প্রতিবছরের মতো এবারও কিছুদিনের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতকার্য বিদ্যার্থীদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য ছোটাছুটি আরম্ভ হবে। পরীক্ষার্থীরা প্রস্তুত, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে ব্যস্ত। এখন কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ভর্তির কাজ সম্পন্ন করবে মাত্র। তবু সারা দেশের এ প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হতে আরও মাস চারেক লেগে যাবে। সময় ব্যয় বা প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কথা স্মরণ করে বিস্মিত বা আতঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে নিশ্চয়ই। বহুদিন ধরে চলে এসেছে যে প্রক্রিয়া, সে প্রক্রিয়ায় কেউ হাত দিতে চান না, সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় মাল্টিপল চয়েজ কোয়েশ্চেন (এমসিকিউ) পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতির চেয়ে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির ব্যবস্থা নিলে তা আরও উত্তম হতো, সে মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করা যেতেই পারে। কিন্তু হাজার হাজার পরীক্ষার্থী এবং বহু ও বিচিত্র বিষয়—এসব কিছু বিবেচনা করলে যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে, তাকে এককথায় পুরোপুরি বাতিল বোধ করি করা যাবে না, সংস্কার করা যেতে পারে মাত্র। কিন্তু আপাতত আমরা সে কথা বলছি না। আমাদের বক্তব্য অন্যত্র। এমসিকিউ পদ্ধতিতে প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরটি দেওয়াই থাকে, সেখান থেকে শুদ্ধ উত্তর শুধু বেছে বের করতে হয়। খুবই কাছাকাছি একাধিক উত্তরের মধ্যে ঠিক উত্তরটি বেছে বের করা সহজ নয়। আবার ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কর্তন-ব্যবস্থাও আছে। ফলে উত্তরদাতা পরীক্ষার্থীরা সচেতন হয়ে উত্তর না দিলে প্রাপ্ত নম্বর তলানিতেও ঠেকতে পারে। দেখা গেছে, পরীক্ষার্থীরা সত্যি সচেতন। কিন্তু এই সচেতনতার সুফল সবার ললাটে তিলকচিহ্ন হয়ে ফুটে ওঠে না। এর প্রধান কারণ, ভর্তি পরীক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার গ্রেড বা সিজিপিএ মান্য করা। এটা জরুরি কি না—আমাদের বক্তব্য এখানেই।
এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমসিকিউ পদ্ধতির পরীক্ষার সঙ্গে প্রার্থীর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের প্রাপ্ত সিজিপিএর যথাক্রমে শতকরা চার ও ছয় ভাগ যোগ করে সমন্বিত নম্বর প্রকাশ করা হয়। যেমন, ১২০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষায় সে কত পেল, তার সঙ্গে যোগ হবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের প্রাপ্ত সিজিপিএ ভিত্তিতে ৮০-তে আহরিত নম্বর। অর্থাৎ ২০০ (১২০+৮০) নম্বরের মধ্যে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বরের ধারাবাহিকতায় একজন শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন পায়। দেখা যায়, ৮০-তে অনেক সময় যে বিস্তর নম্বর-পার্থক্য হয়ে যায়, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরীক্ষায় (এমসিকিউ পদ্ধতির) ভালো করার পরও বহুজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। অথচ ৮০ নম্বরের মধ্যে প্রাপ্ত নম্বর এক অর্থে ‘অসমন্বিত’। অসমন্বিত এ কারণে যে এখানে বিভিন্ন বোর্ডের পরীক্ষার্থীরা থাকে, যে বোর্ডগুলোর পাসের হারে অনেক সময়ই দেখা যায় বিস্তর ফারাক। যেমন, এবার এইচএসসি পরীক্ষার ফল: বোর্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম পাসের হার চট্টগ্রাম বোর্ডে (৬১.২২%), সবচেয়ে বেশি পাসের হার সিলেট বোর্ডে (৭৯.১৩%)। দুই বোর্ডে পাসের হারে শতকরা প্রায় ১৮ ভাগ পার্থক্য হয়ে গেছে। আবার এ বছরই মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের শতকরা হার ৯১.৪৬। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বোর্ডের সঙ্গে এর পার্থক্য শতকরা ৩০ ভাগের ওপর। পাসের হারের এই ব্যাপক তারতম্যে পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্ত সিজিপিএর পার্থক্যও অনুধাবন করা যায়। যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে তাতে এবারের জন্য স্বাভাবিকভাবেই ৮০ নম্বরের মধ্যে মাদ্রাসা ও সিলেট বোর্ডের প্রার্থীরা এগিয়ে থাকবে। শুধু এগিয়েই থাকবে না, খুবই ভালো অবস্থানে থাকবে। অবশ্য এই পদ্ধতিতে বরাবরই মাদ্রাসা থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা ভর্তি-পরীক্ষায় সুবিধা পেয়ে আসছে এবং এতে বঞ্চিত হয়েছে সাধারণ বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। এই অসমন্বিত অবস্থা দূর হওয়া প্রয়োজন।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে যেখানে এক নম্বর কম পাওয়ার অর্থ প্রার্থিত বিষয় থেকে ছিটকে যাওয়া অথবা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারা—সেখানে উল্লিখিত অসমন্বিত অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যখন এই পদ্ধতি চালু হয়েছিল, তখন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের নম্বর মান্য করার ক্ষেত্রে বলা হয়, এ দুটিই পাবলিক পরীক্ষা—তাই এর প্রাপ্ত নম্বর থেকে একটি অংশ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রেও মান্য করা হবে। সূচনাতেই এই পদ্ধতি ছিল অসমন্বিত, এখন তো আরও বেশি অসমন্বিত ও বৈষম্যমূলক। কেননা, পাবলিক পরীক্ষা এখন শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক নয়, পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি মিলিয়ে মোট চারটি পরীক্ষা তাদের জন্য পাবলিক পরীক্ষা। আর এখন ফল নির্ধারিত হয় গ্রেডে এবং নম্বরের স্থানে এসেছে জিপিএ। এখন খাতা মূল্যায়ন ও গ্রেড প্রদানে শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টেছে। তাই যদি প্রশ্ন ওঠে, শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলকে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে মান্য করা হলে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষার ফলকে মান্য করা হবে না কেন? আর দেশের আটটি সাধারণ বোর্ড, একটি মাদ্রাসা বোর্ড, একটি কারিগরি বোর্ডের নম্বর প্রদানে যেখানে ব্যাপক তারতম্য (যেমন, এবার উচ্চমাধ্যমিকে পাসের হারে শতকরা ৩০ ভাগ তারতম্য পরিদৃষ্ট হয়েছে) দেখা যায়, সেখানে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে সমতা বিধান ঘটে কি না, এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। যদি না ঘটে, তাহলে আজ নিশ্চয় তা পরিত্যাজ্য।
এই অসমন্বিত ব্যবস্থা পরিত্যাগ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ যেভাবে চায়, যতটা যাচাইমূলক সম্ভব—প্রশ্ন করুক, ১২০ কেন, ২০০ নম্বরের মধ্যেই এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিক। তারা তাদের মতো যাচাই করে ভর্তি করুক। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সিজিপিএ কেন নেবে, কেন পাবলিক পরীক্ষা পিএসসি ও জেএসসির সিজিপিএ নেবে না, এ বিতর্ক থেকে তারা রক্ষা পাবে; আর কার কত সিজিপিএ সে শতকরা হার নিয়ে যোগ-বিয়োগ করা থেকেও পরিত্রাণ মিলবে।
তাই চলমান পদ্ধতির মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত সিজিপিএ থেকে ভর্তির ক্ষেত্রে নম্বর আহরণের যে ব্যবস্থা আছে, তা বাদ দিয়ে শুধু প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত পরীক্ষায় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে বর্তমানের অসমতা ও বৈষম্য দূর হয়।
সৌমিত্র শেখর: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]