প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ১৮-দলীয় জোট আন্দোলনের নামে দেশজুড়ে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তা যেমন জনগণের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে চলেছে, তেমনি দেশকেও ঠেলে দিচ্ছে গভীর অনিশ্চয়তার দিকে। তাদের এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতি জনসমর্থন নেই। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী, যেই দলটির নিবন্ধন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বাতিল হয়ে গেছে, তাদের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই নির্বাচন নয়। তারা দেশে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে চাইছে। আমার ধারণা, বিএনপি নেতৃত্ব মৌলবাদী দলটির খপ্পরে পড়ে ধবংসাত্মক কর্মসূচির নামে জুলুম চলাচ্ছে।
৪৮ ঘণ্টা অবরোধের নামে ১৮-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা নির্বিচারে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করছেন, জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করছেন, ট্রেনে আগুন দিয়েছেন। এটি তো আন্দোলন হতে পারে না।
নির্বাচন নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, আলোচনার মাধ্যমেই তা সমাধান করতে হবে। কিন্তু বিরোধী দল যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে গোঁ ধরে বসে থাকে, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না। নির্বাচনও ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
আওয়ামী লীগ সব দলকে নিয়েই নির্বাচন করতে চায় এবং এই উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন, যদিও পঞ্চদশ সংশোধনী বলে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার কথা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দল নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল এলে এটি পূর্ণতা পাবে।
বিরোধী দলের উচিত রাস্তায় জ্বালাও-পোড়াও না করে, আন্দোলনের নামে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি না করে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকালও বলেছেন, আলোচনার দরজা খোলা আছে। একই সঙ্গে তিনি বিরোধী দলকে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে যোগদানেরও আহ্বান জানিয়েছেন।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে অবরোধ পালন করছে বিরোধী দল। এর প্রয়োজন ছিল না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদও বলেছেন, দুই পক্ষের সমঝোতা হলে তফসিল পুনর্নির্ধারণ করা হবে। নির্বাচনই যদি বিরোধী দলের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তাদের বলতে হবে আপত্তি কোথায়? কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, তারা বলুক। আলোচনার মাধ্যমে সেগুলোর সমাধান করা যাবে। সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিলে তারাও প্রশাসনের অংশ হয়ে যাবে, সে ক্ষেত্রে তারা এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। আর যদি তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে, সেটি ভিন্ন কথা।
সবাইকে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনসংক্রান্ত সবকিছু নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। এখন তারাই ঠিক করবে, কবে ও কোথায় কাকে নিয়োগ করতে হবে, কাকে বদলি করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে। এত দিন বিরোধী দলই নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যখন সেনা মোতায়েনের কথা বলছে তখন বিরোধী দলের সুর পাল্টে গেছে। এটি স্ববিরোধিতা।
ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিক সমস্যা সমাধানে গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে সংকট সমাধানে তাঁর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। তাঁরা কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। আমরা যতটুকু জানতে পারছি, তাতে বিশিষ্ট নাগরিকেরা সংবিধানের ভেতরেই একটি সমাধান বের করতে চাইছেন। এ ব্যাপারে তাঁরা রাষ্ট্রপতিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। আমরা ছয় বিশিষ্ট নাগরিকের এই প্রস্তাবকে সাধুবাদ জানাই। আমরাও এত দিন বলেছি, যা করার সংবিধানের মধ্যেই করতে হবে, সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। কিন্তু বিরোধী দল বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে, এখনো করছে।
আমরা ছয় নাগরিকের এই প্রস্তাব ইতিবাচক বলেই মনে করি। কিন্তু এটি বাস্তবে রূপ নেবে কি না, তা নির্ভর করছে বিরোধী দলের মনোভাবের ওপর। তারা যদি বরাবরের মতো নির্দলীয় বা তত্ত্বাধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থাকে, তাহলে সমস্যার সমাধান কঠিন হবে।
ছয় বিশিষ্ট নাগরিকের আলোচনায় নির্বাচনকালীন সরকারের রুলস অব বিজনেস পরিবর্তনের কথা এসেছে। বিরোধী দল থেকেও প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতার ব্যাপারে আপত্তির কথা জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই একক ক্ষমতার বিষয়টি কিন্তু বিএনপিই সংযুক্ত করে দ্বাদশ সংশোধনীতে। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। তারপর আমরা মনে করি, বিরোধী দল নীতিগতভাবে সংবিধানের আলোকে সমস্যার সমাধান চাইলে রুলস অব বিজনেস নিয়ে আলোচনা হতে পারে। জট খুলে যাবে।
দুই দলের মহাসচিব পর্যায়েও যোগাযোগের কথা আমরা গণমাধ্যমে জেনেছি। সবকিছুই ইতিবাচক দিকে যাচ্ছে বলে আমাদের ধারণা।
সে ক্ষেত্রে ছয় বিশিষ্ট নাগরিকের প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা হতে পারে। আমাদের সদিচ্ছার অভাব নেই। এখন বিরোধী দলকেও এগিয়ে আসতে হবে। হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক পথ পরিহার করে আলোচনায় বসতে হবে। আর আলোচনায় বসলে বিরোধী দলের যে প্রধান দাবি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, সে ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে সেটি সহজেই সমাধান হয়ে যাবে। মৌলিক বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হলে এসব খুঁটিনাটি আলোচনার টেবিলে সমাধান হবে।
বিরোধী দলের নেতৃত্বকে বুঝতে হবে, তাঁরা যা-ই ভাবুন না কেন, বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা এখন নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। তাঁদের মতামত উপেক্ষা করে নেতারা নির্বাচন বর্জন করলে তা তাঁরা মানবেন না। জনগণও তাঁদের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন দেবে না।
ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।