ঈদ-পূজাপার্বণ শেষ হলো।
মানুষের জীবনে সেই অনাদিকাল থেকেই উৎসব করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সারা বছর চাষ করে নতুন ধান ঘরে তোলার নবান্নের উৎসবে এখনো গ্রামগঞ্জের মানুষ মেতে ওঠে। উৎসব আসে সাধারণত অনেক কাজের শেষে। মানুষ যখন একটানা কাজ করে ক্লান্ত, তখন চায় একটু বিনোদন, একটু বিশ্রাম। সারা দিন খেতে কাজ করা কৃষকও সন্ধ্যায় দাওয়ায় বসে হুঁকো মুখে খানিক গালগল্পে জিরিয়ে নেন। কবি দার্শনিক মার্ক টোয়েন বলেন, ‘ঘুমানো আর বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া আমি অন্য কোনো ব্যায়াম করি না।’ আর নারীরা বলে, ঘুমানো আর বিশ্রাম ছাড়া তাদের অন্য কোনো বিনোদন নেই।
উৎসব দেয় আনন্দ, দেয় শক্তি, কাজ করার প্রেরণা, সক্ষমতা, সর্বোপরি পুনরুদ্দীপনা। কিন্তু নারীর সময় কোথায় আনন্দ আর বিশ্রামের? ছোটবেলায় নানি-দাদি-মা-খালাদের দেখেছি, ঈদের দিন খুব ভোরে গোসল সেরে রান্নাঘরে ঢুকতেন। অনেকে মচমচে নতুন শাড়ি কোমরে পেঁচিয়ে এক হাতে ঘোমটা আর এক হাতে সেমাইয়ের হাঁড়ি সামলাতেন। পাশের বাড়ির মাসিমারও ফুরসত ছিল না পূজার দিনগুলোতে। তাঁর পুত্রবধূদের নিয়ে মধ্যরাত অবধি ঠাকুরের প্রসাদ বানাতেন। ‘কাদাখেড়’ বলে পূজার সময় উঠোনে পানি ঢেলে বাড়তি কাদা এনে তার ওপর নাচানাচি করা হতো। সাধারণত পুরুষেরাই নাচত আর একে অন্যকে কাদা মাখাত।
ঈদে নারীরা রাত জেগে বিভিন্ন পদের রান্না করে। শুতে শুতে প্রায় ভোর। আবার তাকেই সবার আগে উঠে নামাজে যাওয়ার জন্য পুরুষদের প্রস্তুত করানোর অনুষঙ্গ গুছিয়ে দিতে হয়। কোরবানির পশু কেনা পুরুষদের জন্য বেশ ঝক্কির কাজ বটে। তবে আনন্দও কম নয়। তারপর কসাই দিয়ে মাংস বানিয়েই মশাইয়ের ছুটি। রান্নাসহ পরবর্তী কষ্টসাধ্য কাজগুলো নারীর ওপর ছেড়ে দিয়ে বাটি ভরে কষা মাংস খাওয়ার জন্য দফায় দফায় তাড়া। নারীর কাজের শেষ নেই। তবু পুরুষেরা বলে, ‘আমার বউ কোনো কাজ করে না’।
সেই কৌতুকটা শোনাতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে, ‘এক উচ্চপদস্থ চাকুরে। ধরা যাক তার নাম মি. ওয়াই। নয়টা-পাঁচটা চাকরি করে আর বাসায় ফিরে স্ত্রীকে দেখে ঈর্ষান্বিত হয়। কারণ, স্ত্রী কোনো কাজ করে না। কী আরামেই আছে! মি. ওয়াই ঈশ্বরের কাছে কান্নাকাটি করল—‘হে ঈশ্বর, আমি কাজ করতে করতে ক্লান্ত। অন্তত দিন কয়েকের জন্য হলেও আমাকে আমার স্ত্রী করে দাও আর আমার স্ত্রীকে আমি। আমি একটু ঘরে বসে আরাম করতে চাই। আমার স্ত্রীও বুঝুক, আমি কী খাটনিটা করি! তো ঈশ্বরের মায়া হলো। তিনি তা-ই করলেন। মি. ওয়াই সকালে উঠেই দেখতে পেল, বিধাতার বরে সে স্ত্রীতে পরিণত হয়েছে আর তার স্ত্রী হয়েছে তার স্বামী।
মহাখুশি মি. ওয়াই বিছানায় শুয়ে শুয়ে চাদরে পা ঘষতে লাগল। ওহ্ কী মুক্তি! সকালে উঠে দাড়ি কামানোর ঝামেলা নেই, গরম চায়ের কাপ মুখে সাততাড়াতাড়ি পেপারে চোখ বোলানো নেই, কেতাদুরস্ত হয়ে অফিসে ছোটা নেই—এই জীবনের কোনো বিকল্প আছে?
ভাবতে না-ভাবতেই স্বামীর এক ধমকে গাত্রোত্থান করতে হলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাথরুমে গরম পানি সরবরাহসহ নাশতার টেবিল রেডি করার হুকুম হলো। নাশতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিখুঁতভাবে পলিশ করে স্বামীর পায়ের কাছে মোজাসহ জুতাজোড়া এগিয়ে দিতে হলো। হট পটে লাঞ্চের জন্য তিন-চার পদের খাবার ভরে দিতে হলো। এরই মধ্যে ছোট ছেলে ঘুমের মধ্যে বিছানা ভিজিয়ে চিলচিৎকারে পাড়া মাথায় করছিল। ওর ন্যাপি বদলাতে গিয়ে চশমা-ঘড়ি হাতের কাছে না পাওয়ায় স্বামীর সে কী আস্ফাালন! স্বামী গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলে বড় বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে প্রাতঃক্রিয়াদি সারিয়ে নাশতা গিলিয়ে, টিফিন রেডি করে ঘুমন্ত ছোটটিকে ঘাড়ের ওপর নিয়ে ওকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হলো। স্কুল থেকে ফেরার পথে ছেলে কোলে নিয়েই কাঁচাবাজার সেরে ঘরে ফিরে মুখে চারটে গুঁজে সকালের এঁটো থালাবাসন মাজতে বসল।
খাওয়ার পানি ফুটাতে দিয়ে রাজ্যের কাপড় বাথরুমে ডাঁই করে গোসলটা সেরে দুপুরের রান্নার জোগাড় করতে লাগল। ওরই মধ্যে ঘর মোছা, কাপড় কাচার ঠিকে ঝি এসে পড়লে তার কাছে বাচ্চাটাকে রেখে ছুটল বড়টাকে স্কুল থেকে আনার জন্য। স্কুল থেকে এনে তাদের গোসল করিয়ে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিয়ে ব্যাংকে দৌড়াতে হলো গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল জমা দিতে, ওই দিনই ছিল জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। আসার পথে লন্ড্রি থেকে স্বামীর কাপড় তুলে বিকেলের নাশতার জন্য কনফেকশনারি কিনে বাসায় ফিরল। মিনিট দশেকের মধ্যে স্বামী অফিস থেকে ফিরলে তার ছোটখাটো সেবাসহ চা-নাশতা পরিবেশন করতে হলো।
সন্ধ্যায় স্বামী টিভি দেখতে বসলে সে বাচ্চাকে পড়াতে বসাল। খাবার টেবিল লাগিয়ে বাচ্চাদের কাপড় ইস্তিরির জন্য কাপড়ে পানি ছিটিয়ে রেখে দিল। খাওয়ার পর বাসন ধুয়ে কাপড় ইস্তিরি করতে গেলে বাচ্চারা ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার জন্য চিৎকার করতে লাগল। ওদের ঘুম পাড়িয়ে সারা দিনের ক্লান্তির শেষে বিছানায় পিঠ পড়তে না-পড়তেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে লাগল স্ত্রীরূপী মি. ওয়াই। ভোর না হতেই ছোট বাচ্চাটির চিৎকারে যখন ঘুম ভাঙল তখন স্ত্রীরূপী মি. ওয়াই ঊর্ধ্বলোকে দুহাত তুলে কান্নায় ভেঙে পড়ল—‘হে ঈশ্বর, খুব শিক্ষা হয়েছে, আমি আমার ইচ্ছে উইড্র করছি। প্রভু, আমাকে আমার আগের রূপে ফিরিয়ে দাও।’ জবাবে ঈশ্বরের দৃঢ় অথচ দয়ার্দ্র কণ্ঠ ভেসে এল—‘বৎস, আমি খুব দুঃখিত। আগামী ১০ মাসের আগে সেটা আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। কারণ, তুমি গত রাতে গর্ভধারণ করেছ।’
পাঠক, আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে?
উৎসব যদি পুনরুদ্দীপনার পূর্বশর্ত হয়, তবে তা কেবল পুরুষ ও শিশু-কিশোরদের জন্য। উৎসব মানে নারীর আরও কাজ, আরও শ্রম, আরও উদ্বেগ। উৎসব নারীকে আরও ক্লান্ত করে। যাঁরা বাইরে কাজ করেন না, সেসব নারীরও অবসর নেই আর যাঁরা করেন, তাঁদের তো শ্যাম-কুল দুটোই সামলে চলতে হয়।
এ দেশে ঘরে-বাইরে সমান তালে কাজ করা নারীর অবসরই জোটে না, তার ওপরে পুনরুদ্দীপিত হওয়ার ঈদ-পার্বণ তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।