবিষ্যতে আক্রমণ করতে পারে, তাদের আছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র, তাই আমরা আগেভাগেই ইরাক আক্রমণ করে বসব।
ওই সময় এই কলামে আমি নেকড়ে ও মেষশাবক-বিষয়ক ইশপের গল্পটা শুনিয়েছিলাম।
নেকড়ে বলল, ওরে মেষশাবক, তুই আমার পানি কেন ঘোলা করছিস? তোকে আমি খাব।
মেষশাবক বলল, স্যার, আপনি আমার উজানে, আমি আপনার ভাটিতে। পানি যদি ঘোলা হয়, তাহলে আপনি আমার পানি ঘোলা করছেন, আমার পক্ষে আপনার পানি ঘোলা করা সম্ভব নয়।
নেকড়ে বলল, তাহলে তুই গত বছর আমার পানি ঘোলা করেছিলি।
‘স্যার, গত বছর আমার জন্ম হয়নি।’
‘তাহলে তোর বাবা আমার পানি ঘোলা করেছিল’—বলে নেকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেষশাবকের ওপর।
আর বুশ সাহেব বলেছিলেন, আমি ইরাকে এমন হামলা চালাব, পাঁচ লাখ ইরাকি ও আরেকজন বাইসাইকেলচালক নিহত হবে।
সবাই বলল, পাঁচ লাখ ইরাকি না হয় বুঝলাম, একজন বাইসাইকেলচালক কেন?
বুশ বললেন, দেখলেন, সবাই একজন বাইসাইকেলচালকের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, পাঁচ লাখ ইরাকি নিয়ে কারও কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
আরে আরে, আমি তো টাইম মেশিন নিয়ে আছি। এর মধ্যে আবার ইরাক, বুশ, নেকড়ে কেন।
টাইম মেশিন নিয়ে কথা বলাটা উসকে দিয়েছে আরেকটা সংবাদ। তা হলো দুবাইয়ে উড়ন্ত ট্যাক্সি প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে। এবং সেটা হবে চালকবিহীন। সেই ট্যাক্সিতে উঠে কোথায় নামবেন, সেটায় টিপে স্টার্ট বাটন টিপলে তা আকাশ দিয়ে উড়ে গিয়ে আপনার গন্তব্যে আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। এই উড়ন্ত ট্যাক্সি এরই মধ্যে দুবাইয়ের আকাশে পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন করেছে।
আগামী জুলাই মাস থেকে এটা দুবাইয়ে রীতিমতো চালু হতে যাচ্ছে।
আহা! গান গাইলেন বাংলাদেশের গায়কেরা (জলের গান)—এমন যদি হতো, আমি পাখির মতো, উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ।
আর সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে দুবাইয়ে।
আচ্ছা হোক। আমরা গান গাইব, মানুষ আমি আমার কেন পাখির মতো মন, তাই রে নাই রে নাই রে গেল সারাটা জীবন।
ঢাকা চারুকলা অনুষদের দেয়ালে একটা লেখা দেখেছিলাম—আয় লো সখী, উইড়া যাই।
দুবাইওয়ালারা উড়ে উড়ে অফিস করবে। আর আমরা বসে থাকব যানজটে।
কারণ, আমাদের কোনো গণপরিবহনব্যবস্থা নেই। আমাদের সার্বিক পরিকল্পনা নেই। আমরা একটা ফ্লাইওভার বানিয়ে তা নামিয়ে দিই চার রাস্তার মোড়ে। এখন বোঝো, যানজট কাকে বলে।
পথই আমাদের মোকাম। আমরা আসলে কোথাও পৌঁছাতে চাই না।
এই সব সময় মনে হয়, আমাদের যদি একটা উড়ে চলার মেশিন থাকত। টাইম মেশিন তো দূরবর্তী স্বপ্ন। একটা উড়ন্ত বাইসাইকেলও কি আমরা পেতে পারি না?
এখন ভাবছি, ঢাকার রাস্তায় ওই দুবাই-মার্কা উড়ন্ত গাড়ি চলার অনুমতি দিলে কী হবে?
সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার বড়লোকেরা এটা আমদানি করে ফেলবেন। প্রথমে থাকবে আমাদের মহা ধনবানদের হাতে।
তারপর চীনারা যখন দেখবে, বাহ, এর তো ডিমান্ড আছে, তারা তা বাইসাইকেলের দরে সরবরাহ করতে চাইবে।
তার লাইসেন্স পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে পত্রপত্রিকায়, টক শোতে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও সুনীতি-ন্যায়পরায়ণতার বাহাস হবে।
এরপর এটা হয়ে যাবে মোবাইল ফোনের মতো। সবারই একটা করে উড়ন্ত গাড়ি, তিনটা করে সিম, চারটা করে নম্বর থাকবে। তখন হবে আসল মজাটা!
দুই কোটি লোক ঢাকার ১০০ বর্গকিলোমিটার জায়গায় ২০০ কোটি উড়ন্ত গাড়ি নিয়ে উড়াল দিতে আকাশে বেরিয়ে পড়বে। তখন আকাশটা দেখতে হবে জবর। কে যে কার সঙ্গে ধাক্কা খাবে, আর কার গাড়ি যে কার ছাদে গিয়ে নামবে, উফ, কল্পনাও করতে পারছি না। ট্রাফিক পুলিশেরা তখন কী করবেন? মাঝেমধ্যে ভিআইপিদের বহর বেরোলে আকাশ ফাঁকা করে দেওয়া হবে।
একটা টাইম মেশিন থাকলে আমরা খানিকটা ভবিষ্যতে গিয়ে ঢাকার আকাশে উড়ুক্কু গাড়ির জটটা দেখে আসতে পারতাম।
কিন্তু টাইম মেশিন জিনিসটা আদৌ নাকি সম্ভব না।
বিজ্ঞানীরা যে সহজ উদাহরণটা দেন, তা হলো আমি যদি অতীতে গিয়ে আমার জন্মের আগে আমার বাবাকে খুন করি, তাহলে আমি আর
জন্মাব না।
তবে সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না, এই কথাটা কিন্তু ঠিক নয়। একেক উচ্চতায় সময় একেকভাবে যায়। স্টিফেন হকিংয়ের এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমে পড়েছিলাম, এটা কোনো কল্পনা নয়, মহাকাশে যে উপগ্রহ আছে, তার সময় আর পৃথিবীর সময় যে একই বেগে প্রবাহিত হচ্ছে না, সেটা হিসাবে নিয়েই নভোচারীরা আসা-যাওয়া করছেন। দুটো যমজ শিশুর একজনকে সমুদ্রপৃষ্ঠে আরেকজনকে উঁচু পর্বতের চূড়ায় রেখে দিলে ৮০ বছর পর দুজনের বয়স দুই রকম হবে।
আর কোনো মানুষ যদি আলোর গতি অর্জন করে এক ছায়াপথ থেকে আরেক ছায়াপথে গিয়ে আট বছর পর পৃথিবীতে ফিরেও আসে, দেখা যাবে তার বয়স হয়ে গেছে এক হাজার বছর।
যা-ই হোক, আবার ঢাকা শহরে আসি। আসাদ গেট থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পথ বাসে চড়ে যেতে সচরাচর লাগে দুই ঘণ্টা। হেঁটে যেতে লাগবে ২০ মিনিট। আর বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ মঙ্গলে যাবে ২০৪০ সালের মধ্যে, যেতে লাগবে কমপক্ষে ২৭০ দিন। আর পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ কোটি কিলোমিটার। আর এই সাড়ে পাঁচ কোটি কিলোমিটারও আরও ভবিষ্যতে আধা ঘণ্টায় অতিক্রম করা সম্ভব।
এরশাদের আমলে একটা কৌতুক পড়েছিলাম। আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের শীর্ষ বৈঠক হচ্ছে। বিষয়: পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস চুক্তি স্বাক্ষর করা। এই সময় এরশাদ সাহেব সেখানে ঢুকে পড়লেন একটা জর্দার কৌটা নিয়ে। আপনারা অ্যাটম বোমা সমস্যার সমাধান পরে করবেন, আগে আমার এই জর্দার কৌটার সমাধান করে দেন।
জর্দার কৌটার সমস্যাটা কী?
এটা ককটেল। হরতালের সময় সারা রাত ফোটানো হয়।
আমারও একই রকম কথা। মঙ্গলের সাড়ে পাঁচ কোটি কিলোমিটার পথ আধা ঘণ্টা কি আধা মাসে যাওয়ার উপায় আপনারা আবিষ্কার করুন। কিন্তু তার আগে আমাদের আধা কিলোমিটার পথ আধা ঘণ্টায় যাওয়ার উপায় বাতলে দিন।
দুবাইয়ের ওই উড়ুক্কু গাড়িই কি তবে সমাধান?
আচ্ছা, মঙ্গলে অক্সিজেন নেই, তেজস্ক্রিয়তা বিপজ্জনক, পানি কষ্ট করে তৈরি করে নিতে হবে, তবু সেখানে যাওয়ার জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়ে আছে কেন?
মানুষ মঙ্গলে যাবে, গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ করে মঙ্গল গ্রহকে উত্তপ্ত করবে, গাছপালা লাগাবে, শেওলা চাষ করে অক্সিজেন বানাবে, এভাবে আগামী এক হাজার বছর পরে, ৩০০০ খ্রিষ্টাব্দে লাল গ্রহ মঙ্গল হয়ে উঠবে সুজলা-সুফলা।
মানুষ কেন যেতে চায় মঙ্গলে? কেন এত বিপদ, খরচ আর ঝুঁকির মধ্যে নিজেদের সমর্পণ করা?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো কারণে যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে মানব প্রজাতির বসবাসের জন্য একটা বিকল্প গ্রহ তো লাগবে।
স্টিফেন হকিং বলেছেন, মহাজাগতিক দুর্ঘটনায় পৃথিবীর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার চেয়ে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে এবং পৃথিবীর উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি।
তাহলে পৃথিবীতে পারমাণবিক অস্ত্রগুলো ধ্বংস করে ফেললেই তো হয়। ঘৃণার বদলে ভালোবাসা প্রচার করলেই তো হয়। আর পৃথিবীর উষ্ণায়ন বন্ধে সবাই মিলে চেষ্টা করলেই তো হয়।
হয় তো বটেই। করবেটা কে। এরই মধ্যে আমেরিকা পড়েছে এক পাগলের হাতে। এই ভদ্রলোকের হাতে অ্যাটম বোমার সুইচ নিরাপদ নয়। একবার ভুল করেও তিনি যদি একটা সুইচ টিপে ফেলেন, তাহলে কি বাকি দেশগুলো বসে থাকবে! হে মাবুদ, আমাদের রক্ষা কোরো।
আমেরিকায় হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প। বাংলাদেশের বড়লোকেরা এবার মঙ্গলে জমি কেনা শুরু করতে পারেন। মঙ্গলে প্লট বিক্রির ব্যবসাও শুরু করা যায়। মঙ্গলে প্লট, মঙ্গলে প্লট, মাত্র আড়াই কোটি টাকা জমা দিয়ে এখনই সাফ-কবলা করে নিন। (কপিরাইট সংরক্ষিত। বাংলাদেশে যিনি এই স্লোগান দিয়ে ব্যবসা করবেন, আমাকে লাভের অংশ দিতে ভুলবেন না।)
যাক, আবার আসি পদ্মা সেতুতে। আসুন, গান ধরি, পদ্মার ঢেউ রে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যা রে।
না, পদ্মা আমাদের হৃদয় শূন্য করেনি। বরং বিশ্বব্যাংকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা পদ্মার ওপরে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু বানানোর কাজ এগিয়ে নিয়ে পৃথিবীতে এক বিরল সম্মানজনক নজির স্থাপন করতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে জন্য অভিনন্দন পাবেন।
এখন ছোট ছোট কিছু কাজ করা দরকার।
যেমন ধরা যাক, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর পরামর্শটা শুনলেই হয়ে যায়। দশ সেট প্রশ্নপত্র বানিয়ে প্রচার করে দিলেই হয়। তারপর পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে আমরা বলব, সেট নম্বর এত। ব্যস।
আর দরকার গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করা, তা নিরাপদ করা। এত এত মানুষ প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবে, প্রতিবছর লঞ্চ ডুববে,
আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা রাস্তায় বসে থাকব, এটা হয় না।
একটা প্রবাদ বাক্য আছে, ইংরেজিতে খুব ব্যবহার করা হয়, ‘এটা রকেট সায়েন্স নয়।’ যে জিনিস খুব জটিল নয়, তা বোঝানোর জন্য এ কথা বলা হয়। আমরা যদি বিশ্বব্যাংকের অসহযোগিতা পেরিয়ে পদ্মা সেতু বানাতে পারি, আমরা অন্য সমস্যাগুলোর সমাধানও করতে পারব। কারণ, এসব রকেট সায়েন্সও নয়, পদ্মা সেতুও নয়। দরকার শুধু সরকারের সদিচ্ছা, সক্রিয়তা, দৃঢ় পদক্ষেপ ও সুদক্ষতা।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।