বিদেশিদের পক্ষে আমাদের উপদেশ দেওয়া সহজ এবং বলা স্বাভাবিক যে তোমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা তোমাদের এবং তোমাদেরই তা সমাধান করতে হবে; তোমাদের প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না যে বাইরের কেউ এই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবে। আমরা এ ধরনের কথা অতীতে ও বর্তমানে কতিপয় ভারতীয় নেতার কাছ থেকেও শুনে আসছি। স্বাধীন ও সম্মানীয় ব্যক্তিদের এই মৌলিক সত্য স্মরণ করে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
এটাও বড় দুঃখজনক যে আমরা সঠিকভাবে এবং বিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের সমস্যার সমাধানও করতে পারছি না। যে জাতি ভোটাধিকার রক্ষা করতে পারে না, ভোটারবিহীন নির্বাচনে যে জাতির নির্বাচিত সরকার গঠিত হতে পারে, সে জাতিকে নানা ধরনের গ্লানি বহন করতেই হবে।
আমরা তো স্বায়ত্তশাসনের জন্য পাকিস্তান আমলে দীর্ঘ সংগ্রাম করেছি। আমাদের মুক্তিসংগ্রামকালে অভ্যন্তরীণ নীতি কী হবে এবং সেই সঙ্গে কারও প্রতি বিদ্বেষ নয় বরং সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের বিদেশনীতি সম্পর্কে আমরা বিশ্ববাসীকে পরিষ্কারভাবে অবহিত করেছিলাম। আমাদের সংগ্রাম রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। অতীতে আমাদের নেতারা অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় যুক্তিসহকারে ও দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্ববাসীকে অবহিত করেছেন যে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মূল্যবোধই হবে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল ভিত্তিও ছিল গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা।
বর্তমানে সমস্যাসংকুল অবস্থা ও মিথ্যার বেসাতি থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা গ্রহণে আমরা এমনই অযোগ্য, অসহায় ও বিবেক-বিবেচনাহীন হয়ে পড়েছি যে, তা চিন্তা করে হতাশাগ্রস্ত না হয়ে পারি না। কে কোথা থেকে আমদানি করল যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র অচল?
স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভারতের ভূমিকার কথা চিন্তা করে এ দেশের গণতান্ত্রিক সমস্যার ব্যাপারে ভারত যে নির্দেশক ও অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেনি, তা বলা ঠিক হবে না। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ নিয়ে বিদেশের পত্রপত্রিকায়ও কম লেখালেখি হয়নি। কংগ্রেস সরকার ছিল বিশেষভাবে শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র। বাংলাদেশে কোনো কিছু ঘটলে তা নিয়ে সরাসরি ভারতের মন্ত্রীবিশেষের কাছে সাহায্য পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠ মিত্রতা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য উপকারে আসত, যদি জনগণকে এই মিত্রতার অংশীদার করা হতো। কিন্তু কংগ্রেস সরকার এমন ভাব দেখাল যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তার অবদান ছিল, তাই আমাদের ওপর বিশেষ কর্তৃত্ব খাটানোর অধিকার কংগ্রেস সরকারের আছে। আমাদের দুর্বল নেতৃত্ব ভারতের অনুগত থাকাটাকেই সুবিধাজনক মনে করেছেন।
কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, দুই সরকারের মধ্যে এই বিশেষ ধরনের সম্পর্ক থাকার পরও গণতন্ত্র রক্ষার সমস্যা আমাদের রাজনীতি ও সরকার পরিচালনায় সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দেয়। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনকে রাজনৈতিকভাবে নড়বড়ে করে দিয়েছে।
গণতন্ত্র ভিন্ন যে স্বাধীনতা, তা কাদের স্বাধীনতা? সেই প্রশ্নের উত্তরই আমাদের খুঁজতে বাধ্য করা হচ্ছে।
এ দেশের সমস্যা এ দেশের জনগণকেই সমাধান করতে হবে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের এই বক্তব্যের তাৎপর্য আমরা বুঝি এবং অনুধাবন করি। তিনি পরিষ্কারভাবে আরও বলেছেন যে ভারত সরকার বৈষম্যমূলকভাবে কোনো ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে সম্পর্ক নয়; বরং তারা জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কে বিশ্বাসী। কিন্তু সেই সঙ্গে বর্তমান ভারত সরকারকেও উপলব্ধি করতে হবে যে বাংলাদেশে বিরাজমান সব সমস্যাই বাংলাদেশের জনগণের তৈরি নয়। এক্ষনে আমাদের জরুরি কর্তব্য হলো কিছুসংখ্যক লোকের জন্য কিছুসংখ্যক লোক দ্বারা স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা। সমস্যা হলো, বর্তমানে রাজনীতি রাজনৈতিক নেতাদের হাতে নেই। ফলে রাজনৈতিক ইস্যু সমাধানকল্পে সমঝোতার রাজনৈতিক প্রস্তাবও নেই। কোনো অর্থবহ আলোচনার জন্য সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ আশা করা দুরাশা মাত্র। অপর দিকে বিরোধী দল টেকনোক্র্যাট দ্বারা পরিচালিত কিংবা পরিবেষ্টিত। এক্ষনে উভয় পক্ষ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার অপব্যবহারের লড়াইয়ে ব্যস্ত।
বহুদিনের ‘শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্র’ এখন তা ‘নির্বাচনবিহীন গণতন্ত্রের’ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। এখন জনগণের শক্তি সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি নয়; বরং কিছু লোকের সমষ্টিগত দুর্নীতিই ক্ষমতার উৎস।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত একটা সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এককথায়, এখন দেশের সরকার যদি দম্ভের সঙ্গে নির্বাচিত বলে নিজেরাই নিজেদের বৈধতা দাবি করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত না হয়েও কোনো সরকারকে বৈধতার জন্য নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না। এরূপ অশুভ দৃষ্টান্ত সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়।
জনগণের ভোটের মোকাবিলায় সাহস না দেখিয়ে আওয়ামী লীগ এটাই সবার কাছে প্রমাণ করল যে তাদের অনুসৃত কোনো নীতিই তাদের জনপ্রিয়তা অর্জনে সহায়ক হয়নি। দলবিশেষকে জনবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যায়িত করে নেতা-কর্মীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হলো। এখন তো দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগকেই এ ব্যাপারে এ দেশের জনগণ আস্থায় নেয়নি। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জনগণ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে এবার অনেক ভোট দিয়েছে। ধর্মীয় জঙ্গিবাদের অভিযোগও সরকার জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করতে পারেনি। স্বাধীনতার শত্রুদের ব্যাপারে কত ভয়ভীতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। সে ব্যাপারেও জনগণ সরকারকে আস্থায় নিতে পারেনি। তারা যেন এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তারাই সবচেয়ে বেশি মূল্য দিয়েছেন এবং স্বাধীনতার ইতিহাসও তাঁরাই বেশি জানেন। কোনো দেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে কারও ভিন্নমত থাকলেই তাকে স্বাধীনতার শত্রু বলা যায় না। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর কার কী আচরণ, তার মাধ্যমেই প্রমাণিত হবে যে কে বা কারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু। আওয়ামী লীগ নেতাদের বোঝা উচিত, তাঁদের যেসব বিজ্ঞ বুদ্ধিদাতা পরামর্শ দিচ্ছেন, তাঁরা জনসমর্থনের আওয়ামী লীগকে জনভীতির আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত করছেন।
জনভীতির কারণে জনবিচ্ছিন্ন একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে জড়িত না হয়ে আওয়ামী লীগকে জনমানুষের দল হিসেবে টিকে থাকার কথা ভাবাই হবে ঐতিহ্যবাহী দলটির সঠিক দায়িত্ববোধের পরিচয়।
ভারত সরকারের সাহায্য-সমর্থনপুষ্ট বর্তমান গণতান্ত্রিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে হলে কেবল ভারত নয়, আমাদের অপরাপর বন্ধুরাষ্ট্রের সাহায্যের প্রয়োজন। দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে হবে, যেখানে ব্যক্তি অপেক্ষা প্রতিষ্ঠান অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। যদি সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ও বৈধতা না থাকে, সে ক্ষেত্রে জনগণের পক্ষে নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করা সম্ভব নয়। কারণ, সরকার তো জনসমর্থনের সরকার নয়। সরকার জনগণের না হলে শান্তি বা সমঝোতা আসতে পারে না। যদি সমঝোতা ও শান্তির পথে সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে হয়, তাহলে কেবল ভারত নয়; আমাদের অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রের সাহায্য একান্তভাবে প্রয়োজন। সরকারেরও বুঝতে হবে, কেবল আস্ফালন এবং লম্বা কথামালার দ্বারা জনগণের বৈধতা অর্জন সম্ভব নয়। জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের ওপরই ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে এ দেশের সম্পর্ক দৃঢ় হতে পারে।
গণতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনাহীন একটি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পরিণতি মুসলিম লীগের মতো হোক, এটা কাম্য হতে পারে না। মুসলিম লীগও পাকিস্তানের স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দাবি করত। কিন্তু তাদের দখলদারি মানসিকতার জন্য জনগণ তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দাপটে পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ভারতের কুকুর বলতেও তাদের বাধেনি। সেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীই আওয়ামী লীগকে শিখিয়ে গিয়েছিলেন যে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের কথাই শেষ কথা।
আমরা দেশে বিরাজমান সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাধানের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। তথাকথিত সমাধানের নামে মিথ্যা সমাধান কাম্য নয়। যারা রাজনৈতিক সমাধানের চিন্তা বাদ দিয়ে কেবল ক্ষমতার জন্য ব্যস্ত এবং ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত, তাঁরা জানেন না যে তাঁরা নিজেদের অজান্তে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছেন।
মইনুল হোসেন: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা