এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্যে সমতার কথা বলা হয়েছিল। সমতার সমাজ গড়তে হলে মেয়ে ও ছেলেশিশুকে সমান সুযোগ দিতে হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এই লেখার প্রতিপাদ্য কিছুটা ভিন্ন। আমরা দিনে দিনে এগিয়ে যাচ্ছি, তাই ভিন্নতর ভাবনাগুলো সামনে আনতে হবে এখনই।
২০০৫ সালে ভারতে জেন্ডার-বিষয়ক একটি কর্মশালার কথা মনে পড়ে। সেখানে এমন দিন কল্পনা করি কি না, যেদিন পুত্রসন্তানের জন্মের সংবাদে মা-বাবা অখুশি হবেন, জানতে চাওয়া হয়েছিল। বলেছিলাম, চাই না এমন সমাজ; কারণ, এটা বৈষম্য। ছেলে ও মেয়েতে বৈষম্য করে সমতার সমাজ গড়া কখনো সম্ভব নয়। এ জন্য সন্তান লালনপালন ও চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আনাটাই জরুরি। নারী-পুরুষের জন্য সমান সুযোগ অসম্ভব, যদি ছেলে ও মেয়ের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা না যায়। নিজের সন্তান যেন ভালো থাকে, সেটা সবাই চায়, সে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক। এ জন্য সন্তানকে সমানভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই।
ছেলে আর মেয়েকে ঘিরে আমাদের স্বপ্নগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আলাদা। কিছু অঘোষিত নিয়ম রয়েছে, যা মেয়েশিশুকে না চাইলেও চাপিয়ে দেওয়া হয়, তেমনি ছেলেকেও। মেয়েরা কোমলমতি, নরম ও বাধ্য হবে আর ছেলেরা ভয়ডরহীন, শক্তিশালী, ডানপিটে—এ ধরনের ধারণাগুলো সমাজে এখনো কঠিনভাবে বিরাজ করছে। ছেলেদের ভালো রেজাল্ট করা খুব জরুরি, কেননা তার একটি ভালো চাকরি লাগবে, মা-বাবাকে দেখাশোনা করতে হবে, সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে শতভাগ। এমন ধারণা শুধু পরিবারে নয়, সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় এর ছাপ দেখা যায়। আমাদের সাহিত্য, গল্প, কবিতা, নাটক, সিনেমা—সর্বত্র ছেলেদের মেয়েদের তুলনায় সেরা হিসেবে উপস্থাপনের বাড়াবাড়ি রয়েছে। এসব সামাজিক আচরণ, বিধিনিষেধ ছেলেসন্তানকে একগুঁয়ে করে তুলতে ভূমিকা রাখে।
ছেলেরা সব সময় নিজেদের সেরা হিসেবে দেখতে চায়। দুর্বলতা প্রকাশ করতে পারে না। ফলাফল কী দেখি আমরা, কোনো ছেলে কারও কাছে প্রত্যাখ্যাত হলে তার মুখ দেখানোর জো থাকে না। সবাই বলে, ‘দেখিয়ে দে’। বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলের আয়-উপার্জন মেয়ের চেয়ে বেশি হতেই হবে, যেখানে একজন বেকার মেয়ের নির্দ্বিধায় বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এর ব্যতিক্রম হলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে আশপাশে। ‘ছেলে রাগলে বাদশা’ এমন বচনও ভূরি ভূরি মিলবে। এই সামাজিক ধারণা ছেলেশিশুকে বেসামাল আচরণের দিকে ঠেলে দেয়।
একটি মেয়ে ইচ্ছে করলে চাকরি না করে সংসার সামলানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু ছেলের বেলায় এমন ইচ্ছার প্রশ্নই ওঠে না। সমাজের সর্বত্র ছেলেশিশুর ওপর এ রকম অলিখিত নিয়ম বেঁধে দিয়ে একদিকে তার ওপর বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে মেয়েশিশুটির ওপর একধরনের কর্তৃত্ব করার জন্য প্রলুব্ধ করছে। ফলে সে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হলে মেয়েটিকে আঘাত করে প্রতিশোধ নেয়। সে মানে না, প্রেমের ক্ষেত্রে দুজনের সম্মতি থাকার দরকার। তার কাছে এটা অবমাননাকর। সে যখন কোনো নারীকে পেতে চায়, যেভাবে হোক পেতেই হবে। এটাও তার শক্তির বহিঃপ্রকাশ। সংসারে অশান্তি? স্ত্রীকে খুব সহজেই লাঞ্ছিত করে নিজের বাহাদুরি দেখায়; কারণ, সে পুরুষ। স্ত্রীর ভালো চাকরি কিংবা সুনামে হীনম্মন্যতায় ভোগে; কারণ, তারই সেরা থাকার কথা ছিল। এ জন্য তাকে সমাজ থেকেও দুকথা শুনতে হয়। ছেলে–ছেলেতে বিবাদ, সেখানে শক্তি দিয়ে যতটুকু সম্ভব জোর খাটিয়ে প্রমাণ করতে হবে কে সেরা। সিনিয়র-জুনিয়র নিয়ে ছেলেদের যত ভয়ংকর রকমের যুদ্ধ, তা আর কারও বেলায় নেই। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে আমাদের চারপাশে।
এই চিন্তার বীজ বপন করেছি আমরাই। আমাদের চলন–বলনে প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন আচরণের মধ্য দিয়ে এই বার্তা পৌঁছে গেছে সর্বত্র। প্রত্যাশার বাড়াবাড়ি ছেলেসন্তানকে মাঝেমধ্যে দানবে পরিণত করে। এর জন্য আমি, আমরা সবাই দায়ী। আমরাই শিখিয়েছি তুমি ছেলে, অতএব তোমার কোনো দুর্বলতা থাকতে নেই। তাই তারা কোথাও হারতে চায় না। তাকে শেখাতে হবে—হারজিত জীবনের অংশ। এখন এই বিভেদ দূর করতে ছেলেসন্তানের ওপর প্রত্যাশার চাপ কমাতে হবে। দায়িত্বগুলো মেয়েকেসহ ভাগ করে দিতে হবে, যেন সবাই নিজেকে সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে পারে। আমাদের সন্তানেরা আমাদের অনুকরণ করে থাকে।
তাই আমাদের নিজেদের আচরণ পরিবর্তনে উদ্যোগী হতে হবে। বিশেষ করে মেয়ে আর ছেলেশিশুর মধ্যে সেরা থাকার প্রবণতা দূর করার বিকল্প নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেখানে পৌঁছাতে হলে নারী-পুরুষের সমতার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
শিশুর প্রতি, শিশুর জন্য সংবেদনশীল হতে হবে আচরণে, কথায় ও কাজে। প্রত্যেককে এই অভিযানে অংশ নিতে হবে। সমতার বিশ্ব বিনির্মাণে সবাইকে সজাগ থেকে নিজ নিজ দায়িত্বটি পালন করতে হবে। শিশুকে গতানুগতিকভাবে উপস্থাপন থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেশিশুটিকে রক্ষা করতে হবে শতভাগ সফল হওয়ার চাপ থেকে; তেমনি স্বপ্ন বুনতে হবে মেয়েশিশুকে ঘিরে। মেয়েশিশুর গন্তব্য শুধু বিয়ে—এখনো বেশির ভাগ মানুষের চিন্তা-চেতনায় এই প্রবণতা অনেক বেশি। সেখান থেকে বেরিয়ে মেয়েটিকে নিয়েও স্বপ্ন দেখতে হবে। তাতে ছেলেটির কাঁধের বোঝা হালকা হবে এবং নিজের প্রাপ্য সম্মান পাবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বদল হওয়া খুব জরুরি। সমাজের প্রতিটি কোনায় কোনায় মেয়ে আর ছেলেশিশুর প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ রয়েছে, সেগুলোকে উপড়ে ফেলতেই হবে। আমাদের স্বপ্নগুলোকে সমানভাবে মেয়ে আর ছেলেতে ভাগ করে দিতে হবে। তবেই সমতার সমাজ গড়া সম্ভব হবে একদিন।
রাশেদা আক্তার, সেভ দ্য চিলড্রেনের সিভিল সোসাইটি অ্যান্ড পলিসি অ্যাডভোকেসি-বিষয়ক ম্যানেজার