বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরায়েল ব্যতীত সকল দেশের জন্য বৈধ’ নির্দেশিকাটুকু বহু বছর ধরে বহাল ছিল। মাত্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশ যে ই-পাসপোর্টের যুগে প্রবেশ করেছে, সেখানে ইস্যু করা পাসপোর্টেও এই নির্দেশিকা মুদ্রিত হয়েছে। কিন্তু এখন যেসব ই-পাসপোর্টে দেওয়া হচ্ছে, তাতে ‘সকল দেশের জন্য বৈধ’ বাক্যটি শুধু থাকছে। ‘ইসরায়েল ব্যতীত’ শব্দগুলো উধাও হয়ে গেছে। একাধিক গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে নানা রকম আলোচনা-বিতর্ক উঠেছে।
পাসপোর্ট ইস্যুর দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে যে হুট করে নয়, বরং ভেবেচিন্তেই কাজটি করা হয়েছে। তবে মূল ভাবনাটি কী, তা প্রকাশ না করে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে বাংলাদেশের পাসপোর্টকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে এই পদক্ষেপ। এটা যে খোঁড়া যুক্তি, তা বলা বাহুল্য। বিষয়টির স্পর্শকাতরতা বুঝতে পেরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমে একটি লিখিত ব্যাখ্যা পাঠিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের ইসরায়েল সফরে নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনীতিকভাবে সম্পর্ক স্থাপনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি এবং ফিলিস্তিন প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান অটুট রয়েছে।
তৃতীয় দেশ হয়ে ভিসা ও সফর
বর্তমান জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যদেশের মধ্যে ৩০টি দেশ এখন পর্যন্ত ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি বা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। তবে স্বীকৃতি না দিলেও এসব দেশের কোনো কোনোটি থেকে সেসব দেশের নাগরিকদের ইসরায়েলে পর্যটক হিসেবে যাতায়াত রয়েছে। যেমন: ইন্দোনেশিয়া। ইসরায়েলের সরকারি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে ২০১৯ সালে ৩৮ হাজার ৭০০ জন ইন্দোনেশিয়া থেকে ইসরায়েল সফর করেছেন। আবার একই বছর মালয়েশিয়া থেকে সফর করেছেন ১৪ হাজার ৭০০ জন। এ দুটি দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। মালয়েশিয়ার পাসপোর্টে ‘অল কান্ট্রিজ এক্সেপ্ট ইসরায়েল’ লেখা আছে। ইন্দোনেশিয়া কয়েক বছর আগে থেকে তা তুলে নিয়েছে। এই দুই দেশ থেকে যাঁরা ইসরায়েল সফর করেন, তাঁরা বেশির ভাগই থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অবস্থিত ইসরায়েল দূতাবাস থেকে ভিসা নেন।
কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই ও মুসলিমপ্রধান, এমন বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকৃষ্ট করার জন্য কয়েক বছর আগে ইসরায়েল ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রেও পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনেছে। যেমন, এখন আর কোনো দেশের পাসপোর্টে ইসরায়েলি ভিসার স্টিকার সাঁটানো হয় না। তার বদলে সংশ্লিষ্ট পাসপোর্টের বিপরীতে দেওয়া হয় আলগা কাগজের (লুজ লিফ) ভিসা। আবার ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোয় বিদেশি পর্যটকদের পাসপোর্টে প্রবেশ বা প্রস্থান (এন্ট্রি বা এক্সিট) সিল দেওয়া হয় না। বরং প্রবেশের সময় ভিসার কাগজ ও পাসপোর্ট দেখে আলাদা একটি পারমিট ইস্যু করা হয়, যা ভ্রমণকারীকে সব সময় সংরক্ষণ করতে হয়। এর ফলে কোনো ব্যক্তি ইসরায়েল সফর করল কি না, তা তার পাসপোর্ট থেকে সাধারণত চিহ্নিত করা যায় না। [এ নিয়ে ইসরায়েল ভ্রমণবিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিস্তারিত দেওয়া আছে।]
সুতরাং বাংলাদেশ থেকে যদি কেউ তৃতীয় দেশ থেকে এভাবে ভিসা নিয়ে ইসরায়েল সফর করতে যায়, তাহলে সেটির কোনো প্রমাণ ওই ব্যক্তির পাসপোর্টে থাকবে না। একমাত্র কোনো কারণে যদি ইসরায়েলি অভিবাসন কর্তৃপক্ষ কোনো সিল-ছাপ্পর মারে, তাহলেই তা ধরা যাবে। এ ছাড়া স্থলপথে জর্ডান দিয়ে প্রবেশ বা প্রস্থান করার সময় অনেক ক্ষেত্রে জর্ডান কর্তৃপক্ষ সিল-ছাপ্পর দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশ হয়ে কোনো বাংলাদেশি ইসরায়েল সফর করেছে কি না, তা নিশ্চিত হয়ে বলা সম্ভব নয়। তবে ইতিমধ্যে যদি কেউ করে থাকেন, তাতে খুব বিস্মিত হওয়ারও কিছু নেই। কেননা মানুষের আয়-উপার্জন ও স্বচ্ছতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের মধ্যেই ভিনদেশে সফরের ইচ্ছা প্রবল হয় এবং তাঁরা সাধ্যমতো তা করে থাকেন। এদের মধ্যে যাঁরা রোমাঞ্চ-অভিযানপ্রিয় ও ইতিহাসে চিত্তাকর্ষণ খুঁজে পান, তাঁদের কেউ তো ‘নিষিদ্ধ দেশ’ ইসরায়েল সফরের ঝুঁকি নিয়ে থাকতেই পারেন। অবশ্যই এ রকম কেউ করে থাকলে তা আপাতত প্রকাশ করবেন না স্বাভাবিকভাবেই।
যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা বা ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী বাংলাদেশিরা যাঁরা যেসব দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তাঁরা ওই সব দেশের পাসপোর্টে নির্বিঘ্নে ইসরায়েল সফল করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে এ সফর করেন না। তাই তাদের সফরকে এখানে বাংলাদেশিদের ইসরায়েল ভ্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
দৃষ্টিভঙ্গি কি পাল্টাচ্ছে?
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ইসরায়েলের প্রতি সাধারণভাবে বিদ্বেষী ও ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিশীল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুটোই যে কিছুটা কমছে, তারও কিছু আভাস মেলে। বিশেষ করে এবার হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনীর ১১ দিনের অসম যুদ্ধ এবং গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলার সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজপথে যে রকম প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা গেছে, বাংলাদেশে সে তুলনায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মাত্রা ছিল কিছুটা কম। ঈদের ছুটি ও করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে জনসমাগমে বিধিনিষেধসহ একাধিক কারণে এটা হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রতিবাদ-ক্ষোভের ঢেউ দেখা গেলেও হামাসের প্রতি বিদ্বেষসহ ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন-সংগ্রামের যৌক্তিকতা নিয়ে কাউকে কাউকে প্রশ্ন তুলতেও দেখা গেছে। একতরফাভাবে ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষের প্রতিবাদও লক্ষ করা গেছে। কেউ কেউ ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের পক্ষেও যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি নিপীড়ন-নির্যাতনকে শুধু মুসলমানদের ওপর জুলুম বিবেচনায় প্রতিবাদের ধারণার সঙ্গেও অনেকে দ্বিমত পোষণ করেছেন। কেউ কেউ এ প্রসঙ্গে চীনের উইঘুরে মুসলমানদের নির্যাতনের বিষয়টি টেনে এনে তার প্রতিবাদ না করার কথাও উল্লেখ করেছেন। এসব থেকে অন্তত এটা ধারণা করা যায় যে ইসরায়েলের বিষয়ে বাংলাদেশিদের অনেকের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিতে ধীরে হলেও হয়তো কিছুটা পরিবর্তন আসছে। দীর্ঘদিনের প্রচলিত ইহুদি-নাসারা ষড়যন্ত্রে মুসলমানদের ঐক্য নষ্ট হওয়ার একপেশে বয়ানটিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে যৌক্তিকভাবেই। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সমস্যাটিকে বড় পর্দায় খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টাও বাড়ছে।
বাণিজ্য চলছে অনেক দিন ধরে
ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে নীরবে। প্রতিবছরই বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকসহ কিছু পণ্য রপ্তানি হচ্ছে এবং তা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা দুবাইয়ের মতো তৃতীয় দেশ হয়ে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা পণ্য পাঠিয়ে থাকে সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ে। পণ্যমূল্যও পরিশোধ করা হয় সিঙ্গাপুর বা দুবাই থেকে। ফল লেনদেনটি বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ে রপ্তানি হিসেবে গণ্য হয়। আর সিঙ্গাপুর থেকে যে কোম্পানি এই পণ্য আমদানি করে, সেটি মূলত ইসরায়েলের কোনো কোম্পানির শাখা বা প্রতিনিধি অফিস। তারা এই পণ্য সিঙ্গাপুর থেকে মাদার ভেসেলে তুলে দেয় ইসরায়েলের হাইফা বন্দরের উদ্দেশে। বিষয়টি অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট।’
বাংলাদেশ থেকে ইসরায়েলে পণ্য রপ্তানির বিষয়টি প্রতিফলিত হয় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে। এতে দেখা যায়, গত ১০ বছরে প্রায় ৫ লাখ ডলারের পণ্য ইসরায়েলে রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১ লাখ ১৮ হাজার ডলারের পণ্য। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সর্বনিম্ন ২ হাজার ৫৭ ডলারের পণ্য। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ২৮ হাজার ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ থেকে ইসরায়েলে বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাক, ওষুধ ও বিবিধ পণ্য রপ্তানি হয় বলে ইপিবির পরিসংখ্যান দেখায়।
ইপিবির পরিসংখ্যানে ইসরায়েলে পণ্য রপ্তানির বিষয়টি স্বীকৃত হলেও বাংলাদেশে ব্যাংকের কোনো পরিসংখ্যানে এটি পাওয়া যায় না। আবার ইপিবির পরিসংখ্যানে যে চিত্র উঠে আসে, তা-ও আংশিকমাত্র। কেননা, সিঙ্গাপুর বা অন্য কোনো দেশ থেকে যখন রপ্তানির টাকা চলে আসে, তখন তা ওই দেশ থেকে উৎসারিত বলেই হিসাবের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়।
তবে ইসরায়েলে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ইন্টিগ্রেটেড ট্রেড সলিউশন (ডব্লিউআইটিএস) তথ্যভান্ডার থেকে যে উপাত্ত পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইসরায়েলে প্রায় ৩৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির যে তথ্য ইসরায়েল প্রদান করেছে, তার ভিত্তিতে ডব্লিউআইটিএস এই পরিসংখ্যান প্রস্তুত করেছে, যার সঙ্গে ইপিবির পরিসংখ্যানের আকাশ-পাতাল ফারাক। অন্যদিকে ডব্লিউআইটিএসের তথ্যভান্ডার থেকে এটাও জানা যায় যে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশ ইসরায়েল থেকে প্রায় ৩৭ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে।
তার মানে একটা বিষয় পরিষ্কার যে বিশ্বায়নের এই কালে বাণিজ্য আটকে রাখা সম্ভব নয়, বড়জোর সীমিত করে রাখা সম্ভব। আর যদি চাহিদা থাকে, তাহলে সোজা পথে না পারলে ঘুরপথে পণ্যের আসা-যাওয়া চলবে। ইসরায়েলি তৈরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একাধিক যন্ত্রপাতিও এভাবে বাংলাদেশে আসাটা অস্বাভাবিক নয়। ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎস কিছুদিন আগে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এ অবস্থায় ইসরায়েলের সঙ্গে পণ্য বাণিজ্যের বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া জরুরি। সরকারি পরিসংখ্যানেও এ বিষয়ে ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন বিভ্রান্তি দূর করার জন্য।
তা ছাড়া তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পণ্য আমদানি-রপ্তানিও বিশ্ববাণিজ্যে একটি স্বীকৃত বিষয়। বিশেষ করে গ্লোবাল ভ্যালু চেইন (জিভিসি) বা বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলের বিস্তার ঘটায় অনেক ক্ষেত্রেই একটি পণ্য আসলে যে দেশে উৎপাদিত পণ্য হিসেবে পরিচিত পায়, বাস্তবে বিষয়টি সে রকম নয়। পণ্যের একাধিক কাঁচামাল আসছে চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে পণ্যের নকশা তৈরি হচ্ছে মালয়েশিয়ায়, প্রযুক্তি জাপানের, একাংশ সংযোজিত হচ্ছে থাইল্যান্ডে, আরেকাংশ সংযোজিত হচ্ছে ভারতে আর সংযোজিত দুই অংশ পূর্ণাঙ্গ অবয়ব নিচ্ছে বাংলাদেশে। তারপর তা বাংলাদেশে তৈরি পণ্য হিসেবে যাচ্ছে জার্মানিতে। জিভিসির এই বিস্তার হয়তো বাংলাদেশ-ইসরায়েল বাণিজ্যকেও এগিয়ে নিচ্ছে, আমরা তা পছন্দ করি বা না করি।
আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]