ঈদ মানে স্মৃতির উৎসব

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

একবার আম্মাকে এক পড়শি বলেছিলেন, ‘আপনার এই একটা ছেলের মনে হয় মাথায় গন্ডগোল আছে, একা একা বিড়বিড় করে।’ আমাদের শৈশবে কোনো বাহুল্য ছিল না, রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার বাহুল্যবর্জন ছিল নিয়মের কড়াকড়ি মাত্র, আর আমাদের শৈশবের এক কাপড়, এক তরকারির কারণ ছিল সংগতিহীনতা। কোনো ঈদে হয়তো এক জোড়া বাটার স্যান্ডেল পাওয়া গেল, আরেক ঈদে একটা শার্ট। কিন্তু সেই অভাব আমরা পূর্ণ করতাম অবারিত স্বাধীনতা দিয়ে, নানা ধরনের সৃজনশীলতা দিয়ে। একাত্তর সালে ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস ওয়ানে, বাহাত্তরে অটো প্রমোশন পেয়ে টুয়ে, বাহাত্তরের ঈদে আমাদের উদ্ভাবনী ছিল স্কুল ভবনে আটকে থাকা বোমার টুকরো বের করে বিস্ফোরণ ঘটানো। খুব শীত ছিল, দেয়াল খুঁড়ে বোমার টুকরো বের করে আনা হলো পিটিআইয়ের মাঠের মাঝখানে, সেখানে আগুন জ্বালানো হলো খড়কুটোয়, আমরা চারপাশ ঘিরে আছি, সেই আগুনের মাঝখানে রাখা হলো বোমার টুকরো, ভীষণ জোরে ফুটে উঠল, আমাদের তাতেই ছিল সীমাহীন আনন্দ। ওই সকালেই যে মরে পড়ে থাকতে পারতাম, এখন ভেবে কলজে ঠান্ডা হয়ে আসে।

কোরবানির ঈদের প্রধান উত্তেজনা ছিল গরু কেনা। আব্বা, বড় ভাইয়েরা যেতেন লালবাগের হাটে। আমিও গেছি দু-একবার। নিশবেতগঞ্জের হাটেও বোধ হয় বড়রা গিয়ে থাকবেন। আমরা কোরবানি দিতাম ভাগে। সাধারণত আমাদের পরিবারে নেওয়া হতো তিন ভাগ। গরু কোরবানি দেওয়া হলে আমার ওপরে ভার পড়ত একটা ঠ্যাং ধরে থাকার।

আর আমার একটা প্রিয় কাজ ছিল ঢোল বানানো। একটা কৌটা জোগাড় করতাম। গরুর ভুঁড়ির একটা চামড়া দিয়ে সেই কৌটার মুখ ঢেকে শুকাতে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাক তৈরি হয়ে যেত। তারপর একটা কঞ্চি দিয়ে সেই ঢাক বাজিয়ে পাড়া মাথায় তোলার চেষ্টা করতাম।

আমাদের প্রত্যেক ভাইয়ের একটা করে সাদা পায়জামা, সাদা পাঞ্জাবি ছিল। ঈদের আগে সেসব ধুয়ে মাড় দেওয়া হলে আমাদের কর্তব্য হতো সেসব ইস্তিরি করা। একটা ইস্তিরির পেটে কয়লা পুরতে হতো। আরেকটা ইস্তিরি চুলার আগুনে ধরে গরম করে নিতে হতো।

আম্মারা টেবিলে তুলে রাখা টেবিল ক্লথ বিছাতেন। বিছানায় তোলা চাদর বিছানো হতো। বাসার চেহারাই যেত পাল্টে।

কোরবানির ঈদের গরু/ছাগল কেনার সেই উত্তেজনা এখনো আমার মধ্যে কাজ করে। আমার ভাইয়েরা আমাকে ফোন করতে থাকেন, ‘কিনেছিস, কোত্থেকে কিনবি?’ আমিও তাঁদের জিজ্ঞেস করি, ‘আপনারা কোন হাট থেকে কিনছেন?’

ঢাকায় গরু কেনার আমার পদ্ধতি হলো, অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধরো। ঈদের আগের দিন সকালে যাও হাটে। ছোটখাটো একটা গরু কেনো, যাতে আনতে, বাঁধতে ও ম্যানেজ করতে সহজ হয়। আগারগাঁও কিংবা রায়েরবাজার হাট আমার প্রিয়। ছাগল কেনার জন্য ধানমন্ডি ৮ নম্বর সেতু। পথ দিয়ে যারাই গরু কিনে ফিরছে, তাদের দাম জিজ্ঞেস করা, নিজের কেনা গরুটার দাম এর-ওর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা, শাস্ত্রবহির্ভূত এই সব বাস্তব কাজে অন্য অনেকের মতো আমারও উৎসাহ ব্যাপক।

এবার ঈদ করব আমেরিকার বোস্টন এলাকায়। এর আগে দুটো ঈদ আমি আমেরিকায় করেছি। একবার করেছিলাম ঈদুল ফিতর, ২০১০ সালে, আমেরিকার আইওয়া শহরে। ঈদের দিনে ছুটি ছিল না। মেঘনা আমিন, বাংলাদেশি সংগীতজ্ঞ, ওই শহরে ছিলেন, খবর পেয়ে আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে গিয়ে খাইয়েছিলেন। পরের রোববারে আইওয়ার বিভিন্ন শহরের বাংলাদেশিরা একটা হল ভাড়া নিয়ে ঈদের সম্মিলনী করেছিলেন, তাতে যোগ দিয়েছিলাম। সেবারই কোরবানির ঈদ করলাম নিউইয়র্কে। নিউইয়র্ক তো দ্বিতীয় ঢাকা।
নামাজ পড়তে গেলাম মসজিদে। অনেক বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হলো। বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরা মুসল্লিদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল। সেই রাতেই বিমানে চড়ে পরের দিন ঢাকায় এসে হাজির হলাম। সেবার কোরবানি দিয়েছিলাম ঈদের পরের দিন।

এবার ঈদের নামাজের সময়সূচি মেইল করে জানানো হয়েছে। বোস্টনের এই মসজিদে তিনটা জামাত হবে। আমরা দুই নম্বর জামাত ধরব বলে আশা করছি। এখানে রাস্তায়-মাঠে-ময়দানে কোরবানির নিয়ম নেই। দোকানে বলে রাখলে কোরবানি করে মাংস তৈরি করে দিয়ে দেয়। এমনকি সাত ভাগ করতে চাইলে সে ব্যবস্থাও আছে। প্রবাসে ঈদের দিনটা কেমন কাটবে, সে নিয়ে এখন থেকেই খানিকটা উত্তেজিত আছি।

গত ঈদের আগে লিখেছিলাম, আমার মেয়ে আসছে বিদেশ থেকে, ঈদের পরের দিন, সেইটাই আমার আসল আনন্দের দিন। এবার আমরা একসঙ্গে থাকব ঈদের দিনেই। উৎসব মানেই তো মিলিত হওয়া। মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলবন্ধন। এই যে আমরা, বাংলাদেশিরা, ঈদের সময় আদি বাড়িতে ফিরে যাই, এটার নিশ্চয়ই একটা মাহাত্ম্য আছে। আমার ভীষণ ভালো লাগে। এবার যেমন অভাব অনুভব করব দেশের ঈদের সেই যে সাজ সাজ রব, আম্মা-ভাইবোন-বন্ধু-স্বজনদের মধ্যে থেকে দিনগুলো যাপন করা, ঢাকার রাস্তা ফাঁকা হয়ে যাওয়া, টেলিভিশনগুলোর অবিরাম অনুষ্ঠান, অশেষ বিজ্ঞাপন তরঙ্গ।

বাংলাদেশের উৎসবগুলো কিন্তু বাংলাদেশের মতো করেই উদ্‌যাপিত হয়। অন্য দেশে গিয়ে সেই উৎসবগুলোরই দেখি অন্যতর রূপ।

যেমন শৈশবের আনন্দময় উৎসবগুলোকে আর পাই না। একটা শার্ট পেয়েছি এবারের ঈদে, সেই শার্ট পরে নামাজের পরে বের হয়েছি, সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, মনে হচ্ছে আমার শার্টটাই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে, কী যে আনন্দ লাগছে। আমাদের শৈশবে আনন্দের দাম এ রকমই ছিল।

এবারের ঈদ আবার বাংলাদেশে এসেছে নানা রকমের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। বন্যায় ঘরবাড়ি ভেসে গেছে অনেকের, মাটির ঘর ধুয়ে গলে গেছে, বাঁধে আশ্রয় নিতে হয়েছে অনেক পরিবারকে, ফসলের জমি ভেসে গেছে, ভেসে গেছে মাছের বা মুরগির খামার। রাস্তাঘাটের অবস্থা তো অবর্ণনীয়। অন্যদিকে মিয়ানমারে মানুষের দুঃখ-কষ্ট সহ্যের অতীত হয়ে পড়েছে। গুলি হত্যা আগুন নিপীড়নের মুখে পালাচ্ছে নারী-পুরুষ-শিশু। শিশুর দেহ ভাসছে কাদায়, পানিতে। রাষ্ট্র মানেই তো লেফট রাইট, লেফট রাইট, আমরা আমাদের বুকের দরজা খুলে দিচ্ছি না, বলছি না, আর্ত মানুষ, তোমরা এসো। মানুষে মানুষে এত বিভেদ কেন? ধর্মের বিভিন্নতার নামে, জাতির বিভিন্নতার নামে মানুষ মানুষকে গুলি করে, মানুষ মানুষের ঘরদোরে আগুন দেয়, নারী-পুরুষের ওপর নির্যাতন করে। নাগরিকতার, জাতীয়তার, রাষ্ট্রের, ধর্মের ভিন্নতার কারণে মানুষ মানুষের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়!

আবার মানুষই তো মানুষের পাশে দাঁড়ায়। মানুষই তো মানুষকে বুকে টেনে নেয়। মানুষই তো মানুষের চোখের জল মুছিয়ে দেয়।

মানুষ কবে রাষ্ট্রগুলোকে, ব্যবস্থাগুলোকে মানবিক করে তুলবে? সব মানুষের জন্য সুন্দর পৃথিবী কবে আসবে, কীভাবে আসবে? কবে বিশ্ব এমন হবে যে একজন মানুষও ব্যবস্থার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? একজন মানুষও গুলিবিদ্ধ হবে না, একজন শিশুর শরীরও কাদায়, পানিতে পড়ে রইবে না?

আপাতত আমরা বোধ হয় বিশ্বনেতৃত্বের বিবেক জাগানোর জন্য কাজ করতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে, যূথবদ্ধভাবে। আর মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে সাম্য মৈত্রী ভালোবাসার আহ্বান প্রচার করে যেতে পারি। সবার আগে শাসন করতে পারি নিজের হৃদয়টাকে, বিবেকটাকে। বলতে পারি, আমি কাউকে আঘাত করব না। আমার দ্বারা যেন একজন মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এরপর যেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারি। অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে অবদান রাখতে পারি।

বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে আছি ঈদের ছুটিতে, কিন্তু সমস্ত অস্তিত্ব ঘিরে আছে বাংলাদেশ।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।