অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই দেশে করোনা শনাক্তের এক বছর হবে। গত ৩০ বছরে ক্রমাগত দারিদ্র্য কমছিল; করোনাকালে দারিদ্র্য বাড়ছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে অগণিত মানুষ। বাড়ছে বৈষম্য বৃদ্ধির হার। এই সংকট মোকাবিলায় প্রধানত ঋণকেন্দ্রিক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে আর এখন শুরু হয়েছে দেশব্যাপী টিকাদান।
বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, শুধু ঋণভিত্তিক প্রণোদনা দিয়ে বাঞ্ছিত পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আর এ ধরনের প্রণোদনা সবার কাছে পৌঁছায়ও না। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে পৌঁছালেও অতি ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী পর্যন্ত যাচ্ছে না। কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ জনগণই অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরশীল। তাই উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না হলে কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান ধরে রাখা যাবে না, সৃষ্টি হবে না নতুন কর্মসংস্থান। ফলে সামগ্রিক চাহিদা বাড়ানো দুরূহ হবে।
বাইরের অভিঘাত মোকাবিলার জন্য সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি না থাকায় হুমকির মুখে পড়ছে ব্যক্তিপর্যায়ে উন্নয়ন অগ্রগতি। তৈরি হচ্ছে নতুন দরিদ্র। একটি সুষম পুনরুদ্ধারের জন্য তাই শুধু ঋণভিত্তিক প্রণোদনায় কাজ হবে না। দরকার গুণগত সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি। তাহলেই কমবে নতুন দারিদ্র্য ও বৈষম্য, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান, বৃদ্ধি পাবে দক্ষতা, নিশ্চিত হবে প্রতিটি নাগরিকের আর্থসামাজিক অধিকার।
সবার জন্য সামাজিক সুরক্ষা
করোনাকালে দারিদ্র্য দূরীকরণে দুটো চ্যালেঞ্জ—নতুন দরিদ্র কমানো এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সার্বিক দারিদ্র্য কমিয়ে শূন্যের মধ্যে নিয়ে আসা। করোনার আগেই দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমছিল। ২০০০-২০০৫ সময়কালে দারিদ্র্য কমার হার ছিল যেখানে ১ দশমিক ৮ শতাংশ, সেখানে ২০১০-১৬ সময়কালে এ হার কমে হয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘নগর আর্থসামাজিক অবস্থা জরিপ-২০১৯’ বলছে, করোনার আগেই মহানগরগুলোতে প্রায় ৮ শতাংশ পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে ক্ষুধা নিয়ে রাত কাটাতে হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস) জানাচ্ছে, করোনায় নতুন ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছে। বিবিএস বলছে, করোনার প্রথম চার মাসেই বেকারত্ব বেড়েছে ১০ গুণ। অথচ এ মহামারির মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২ জন। দারিদ্র্য ও বৈষম্য দুই–ই বাড়ছে।
অভিঘাত মোকাবিলায় বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো পর্যাপ্ত নয়। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পটভূমিসংক্রান্ত এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সামাজিক সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ বাজেটের প্রায় ৩০ শতাংশই অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মচারী এবং তাঁদের পরিবারের পেনশনের পেছনে খরচ হয়। মোট বরাদ্দের প্রায় ৫০ শতাংশ যায় ছয়টি কর্মসূচিতে। মোট ১২৫টি কর্মসূচির মধ্যে বাকি ১১৯টি কর্মসূচির প্রতিটিতে মোট বরাদ্দের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ যায়। মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ হলেও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য বরাদ্দ সামাজিক সুরক্ষা বাজেটের মাত্র ২ শতাংশ। মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ বয়স্ক মানুষ, তাদের জন্য বরাদ্দ ৭২ শতাংশ। অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার কারণে অনেকে বাদ পড়ছে। আবার শর্ত পূরণ না করেও অনেকে সুবিধা পাচ্ছে। যোগ্য না হয়েও ভাতা নেন ৪৬ শতাংশ সুবিধাভোগী।
অথচ সার্বিক সংস্কারের মাধ্যমে এ সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে ২০৩০ সালের টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার করে তোলা যায়।
ক্ষুদ্র ব্যবসায় আর্থিক সহায়তা
ব্যক্তি খাতের প্রতি তিনটি কর্মসংস্থানের দুটিই করে থাকে কুটির, অত্যন্ত ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত (সিএমএসএমই)। মোট ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে ১ লাখ ২১ কোটি টাকার ঋণ, নগদ অর্থ ও খাদ্যসহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন নতুন প্যাকেজ ঘোষণা করে এবং নিয়ম সহজ করেও কাঙ্ক্ষিত জায়গায় ঋণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ছোট ঋণের ঝুঁকির দায়িত্ব নেওয়ার পরও ঋণ বিতরণে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। শিল্প ও সেবা খাতে ঘোষিত প্রণোদনা তহবিলের ৩৩ হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যেই বিতরিত হয়েছে। আর ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণের অগ্রগতি মাত্র ৪৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বিতরণব্যবস্থায় সংস্কার আনা গেলে ঋণপ্রবাহ বাড়বে।
কমেছে সরকারি ব্যয়
করোনার অভিঘাতে সরকারি ব্যয় বাড়াটাই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু প্রকৃত ব্যয় কমেছে। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় চলতি অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে সরকারি ব্যয় কমেছে ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে সরকারি ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৯১ শতাংশ, কিন্তু ব্যয় হয়েছে ১১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এ সময় বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয় কমেছে ২৬ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং পরিচালন ব্যয় কমেছে মাত্র ১ দশমিক ২৮ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
প্রবৃদ্ধির জন্যও দরকার গুণগত সরকারি ব্যয়
হিসাবের গরমিলের অভিযোগ সত্ত্বেও সরকারি ব্যয় প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালক হিসেবে মোট দেশজ উৎপাদনকে দেখানো হয়। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ এক দশক ধরে ২৩ শতাংশের কাছাকাছিতে আটকে থাকায় প্রবৃদ্ধির অংশবিশেষ সরকারি ব্যয় থেকেই আসছিল। মানুষের ভোগ ব্যয় বাড়ায় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। ভোগ ব্যয়ের অন্যতম উৎস প্রবাসী আয়। বিভিন্ন হিসাব বলছে, সেখানেও ভবিষ্যতে ভাটা পড়তে পারে।
বিনিয়োগ, ভোগ, সরকারি ব্যয় এবং রপ্তানি নিয়ে গঠিত মোট দেশজ উৎপাদন বাড়াতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুণগত সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ব্যয় হতে হবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক এবং দেখতে হবে অর্থনীতিতে এটা যেন গুণক প্রভাব সৃষ্টি করে। সর্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যবস্থা করা গেলে মানুষের চাহিদা এবং ভোগ ব্যয় বাড়বে। জনস্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাড়বে কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা। অন্যদিকে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, মানুষের আয় বেড়ে ভোগ ব্যয় এবং সঞ্চয় বাড়বে। গতি পাবে নতুন দারিদ্র্য ও বৈষম্য বিমোচন।
কিন্তু বারবার প্রকল্পের সময়সীমা বাড়ানোর কারণে কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ছে সরকারি ব্যয়। বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, ইউরোপ, চীন এবং ভারতের চেয়ে একটি মহাসড়ক নির্মাণে বাংলাদেশের খরচ বেশি। কিন্তু সড়ক অবকাঠামোর মানের সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল ছাড়া অন্য সব দেশের চেয়ে পিছিয়ে। নকশার ত্রুটির কারণে বিভিন্ন প্রকল্পের আয়ুষ্কাল কমছে। বেতন-ভাতা, গাড়ি ইত্যাদিতে খরচ করার পর প্রকল্প বন্ধের খবর আসছে। এ রকম অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান বজায় থাকছে না। জনগণের অর্থ জনগণের জন্য খরচ হচ্ছে না।
জীবনমান উন্নয়নে সর্বজনীনতা
জনগণের সার্বিক জীবনমানের অগ্রগতি এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সর্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পূর্ণ জীবন চক্রভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। গুণগত সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির মাধ্যমেই নতুন দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রতিটি নাগরিকের আর্থসামাজিক অধিকার নিশ্চিত করা যাবে। সম্ভব হবে সমতাভিত্তিক পুনরুদ্ধার। এ জন্য আবশ্যক সক্রিয় ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন