২৪ বছরের নূর হোসেন আর বড় হননি। তাঁর সে সময়ের সহযোদ্ধারা ধনে-প্রাণে অনেক বড় হয়েছেন। অন্তত দুজন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। মন্ত্রী-সাংসদ-আমলা-মিলিয়নিয়ার কতজন হয়েছেন, তা গুনতে শুরু করলে হাত-পায়ের সব আঙুলেও কুলাবে না। পিঠে ও বুকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লিখে তিনি নিজেকে পুলিশের বন্দুকের নিশানা করেছিলেন। কবরে নামানোর সময় অনেক ঘষাঘষি করেও তাঁর গায়ে লেখা বাংলাদেশের সেই ললাটলিখন ওঠানো যায়নি। পুলিশের যে গুলিটি তাঁর পাঁজরে রক্তজবা ফুটিয়েছিল, সেটিও সেখানেই থেকে গেছে। নূর হোসেনের যে আয়ু আত্মসাৎ করে নিয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি, সেই রাজনীতি আজও গণতন্ত্রকে নূর হোসেনের মতোই বাড়তে দেয়নি।
যাঁরা পতিত এরশাদকে হাত ধরে তুলে এনেছেন, যাঁরা নূর হোসেনের খুনিদের সঙ্গে করে একদলীয় নির্বাচন করছেন, একাত্তরের লাখো নূর হোসেনের খুনিদের নিয়ে যাঁরা গণতন্ত্রের ককটেল পার্টি জমাচ্ছেন, শহীদ নূর হোসেনকে তাঁরা সফলভাবেই বেওয়ারিশ করে দিয়েছেন। এরশাদশাহি নূর হোসেনকে খুন করে রাতের আঁধারে জুরাইনের বেওয়ারিশ কবরস্থানে মাটি চাপা দিল; সেখান থেকে তাঁকে তুলে আনার কথাও মনে হয়নি কারও। নূর হোসেন সেখানে শুয়ে শুয়ে অপঘাতে নিহত সব লাশের বুকে-পিঠে লিখে দেয়, ‘জীবন মুক্তি পাক’। সেখানে তাজরীন আর রানা প্লাজার বেওয়ারিশ শ্রমিকের বোবা প্রতিবাদকে ভাষা দেয় নূর হোসেনের ডাক, ‘অপঘাত নিপাত পাক’।
কোন গণতন্ত্র চেয়েছিলেন নূর হোসেন? নির্বাচনী গণতন্ত্র? জনগণের ক্ষমতায়নের গণতন্ত্র? অবাধে জনগণকে বঞ্চিত করে যাওয়ার লুটেরা গণতন্ত্র? আমৃত্যু নূর হোসেনের বাবা মজিবুর রহমানের পাশে ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূরকে হত্যার ঠিক ১৮ দিন পরে যেনবা বিধির ইশারাতেই শহীদের পিতার বেবিট্যাক্সিতে চড়ে বসেন মতিউর রহমান। সেই থেকে আমৃত্যু চলেছে তাঁদের কথোপকথন। বছরের পর বছর মানুষটির সঙ্গে কথা বলে, লিখে তিনিও বুঝতে চেয়েছেন কীচালিত করেছিল নূর হোসেনকে? কিসের জোরে শহীদের পিতা শোক ভুলে বলতে পারেন, ‘আমার পার্টিবলে কোনো কথা নেই। ভাগাভাগি নেই। আমার ছেলে গণতন্ত্রের জন্যরক্ত দিয়েছে...গণতন্ত্র আসুক এ দেশে।মঙ্গল হোক মানুষের।’
মতিউর রহমানের সে সময়েপ্রকাশিত পাঁচটি লেখা আর কবি শামসুর রাহমানের তিনটি অমর কবিতা নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে সদ্য প্রকাশিত শহীদ নূর হোসেন বই থেকে জেনেছি—মৃত্যুর পরের বছর মজিবুর রহমান তাঁকে বলেন, ‘আমরা গরিব, আমাদের সমস্যা অনেক। গরিবের সমস্যা নিয়ে আমার ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল..।’ তাহলে নূর হোসেন গণতন্ত্র বলতে গরিবের সমস্যা মিটবার কথা ভেবেছিলেন, স্বৈরতন্ত্র বলতে গরিবের শত্রুদের বুঝেছিলেন? জীবন পেশাদার সৈনিকেরাও দেন। গণতন্ত্রের জন্য নূর হোসেন শুধু জীবন দেননি। তার থেকেও বেশি যা দিয়েছেন, তা হলো মনের সবটুকু ভক্তি। সেই ভক্তির সাক্ষ্য দিচ্ছেন সে সময়ের বিরোধীদলীয়নেত্রী শেখ হাসিনা, ‘আমি তাকে কাছে ডাকলাম এবং বললাম তার গায়ের এই লেখাগুলোর কারণে তাকে পুলিশ গুলি করবে। তখন সে তার মাথা আমার গাড়ির জানালার কাছে এনে বলল, আপা আপনি আমাকে দোয়া করুন, আমি গণতন্ত্র রক্ষায় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত।’
সে সময় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ ২২টি দলের যৌথ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, এরশাদের পতন এবং নিরপেক্ষ পরিবেশে নির্বাচন। এরশাদের পতন হয়েছিল, তিনি জেলবাসী হয়েছিলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনও হয়েছিল। কিন্তু এরশাদ মুক্তি পান আর নূর হোসেনের বাবা রোগে-শোকে মরে যান। এরপর স্বৈরতন্ত্র নিপাতের ধ্বনি ক্রমেই কমজোরি হয়েছে, আরও শক্তিমান হয়েছে গণবিরোধী শক্তি। নূর হোসেনের মৃত্যু কি তাহলে বৃথা গেল?
নূর হোসেনকে মহান করে অনেক গল্প, কিংবদন্তি, কবিতা ও বক্তৃতা হয়েছে। জাতীয় পার্টিও নূর হোসেনের হত্যা দিবস পালন করে। যতবার নূর হোসেনের নাম উচ্চারিত হয়, তাঁর সেই অবিস্মরণীয় ছবিটি ছাপা হয়, ততবারই নূর হোসেন যেন আরও দূরে চলে যান। এত আত্মদান এত শহীদান কেন বৃথা গেল? কারা দায়ী? পরাজয়ের ইতিহাস, বীররূপী খলনায়কদের ইতিহাস, জনগণের রক্ত আর অশ্রুকে ধোঁকা দেওয়ার ইতিহাস কীভাবে ভুলিয়ে দেওয়া হলো? নূর হোসেনকে নিয়ে লেখা কবিতায়, কলামে, বক্তৃতায় এর উত্তর নেই। বরং সংগ্রামের গৌরবকীর্তন আর শহীদানের মিথের আড়ালে বিত্ত, ভোগ আর জিঘাংসাকাতর রাজনীতি নিজেদের মহান করার সুযোগ পায়। এই রাজনীতির করাল চেহারা ঢাকতে আন্দোলন-সংগ্রাম আর শহীদ প্রয়োজন। এই রাজনীতি জানে, জীবিত বীরের চাইতে নিহত শহীদ অনেক বিপজ্জনক। তাই শহীদদের ভাবমূর্তি বেহাত হয় আর তাদের লাশ অজানা কবরস্থানে অথবা ইতিহাসের অন্ধকারে বেওয়ারিশ পড়ে থাকে। নূর হোসেনদের নিজস্ব গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধকে আত্মসাৎ করেই তো রাজনীতি থেকে জনগণকে উৎখাত করা সম্ভব হয়। আমরা এরশাদের ওয়ারিশ বহনেরই যোগ্য, শহীদ নূর হোসেনদের নয়!
এরশাদের পতনের পরও মজিবুর রহমানের হতাশা কাটেনি। মতিউর রহমানকে বলেছিলেন তিনি, ‘নূর হোসেন যা চেয়েছিল, তা তো হলো। স্বৈরতন্ত্র নিপাত হলো। এখনো দেশে এত হানাহানি, সন্ত্রাস। গণতন্ত্র তো মুক্তি পেল না।’ ২০০৪ সালে মৃত্যুর আগে বড় দুঃখ নিয়ে বলেছিলেন, ‘ছেলেটা যা চেয়েছিল, তা তো হলো না!’ শহীদ পুত্রের পিতা ভেবেছিলেন, ‘নূর হোসেনের মৃত্যুর পর সবাই আমাকে শ্রদ্ধা জানাল। ভাবতে শুরু করলাম, আমিও একটা ইডবিডি পাখি (যে পাখি স্বর্গে যেতে চায় কিন্তু পারে না) হয়ে গেলাম। আমিও সবার সঙ্গে উড়তে পারব। সেটা আমার ভুল। ইডবিডি পাখি কোনো দিন স্বর্গে যেতে পারে না। এখন কোথায় আমার স্থান?’ নূর হোসেনের মা মরিয়ম বেগম বলেন, ‘দেখেন বাবা, নূর হোসেনের মুখে কি রকম রাগের চিহ্ন!’ বিদায়ের কিছু আগে তিনি মাকে বলেছিলেন, ‘মা, আমি একটা কিছু করার চেষ্টা করছি।’ এখন ২০১৩ সাল, সময় আবার আশাহীন। মানুষের মনে আবারও প্রশ্ন: রাত পোহাবার আর কত দেরি পাঞ্জেরি?
ইতিহাসের দেবতা তরুণের রক্ত পান না করে সন্তুষ্ট হন না। চিরটাকাল নিষ্পাপ সাহসী তরুণেরাই মানবতার হারানো আত্মাকে ওই ‘ইডবিডি পাখির’ মতো স্বর্গীয় উড়ালের স্বপ্ন দেখায়। এই দেশে এ রকম শহীদ তরুণের অভাব কোনো দিন হয়নি। আমরাও বারবার গর্ব করে বলেছি, ‘শহীদের আত্মদান বৃথা যেতে পারে না।’ অহরহ এর প্রতিধ্বনি শুনি রাজপথে আর ক্যাম্পাসে। কিন্তু দিনের শেষে সব আশার সমাধিতে দাঁড়িয়ে নিষ্ঠুর ভাষায় বলতে হয়: ‘নূর হোসেন, তোমাদের আত্মদান যে আমরা কতবার বৃথা করে দিয়েছি, তোমার বাবা মৃত্যুর আগে সেটা দেখে গিয়েছেন; তুমি সৌভাগ্যবান, তুমি তা দেখোনি।’ যে গণতন্ত্রে জীবিত বা মৃত উভয় অবস্থাতেই মানুষের জীবন বৃথা হয়ে যায়, সেই গণতন্ত্রের কথা তো নূর হোসেনেরা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। নূর হোসেনের বেবিট্যাক্সিচালক পিতাও বদলে গিয়েছিলেন। সংগ্রাম আর ত্যাগ তাঁর মনের মধ্যে ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ দেখার জেদে অধীর করে তুলেছিল। কিন্তু সকলই গরল ভেল!
নূর হোসেনই আমাদের শেষ জাতীয় শহীদ। তাঁর আত্মদানের বিশুদ্ধতা, সংগ্রামী সংকল্প নিয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই। এর পরে অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আর কোনো বীরকে নিয়ে এত আবেগাকুল হইনি আমরা। শহীদ হওয়ার সুযোগও এখন কম। তেমন সংগ্রাম থাকলেও স্বীকৃতি দেওয়ার মন মরে গেছে অনেকের। এখন বিশ্বজিতেরা অকারণেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়, এখনকার নূর হোসেনেরা মনিরের মতো আগুনে পুড়ে মারা যায়। আমাদের সময়ের নায়ক-নায়িকারা পুড়ে বা ধসে মরে মৃত্যুর কারখানায়। এঁরা কেউ শহীদের মর্যাদা পান না, তাঁদের আপনজনেরা ত্যাগের মহত্ত্ব অনুভব করেন না। ঠিকানাহীন তাঁদের অনেকের শেষ ঠিকানা হয় নূর হোসেনের কবরের আশপাশে।
মানবেতিহাসে বন্দিত শহীদেরা সর্বদাই তরুণ ছিলেন। সেই তরুণেরা নিপীড়ক আর নিপীড়িতের মাঝখানে এমন দেয়াল তুলে দেন, যে দেয়াল ভাঙা নিপীড়কদের পক্ষে কঠিন হয়। শহীদদের প্রায় ৯৯ ভাগই পুরুষ। তবে এই নিয়মের ব্যতিক্রম আমাদের প্রীতিলতা কিংবা পেরুর বিপ্লবী নারী জানেট তালাভেরা। মৃত্যুর পর ১৯৯২-৯৩ সালে সে দেশের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পোস্টারে তাঁর ছবি দিয়ে লেখা হয়: ‘মৃত্যুর পরও একের পর এক লড়াই জিতে যাচ্ছে জেনেট তালাভেরা’। কিন্তু আমরা কি বলতে পারব, মৃত্যুর পরও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে একের পর এক লড়াই জিতে যাচ্ছে নূর হোসেন? আজকের বাংলাদেশে নূর হোসেনেরা কেবলই হেরে যাচ্ছে, বেওয়ারিশ হয়ে থাকছে। মৃত্যুর পর যে শহীদি জীবনে সংগ্রামের প্রতীক হলেন নূর হোসেন, সেই সংগ্রামে ডানপন্থীরা তাঁকে পরিত্যাগ করল, আর বামপন্থীরা হলো উদাসীন।
ব্রিটিশ মনীষী টমাস কার্লাইল বলেছিলেন, তোমরা আমাকে বীর দাও, আমি তোমাদের ট্র্যাজেডি উপহার দেব। উদিত দুঃখের দেশ বাংলাদেশ যুগে যুগে বীরের জোগান জারি রেখেছে। সেই বাংলাদেশ যাঁরা বিভিন্ন দলে ও প্রতিষ্ঠানে থেকে চালান, তাঁরা আজও অবিরতভাবে নতুন বীরদের ট্র্যাজিক করছেন, আর অতীতের ট্র্যাজেডিগুলোকে করে তুলছেন মর্মান্তিক পরিহাস! নূর হোসেনকে নিয়েলেখা কবি শামসুর রাহমানের কবিতাটাই সত্যহয়, ‘বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে!’ আজও।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]