বাংলাদেশের খ্যাতিমান নাট্যকার প্রয়াত সাঈদ আহমদ একবার ওয়াশিংটনে এসে দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়ায় গিয়েছিলেন তাঁর এক বন্ধুর আমন্ত্রণে। রাজধানী লা-পাজের যে হোটেলে তিনি ছিলেন, সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন আট-দশজন বাংলাদেশি। সাঈদ আহমদ ভাবতে পারেননি, বলিভিয়ায় এত বাঙালি আছে। তিনি তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বিশ্বের এই প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁরা কী করছেন? জবাবে তাঁরা বলেছিলেন, বলিভিয়ায় কৃষিজমি বেশ সস্তা এবং তাঁরা একেক জন কয়েক শ একর করে জমি কিনে কৃষিকাজ করছেন। সেখানে এর মাধ্যমে ভালো অর্থ রোজগার করছেন।
নাট্যকার সাঈদ আহমদের রসবোধ ছিল অসাধারণ! তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এখানে আপনাদের দল কটি?’ তাঁরা বিস্মিত কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কিসের দল?’ সাঈদ আহমদ বলেছিলেন, ‘এতগুলো বাঙালি এই দেশে আছেন, এখনো দল করেননি, এ কেমন কথা!’
ওয়াশিংটনে ফিরে এসে সাঈদ আহমদ সবিস্তারে বলেছিলেন আমাদের এই ঘটনা। তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন দলের কথা। কিন্তু হয়তো বিদেশে বাঙালির দলীয় অনুরাগের কথাই বলেছিলেন তিনি।
আমেরিকায় বাঙালির দলপ্রীতি দেশের চেয়েও অনেক বেশি প্রকাশ্য এবং অনেক বেশি জোরালো। এ দেশে এখন বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় আট লাখ। সেই অনুপাতে দলের সংখ্যাও অসংখ্য। বাংলাদেশে যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে, তার প্রায় সব কটির শাখা ও অঙ্গসংগঠন আছে এ দেশে। এগুলোর আবার কেন্দ্রীয় সংগঠন, রাজ্য সংগঠন—এমনকি শহরভিত্তিক সংগঠনও আছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ বা যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির জাতীয় সংগঠন, মেরিল্যান্ড কিংবা ভার্জিনিয়া রাজ্য সংগঠন এবং ওয়াশিংটন বা শিকাগো নগর সংগঠন। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশের কোনো রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠন নেই আমেরিকায়।
এর পরে আছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বা দল। যেমন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সোসাইটি, বাংলাদেশ লিগ, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক ফোরাম—এমনই নানা নামে, নানা ধরনের, নানা সংগঠন। আর এসব সংগঠন আছে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যের প্রায় সব কটিতে এবং ছোট-বড় প্রায় সব শহরেই। তেমনি আছে বাংলাদেশের জেলাভিত্তিক সংস্থা—ময়মনসিংহ সমিতি, চট্টগ্রাম সমিতি, নোয়াখালী অ্যাসোসিয়েশন, রংপুর সমিতি, বগুড়া সমিতি, জালালাবাদ সমিতি ইত্যাদি। এমনকি উপজেলা পর্যায়ের সমিতিও আছে। আরও আছে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের ‘অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন’।
এসব সমিতি বা সংগঠন যে সব সময় শান্তিপূর্ণভাবে ও নির্বিঘ্নে পরিচালিত হয়, তা নয়। দলাদলি, কলহ-বিবাদ এমনকি মারামারির মতো হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটে অনেক সময় সংগঠনের বার্ষিক নির্বাচন বা পরিচালনাকে কেন্দ্র করে অথবা দেশ থেকে সফরে আসা দলীয় নেতা-নেত্রীদের সংবর্ধনা কিংবা বিক্ষোভ প্রদর্শন নিয়ে। আর তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ ডাকতে হয় এবং কখনো কখনো বিবাদ-বিসংবাদ মামলা-মোকদ্দমার আকারে আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
১৯৭৬ সালে ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেওয়ার জন্য আমি যখন ওয়াশিংটনে আসি, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী শহরে কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ছিল মাত্র একটি। এখন ওয়াশিংটন এলাকায় বাংলাদেশ সমিতি গোটা চারেক। এরপর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বার্ষিক বঙ্গ সম্মেলনের অনুসরণে আমেরিকায় শুরু হয় বাংলাদেশিদের সাংস্কৃতিক মিলনমেলা বার্ষিক বাংলাদেশ সম্মেলন। প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ওয়াশিংটনে, আর তাতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ছাড়াও বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বের অন্যান্য শহর থেকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরা যোগ দেন। এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পরে গড়ে ওঠে ‘ফেডারেশন অব বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন আমেরিকা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান—সংক্ষেপে ‘ফোবানা’। তারপর শুরু হয় প্রতিবছর ‘ফোবানা সম্মেলন’ নামে আমেরিকায় বাংলাদেশিদের জাতীয় সম্মেলন এবং এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় একেক বছর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার একেক শহরে। কিন্তু কিছুকাল পরেই অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দলীয় রেষারেষির কারণে শুরু হয় প্রতিবছর দু-তিনটি করে ফোবানা সম্মেলন, একই সময়ে বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী দলের উদ্যোগে।
একবার নিউইয়র্কে এমনই এক ফোবানা সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে ঢাকা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রামাণ্য ইতিহাস রচয়িতা, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর। তিনি এসে জানতে পান যে নিউইয়র্কের পাশাপাশি এই একই সময় বোস্টন শহরে একটি ও কানাডার টরন্টোতে একটি—মোট তিনটি ফোবানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বদরুদ্দীন উমর রাগ করে চলে আসেন ওয়াশিংটনে এবং আমাদের সঙ্গে কয়েক দিন থেকে ফিরে যান ঢাকায়। আরেকবার আসেন ঢাকা থেকে বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক ফয়েজ আহ্মদ। তিনিও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন এবং ওয়াশিংটনে এসে আমাদের কাছে তাঁর বিপর্যয়ের কথা জানান।
সবশেষে গত বছর অনেক চেষ্টা-তদবির করে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলোর মধ্যে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এখন থেকে আমেরিকায় বাংলাদেশিদের জাতীয় সম্মেলন ‘ফোবানা সম্মেলন’ নামে অনুষ্ঠিত হবে মাত্র একটি। কিন্তু পরে দেখা গেল, বাঙালির দলপ্রীতির কাছে হার মানতে হয়েছে এই সিদ্ধান্তকে। ‘ফোবানা’ নামে না হলেও একই সময়ে বিভিন্ন নামে বাংলাদেশ সম্মেলন হয়েছে মোট চারটি—মূল ‘ফোবানা’ ছাড়াও ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে একটি, বোস্টন শহরে একটি ও কানাডার মন্ট্রিয়লে একটি।
অথচ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বার্ষিক সাংস্কৃতিক সমাবেশ বঙ্গ সম্মেলন আমেরিকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে একটি করেই। এ ছাড়া ওয়াশিংটন-বল্টিমোর এলাকার ভারতীয় বাঙালিদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সংস্কৃতি’ রয়ে গেছে বছরের পর বছর ধরে একটিই, ভেঙে দু-তিন টুকরা হয়নি।
বলা বাহুল্য, আমেরিকায় ভারতীয়দের কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা বা অঙ্গসংগঠন নেই। তাদের মধ্যে যাদের রাজনীতি করার বাসনা, তাঁরা যোগ দেন আমেরিকান মূলধারার রাজনৈতিক সংগঠন ডেমোক্রেটিক অথবা রিপাবলিকান পার্টিতে। তাতে বিশেষভাবে উপকৃত হয় এ দেশে ভারতীয় জনগোষ্ঠী এবং বৃহত্তর অঙ্গনে ভারত। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের আমলে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার যে গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদিত হয়, সেটি সম্ভব হয়েছে মার্কিন কংগ্রেসে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের জোর তদবিরের ফলে। এ দেশে এখন ভারতীয়দের জোরালো অবস্থান জাতীয় জীবনের সব পর্যায়ে। আমেরিকার দুটি রাজ্যের নির্বাচিত গভর্নর এখন দুজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিক। তাঁদের মধ্যে একজনের ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন বেশ কয়েকজন ভারতীয়, আছেন আরও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার পদে এবং বিভিন্ন রাজ্যের আইন পরিষদের সদস্য পদে। প্রেসিডেন্টের মন্ত্রিসভার সদস্য পর্যায়ের কর্মকর্তা এআইডির (এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) প্রধান হলেন রাজীব শাহ্ নামের এক তরুণ ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান। এ দেশে ভারতীয়দের এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বিদেশে বসে দেশের রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন পরিচালনার মতো অনাবশ্যক অবান্তর কাজে অযথা শক্তি ক্ষয় না করে এবং দলাদলি নিয়ে নিজেদের মধ্যে অনর্থক দ্বন্দ্ব-কলহে জড়িয়ে না পড়ার কারণে।
বিদেশে বাংলাদেশিদের এই দলপ্রীতি কেবল আমেরিকায় নয়, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী রয়েছে, সেখানেও। দেশের দলীয় কোন্দল-বিবাদ এসব এলাকায়ও একই রকমভাবে স্পষ্ট। তাতে যে কেবল মাতৃভূমির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় তা-ই নয়, বিদেশে নিজেদের সমাজেরও যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তা ছাড়া দলাদলি, বিবাদ-বিসংবাদের কারণে কোনো কোনো সময় প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃতও হতে হয়।
এই পরিস্থিতি সম্পর্কে যাঁরা বিশেষভাবে সচেতন ও উদ্বিগ্ন তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশে বড় যেসব রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে, তাদের তরফ থেকে বিদেশে বাংলাদেশিদের এসব দলের অঙ্গসংগঠন পরিচালনাকে নিরুৎসাহিত করা হলে এবং প্রয়োজনবোধে তা নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হলেই কেবল এই বিপর্যয় থেকে বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মুক্তিলাভ সম্ভব। তবে সম্প্রতি লস অ্যাঞ্জেলেসে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাঙালি অধ্যাপক এ বিষয়ে টেলিফোনে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক দলের ছোট-বড় নেতা-নেত্রীরা আমেরিকা সফরকালে এসব সংগঠন থেকে দলীয় ভিত্তিতে যে সংবর্ধনা-সমাদর পান এবং তা দেশে ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি উজ্জীবিত করার প্রচেষ্টায় ফলাও করে প্রচারের সুযোগ লাভ করেন। তাতে তাঁরা আমেরিকায় বাংলাদেশিদের দলপ্রীতিকে নিরুৎসাহিত করবেন—সে রকম সম্ভাবনা আশা করার কোনো কারণ নেই।
সৈয়দ জিয়াউর রহমান: সাংবাদিক, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক ঊর্ধ্বতন সম্পাদক।