স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী
অন্যদের অবদান অস্বীকার করলে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা বাড়ে না
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সরকার সারা বিশ্বের নেতাদের সশরীর কিংবা ভার্চ্যুয়ালি উপস্থিত করলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যাঁরা সরাসরি যুক্ত ছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্যারেড গ্রাউন্ডে ১৭ মার্চ থেকে ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের উজ্জ্বল উপস্থিতি এই অনুষ্ঠানের মহিমা আরও বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্বের অনেক ক্ষমতাধর দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান ভিডিও বার্তায় সুবর্ণজয়ন্তীর শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এটি অবশ্যই আনন্দের। কিন্তু যে গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল, কারও বার্তায় সেই গণতন্ত্রের হালচাল সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কোনো কথা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সরকার সারা বিশ্বের নেতাদের সশরীর কিংবা ভার্চ্যুয়ালি উপস্থিত করলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যাঁরা সরাসরি যুক্ত ছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে সরকারের কিংবা উপদেষ্টা পরিষদের কেউ বেঁচে নেই; কিন্তু এখনো সে সময়ে সরকারে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন, বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ বেঁচে আছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে নতুন প্রজন্মের কাছে কিছু বলার অধিকার নিশ্চয়ই তাঁদের ছিল।
মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী
অনুষ্ঠানের দুটো দিক ছিল। একটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ বা মুজিব বর্ষ, যা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গত বছরের মার্চ মাসে; কোভিড-১৯-এর কারণে তখন হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে তাঁর জীবনসংগ্রাম, দেশের গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতার সংগ্রামে তিনি যে অসামান্য অবদান রেখেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন, আলোচকদের কথায় তা বিধৃত হবে, ব্যক্তি ও রাজনীতিক মুজিবের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হবে, সেটাই স্বাভাবিক এবং হয়েছেও। এই করোনার প্রকোপের মধ্যেও দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অর্থবহ আলোচনা হয়েছে, যাতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন থেকে শুরু করে অনেক বিদেশি পণ্ডিত ব্যক্তি অংশ নিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে অন্য কোনো নেতাকে নিয়ে আলোচনা হয়তো জরুরি নয়। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যদি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে, তাহলে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি তাঁর সমসাময়িক, তাঁর পূর্বসূরি ও উত্তরসূরি রাজনীতিক এমনকি ভিন্ন দলের নেতাদের কার কী ভূমিকা ছিল, তা-ও উঠে আসতে পারত, আসা উচিত ছিল।
স্বাধীনতার বিবিধ সিঁড়ি
বাংলাদেশের স্বাধিকার তথা স্বাধীনতাসংগ্রামকে আমরা কয়েকটি ধাপে ভাগ করতে পারি। পঞ্চাশের দশকের রাষ্ট্রভাষা ও শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, ষাটের দশকের শিক্ষা ও সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টিতে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা পেশ, আটষট্টিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, মার্চের অসহযোগ আন্দোলন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু যেমন অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি এ কথাও সত্য যে সুহৃদ রাজনীতিক, সহযাত্রী আমলা-সামরিক কর্মকর্তা, সহযোগী নেতা-কর্মী, রাজপথে লড়াকু ছাত্র-তরুণদের সক্রিয় সহযোগিতায় তিনি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন। এমনকি এখন আমরা যাঁদের কার্যক্রমকে হঠকারী বলি, তাঁদের সেই অবস্থান পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে দর-কষাকষিতে বঙ্গবন্ধুকে শক্তি জুগিয়েছে। দেশব্যাপী জনতার মহাকল্লোল ছিল বলেই ছয় দফার আন্দোলন এক দফায় রূপ নিয়েছে। মার্চ-পূর্ব বাংলাদেশ আর মার্চের বাংলাদেশ এক ছিল না।
বঙ্গবন্ধুর সঠিক সিদ্ধান্ত
আমরা মনে করি, ছেষট্টিতে ছয় দফা পেশের পর থেকে একাত্তরের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সঠিক, সুচিন্তিত ও বাস্তবসম্মত। অনেকে ২৫ মার্চ রাতে তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার সমালোচনা করেন। কিন্তু সেদিন তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখেছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত নেতাকে যখন পাকিস্তানিরা দেশদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করল, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ওপর নিধনযজ্ঞ চালাল, তখন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভ করল। তদুপরি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব ছিল না।
মুজিবনগর সরকারে টানাপোড়েন
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে যেমন স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য কী করতে হবে, সে সম্পর্কে দেশবাসীকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, তেমনি আলোচনার দরজাও খোলা রেখেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি ফয়সালা হয়ে যাক। বাঙালি স্বশাসন ফিরে পাক। কিন্তু বর্বর পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলাদেশের মানুষের ওপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিলেন। অর্থাৎ স্বাধীনতার যুদ্ধের সশস্ত্র পর্ব শুরু হলো।
আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদই প্রথম সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যান এবং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য তিনি যখন ভারতের সহায়তা চাইলেন, তখন প্রশ্ন এল তারা কীভাবে, কাকে সহায়তা করবে? আনুষ্ঠানিক সহায়তা পেতে হলে সরকার গঠন করতে হবে। এই বাস্তবতা থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়, যা মুজিবনগর সরকার নামে খ্যাত। মুজিবনগর নামটিও তাজউদ্দীন আহমদের দেওয়া। মন্ত্রিসভার অপর তিন সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ, এইচ এম কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলী। প্রধান সেনাপতি হলেন এম এ জি ওসমানী। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। টানাপোড়েন লেগেই ছিল।
মোশতাকের ষড়যন্ত্র ও পাকিস্তান কানেকশন
লেখক-গবেষক মঈদুল হাসানের লেখা ও অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানতে পারি, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে সরকার পরিচালনা ও বহির্বিশ্ব এমনকি ভারতের সমর্থন আদায় করতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। একদিকে খোন্দকার মোশতাক-মাহবুব আলম চাষী প্রমুখের ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে মুজিব বাহিনীর বিরোধিতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারতের মধ্যেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল; অন্তত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি সই হওয়ার আগ পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নেয়।
আগস্টে মাস ছিল সবচেয়ে সংকটকাল। মোশতাকের প্রতিনিধি হয়ে জাতীয় পরিষদ সদস্য জহিরুল কাইউম কলকাতায় আমেরিকান কনসাল জেনারেলের অফিসে যান পাকিস্তানের সঙ্গে আপস প্রস্তাব নিয়ে। তিনি স্বাধীনতার বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তরুণ ও যুবনেতাদের যে আবেগ, সেটাকেও কাজে লাগাতে চাইলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘আমরা স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দুটোই চাই।’ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল থেকে মোশতাককে বাদ দিয়ে তাঁর ষড়যন্ত্র ঠেকানো হয়।
সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন লাভের জন্য মুজিবনগর সরকারের বহুদলীয় চরিত্র জরুরি হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য প্রথমে এর বিরুদ্ধে ছিলেন। পরে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত সহযোগী ডি পি ধরের হস্তক্ষেপ বা পরামর্শে সেই সমস্যারও সমাধান হয়। সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়, যাতে আওয়ামী লীগের বাইরে দুই ন্যাপের প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহ, জাতীয় কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর ছিলেন। উপদেষ্টা পরিষদকে খুব সক্রিয় করা না গেলেও বামপন্থী নেতা-কর্মীদের প্রশিক্ষণ নেওয়া ও যুদ্ধে যোগদানের সুযোগ প্রসারিত হয়। মোশতাক ছাড়া মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের সমর্থন তাজউদ্দীন পেয়েছেন। বিশেষ করে সৈয়দ নজরুল প্রায় সব কাজে তাঁকে সাহস জুগিয়েছেন।
মুজিব বাহিনীর ভিন্ন পথ
শেষ পর্যন্ত যেই সমস্যাটি জিইয়ে ছিল তা হলো, মুজিবনগর সরকারের বাইরে থেকে মুজিব বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনা। আওয়ামী লীগের যুবনেতাদের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়। তাঁরা মন্ত্রিসভা গঠনেরও বিরোধী ছিলেন। দাবি করেছিলেন বিপ্লবী কাউন্সিল গঠনের। কিন্তু ভারত সরকার সেই প্রস্তাব মানেনি। এরপর জেনারেল উবানের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়, যার চার নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ। ভারতের সর্বোচ্চ মহলে বিষয়টি উত্থাপন করেও তাজউদ্দীন সুরাহা করতে পারেননি। ভারতও চায়নি ‘এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখা হোক’। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল একাত্তরেই।
গণযুদ্ধ বনাম আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তান ও ভারতের মতো গোলটেবিল বৈঠকে আসেনি। এসেছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। এটি ছিল গণযুদ্ধ। কতিপয় রাজাকার-আলবদর বাদে প্রত্যেক মানুষ যার যার অবস্থান থেকে স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ কখনো গণযুদ্ধের চরিত্র মেনে নেয়নি। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে যদি আমরা কেবল মুজিবনগর সরকার এবং এর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কথা বলি, তাহলে অন্যায় হবে। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা কিংবা সরকার গঠনের আগেই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে জনপ্রশাসনের যেসব বাঙালি কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য, ইপিআরের সদস্য, পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা শুরু হওয়ার পরপরই
বিদ্রোহ করেন।
অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম প্রহরে যেমন পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে, তেমনি তারা লক্ষ্যবস্তু করে ইপিআর ও পুলিশ সদর দপ্তর। বিভিন্ন স্থানে বাঙালি সেনা ও পুলিশকে নিরস্ত্র করা হয়। মোশতাক আহমদের মতো কোনো কোনো রাজনীতিক পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপসরফার চেষ্টা করলেও তাদের সেই সুযোগ ছিল না। পাকিস্তানিরা জয়ী হলে এদের সবার কোর্ট মার্শাল হতো, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। একইভাবে জনপ্রশাসনের যেসব বাঙালি কর্মকর্তা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরাও চিন্তা করেননি কবে সরকার গঠিত হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, ২ লাখের বেশি নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগ ছিলেন সাধারণ মানুষ, গ্রামের কৃষক, শহরের শ্রমিক কিংবা ছাত্র-তরুণ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা তাঁদের কথা কতটা মনে রেখেছি?
উপেক্ষিত স্বাধীনতাসংগ্রামীরা
একাত্তরে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা আ স ম আবদুর রব বলেছেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুজিবনগর সরকার উপেক্ষিত থেকেছে। কেবল মুজিবনগর সরকার নয়, উপেক্ষিত থেকেছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকেরাও (মুজিব বাহিনীসহ)। মুক্তিবাহিনীর যেসব সেক্টর কমান্ডার বেঁচে আছেন, তাঁদের কথা শোনা থেকেও জাতি বঞ্চিত হয়েছে। অথচ কয়েক বছর আগেও ভারতের স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের নিয়ে আলাদা অনুষ্ঠান হতো। এখন আর কেউ বেঁচে নেই।
ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রধান নেতা করম চাঁদ গান্ধী। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা দিবসে এককভাবে তাঁকেই স্মরণ করা হয় না, স্মরণ করা হয় সুভাষ বসু, জওহরলাল নেহরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল, অম্বেদকারদেরও। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামেরও প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অবশ্যই আমরা তাঁর অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করব। তাই বলে যাঁরা ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, যাঁরা মোশতাক চক্রের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে স্বাধীনতার সংগ্রামকে সফল করেছেন, কেন তাঁদের অবদানকে স্বীকার করলাম না? কেন সুবর্ণজয়ন্তীতে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মাওলানা ভাসানী, মণি সিংহ কিংবা মোজাফ্ফর আহমদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানানো হলো না?
অন্যদের ছোট কিংবা তাঁদের অবদান অস্বীকার করলে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা বাড়ে না। ইতিহাসে যার যা প্রাপ্য, দিতেই হবে।