শহরে যারা ভাড়া থাকে, ঈদে তাদের তাড়া থাকে। যাওয়ার তাড়া। গ্রামে যাওয়ার তাড়া। শহরে তাদের ফ্ল্যাট নাই। গাড়ি নাই। বাড়ি নাই। কিন্তু ‘দেশের বাড়ি’ আছে। শহর থেকে দূরে সেই বাড়ি। বাসে কিংবা ট্রেনে, লঞ্চ কিংবা প্লেনে সেই বাড়িতে যেতে হয়। সে বাড়িতে নিদেনপক্ষে এক ফালি উঠোন আছে। উঠোনের কাছেপীঠেই বুনো কচু কিংবা কাগজিলেবুর ঝোপ আছে। সেই ঝোপে শয়ে শয়ে মশা অথবা জোনাকি ওড়া সন্ধ্যা আছে। সন্ধ্যায় ঘরের ভেতর জায়নামাজে নামাজরত আব্বা কিংবা আম্মা আছে।
কাজের চাপে সেই বাড়ির কথা সারা বছর ভাড়াটেরা মনে করতে পারে না। আর ঈদের সময় চেষ্টা করেও সেই উঠোন, সেই কাগজিলেবুর ঝোপ, সেই শয়ে শয়ে জোনাকিজ্বলা সন্ধ্যা ভুলে থাকতে পারে না। বাড়ি ডাকে। নাড়ি ডাকে। মনে পড়ে দেশের বাড়ি। মনে ভেসে যায় অলকানন্দা-মধুমতির জলে। ফলে বাস ভরে যায়। লঞ্চ ভরে যায়। গাদাগাদি। ঠাসাঠাসি। হুড়োহুড়ি। আস্তে আস্তে আস্ত একটা ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে যায়।
দেশের বাড়ির ফাঁকা ঘর আপনজনে ভরে ওঠে। দাদির কোলে, নানির কোলে শহরফেরত ‘ফুলবাবুরা’ ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাঁপিয়ে ওঠা জীবনগুলো প্রাণ ফিরে পায়। চাঁদ উঠলে পাড়ায় পাড়ায় লাউডস্পিকার...। মফস্বলের মোড়ে মোড়ে ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে...’ রাত অবধি বাজতে থাকে।
ঈদকেন্দ্রিক এ ধরনের একটা কাব্যিক ছবি এখনো টিকে আছে। সেই ছবির টানেই ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় মহানগর ছেড়ে এখনো মানুষ নাড়ির টানে ছুটে যায়।
গত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে মানুষ কোথাও নড়তে পারেনি। কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে দিশেহারা হয়েছিল। গ্রাম আর শহরের স্বজনেরা ঈদের আনন্দে এক হতে পারেনি। এ বছর মুক্তির মহানন্দে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো মানুষ ছুটেছে তার বসতভিটায়। বেসরকারি হিসাব বলছে, শুধু ঢাকা থেকেই এক কোটির বেশি মানুষ ঈদ করতে দেশের বাড়ি গেছে। গেল দুই বছরে মহামারির কারণে যে অসহ্য অশান্তি আর আতঙ্কের গুমোট ভাব সারা দেশকে স্তব্ধ করে রেখেছিল, সেই বিষণ্ন সময় কেটে গেছে।
স্বস্তির কথা, এখন পর্যন্ত বড় কোনো বাস দুর্ঘটনা বা লঞ্চডুবির মতো খারাপ খবর পাওয়া যায়নি। আনন্দের কথা, ঢাকা শহরের রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি-ঘোড়ার ব্যস্ততা নেই। ফাঁকা রাজপথ যেন নাগরিক সৈকত। রিকশা-ভ্রমণে মেতেছে নগরবাসী। গুষ্টিসুদ্ধ র্যাশানের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে যে করুণ কেরানির জিব বের হয়ে যায়, সে-ও ফ্যাশান করে চুল আঁচড়ে বউয়ের গায়ে ঠ্যাশান দিয়ে রিকশায় ঘুরছে। জ্যামে-ঘামে জবজবে জীবন থেকে দুদিনের এই মুক্তি ঈদ ছাড়া আর কে কবে দিয়েছে?
বেদনার কথা, এই ঈদেও ঢাকাসহ বড় বড় শহরের রাস্তায় কিছু ঘরহীন শিশু, নারী, বৃদ্ধ শুয়ে থাকবে। প্রবীণ নিবাসে বসে কিছু বয়স্ক মানুষ দূর পরবাসে থাকা কোটিপতি সন্তানের মুখ কল্পনায় দেখতে দেখতে বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ছুড়ে দেবেন। মান্ধাতা আমলের বাপ-মাকে রেখে দূরের কোনো এক আলিশান ফ্ল্যাটে সন্তানেরা তাদের তুলতুলে আধুনিক সন্তান নিয়ে ঈদের আনন্দে ডুবে থাকবে। সারা মাস হাড়ভাঙা খাটুনির পর ঈদের আগে বেতন-বোনাস থেকে বঞ্চিত হওয়া কিছু পোশাককর্মী সাত শ টাকা কেজির গরুর মাংস কিনতে না পেরে শিশুসন্তানদের মুখের দিকে চাইতে পারবেন না। তাঁদের কেউ কেউ ঈদের দিনে প্রাণপ্রিয় সন্তানের গায়ে পুরোনো জামা পরাতে পরাতে তাদের গরুর মাংস না খাওয়ার উপকারিতার বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিতে থাকবেন। এ সময় তাঁদের কারও কারও চোখ অহেতুক ভিজে উঠতে থাকবে।
এসব হাসি-কান্নার মেঘ-রৌদ্রের লুকোচুরির মধ্যে আজ ঈদের চাঁদ উঠবে। নবজাতক সেই চাঁদ সবার কাছে শতভাগ সৌন্দর্য নিয়ে হয়তো ধরা দেবে না। তবু সে বলবে রাত পোহালেই ঈদ। তবু সে বলবে, ‘একদিন নয় হাসিবি তোরা, একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া, সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা’... ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]