সাংবাদিক এবিএম মূসা প্রয়াত হলেন গত এপ্রিল মাসে। তার মাত্র দুই মাসের মধ্যে চলে গেলেন মাহবুবুল আলম। বাংলাদেশে এখন আমাদের সময়ের পঞ্চাশের দশকের আর কোনো সাংবাদিক রইলেন কি না জানি না৷ তবে প্রবীণ সাংবাদিকের সংখ্যা নিঃশেষিতপ্রায়।
মাহবুবুল আলম বয়সে আমার চার বছরের ছোট, কিন্তু তাঁর সঙ্গে বয়সের বেড়া অতিক্রম করে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লাগেনি খুব একটা। তাঁর সাংবাদিকতার শুরু ১৯৫৭ সালে তখনকার বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানের (এপিপি) রিপোর্টার হিসেবে। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় সে সময়েই৷ তবে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ হয় সত্তরের দশকে, যুক্তরাষ্ট্রে। আমি তখন ওয়াশিংটনে ভয়েস অব আমেরিকার বেতার সাংবাদিকতায় নিয়োজিত, আর মাহবুবুল আলম বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস কাউন্সিলরের দায়িত্বে।
তার আগে মাহবুবুল আলম ঢাকায় সাংবাদিকতা করেছেন ইংরেজি পত্রপত্রিকায় এবং ষাটের দশকে আলতাফ হোসেন সম্পাদিত করাচির ইংরেজি দৈনিক ডন-এর নয়াদিল্লি সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন বেশ কিছুকাল। সে সময় তরুণ সাংবাদিক মাহবুবুল আলম বিশেষ খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন ১৯৬৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের এবং ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতীয় লোকসভার উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্কের খবরাখবর পরিবেশন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে তাঁর সঙ্গে কলকাতায় যান ঐতিহাসিক ইন্দিরা-মুজিব বৈঠক উপলক্ষে। ওই বৈঠকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সম্মত হন বাংলাদেশ থেকে সব ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার এবং এই সুখবর অপেক্ষমাণ বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের কাছে প্রথম প্রকাশ করেন বাংলাদেশের প্রেস সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম।
মাহবুবুল আলম ১৯৭৮ সালে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস কাউন্সিলরের দায়িত্বে যোগ দেওয়ার আগে ১৯৭৬ সালে প্রেস কাউন্সিলর ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে। তিনি তাঁর অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময়ের সাংবাদিকতার জীবনে বার্তা সংস্থা ও পত্রপত্রিকা ছাড়াও নিয়োজিত থেকেছেন দূতাবাসের, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এবং সরকারি তথ্য সংস্থার নানা দায়িত্বে। ১৯৮০-৮৩ সালে তিনি ছিলেন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ও বহিঃপ্রচার বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল এবং ১৯৮৩-৮৬ সালে দায়িত্ব পালন করেছেন ভুটানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে। তারপর এক বছর সম্পাদক ছিলেন ঢাকার ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশন পত্রিকার এবং দুই বছরের জন্য ছিলেন বাংলাদেশের বার্তা সংস্থা বিএসএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
মাহবুবুল আলম ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার ছিলেন ১৯৮৯ থেকে ৯২ সাল পর্যন্ত। ইতিপূর্বে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকার কিংবা বেতার টেলিভিশনের যোগাযোগ সম্পর্ক একরকম ছিল না বললেই চলে। ফলে এ দেশের পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের কোনো খবরাখবর দেখা যেত না। কেবল ঘূর্ণিঝড় কিংবা আর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলে বড়জোর দু-তিন লাইনের একটা সংক্ষিপ্ত খবর স্থান পেত এখানকার সংবাদপত্রগুলোয়। মাহবুবুল আলম দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।
মাহবুবুল আলম অত্যন্ত কার্যকরভাবে সক্ষম হন ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস ও লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস-এর মতো যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় সংবাদপত্রগুলোর এবং নিউজ উইক ও টাইম ম্যাগাজিনের মতো সংবাদ-সাময়িকীর সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসের সংযোগ সম্পর্ক স্থাপনে। ওই সময় তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচারের ব্যবস্থা করেন এসব প্রখ্যাত পত্রপত্রিকায়। মাহবুবুল আলম যখন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার, তখন রাষ্ট্রদূত ছিলেন প্রথমে আতাউল করিম ও পরে আবুল আহসান। এই দুজনই মাহবুবুল আলমের কর্মদক্ষতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন আমাদের কাছে৷ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ দূতাবাস এখন আমেরিকান বার্তামাধ্যমের সুদৃষ্টিতে।’
মাহবুবুল আলম পরে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কিছু সময় এবং ঢাকার ইংরেজি দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ১৮ বছর।
মাহবুবুল আলমের সঙ্গে সুদীর্ঘকালের বন্ধুত্বের সুবাদে তাঁকে যতটা জেনেছি, তাতে তাঁর পরিচয় পেয়েছি অমায়িক, পরিশীলিত, বন্ধুবৎসল, হাসিখুশির এক উজ্জ্বল সরল ব্যক্তিত্বের।
এ ছাড়া, সাংবাদিকতার পেশাদারির দিক থেকে তিনি ছিলেন এক অনন্যদৃষ্টান্ত। পঞ্চাশের দশকের সাংবাদিকদের এবং সম্ভবত পরবর্তীকালেও এই পেশায় যোগদানের শুরুতে বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতো বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার আদর্শ মেনে চলার বাধ্যবাধকতার কথা। অর্থাৎ যেকোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক মতাদর্শেই বিশ্বাস থাক না কেন, সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনে কখনোই তা প্রতিফলিত হবে না।
মাহবুবুল আলম তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তা মেনে চলেছেন। আমাদের সাংবাদিকেরা তাঁর এই দৃষ্টান্ত থেকে যথার্থই অনুপ্রাণিত হতে পারেন।
সৈয়দ জিয়াউর রহমান: সাংবাদিক, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক সিনিয়র এডিটর।