শিশুদের তীব্র নিউমোনিয়া ও অক্সিজেনের ঘাটতি মোকাবিলায় ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া ও মালাবি—আফ্রিকার এই তিন দেশের ৪০টি হাসপাতালে গত আগস্ট থেকে বাবলসিপ্যাপ ব্যবহার শুরু হয়েছে। বাবলসিপ্যাপ বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বল্প ব্যয়ের ও সহজে ব্যবহারযোগ্য এই প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ দেখায়নি। দেখিয়েছে ওই তিন দেশ।
বাবল কনটিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেশার (বাবলসিপ্যাপ) উদ্ভাবন করেছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী মোহাম্মদ জুবায়ের চিশতি ও তাঁর কিছু সহকর্মী। প্লাস্টিকের বোতল, একটি নল ও কিছু সরঞ্জাম দিয়ে এটি তৈরি। খরচ প্রায় দুই ডলার (২৪০ টাকা)। এই প্রযুক্তি দিয়ে তীব্র নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বা অক্সিজেন স্বল্পতায় ভোগা শিশুদের অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব। অনেকে মনে করেন আইসিডিডিআরবির ইতিহাসে সেরা উদ্ভাবনগুলোর একটি বাবলসিপ্যাপ।
গত নভেম্বরে এই সাংবাদিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ জুবায়ের চিশতি বলেছিলেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর পেশাজীবন শুরু হয়েছিল। আইসিডিডিআরবিতে যোগ দেওয়ার পর নিউমোনিয়া ও অক্সিজেন তাঁর গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। সমস্যায় থাকা শিশুদের অক্সিজেন দেওয়ার জন্য বাজারে পাওয়া যায় বা হাসপাতালে ব্যবহার হওয়া যন্ত্রগুলো জটিল ও ব্যয়বহুল। যন্ত্রগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশের সব হাসপাতালে এই যন্ত্র নেই। সমস্যায় থাকা সব শিশুকে প্রয়োজনের সময় অক্সিজেন দেওয়ার চিন্তা ও প্রচেষ্টা থেকে তিনি বাবলসিপ্যাপ উদ্ভাবন করেছিলেন বা করতে পেরেছিলেন।
তীব্র নিউমোনিয়া ও হাইপোক্সিয়া (রক্তে অক্সিজেন কম থাকা) আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যু কমাতে অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য সহায়ক সেবার পাশাপাশি স্বল্প প্রবাহের অক্সিজেন দেওয়ার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। চিশতির উদ্ভাবিত বাবলসিপ্যাপ ব্যবহার করে ৭৫ শতাংশ মৃত্যু কমানো সম্ভব, যা গবেষণায় উঠে এসেছে।
শুরুতে চিশতি ও তাঁর দল শ্যাম্পুর পুরোনো বোতল ও মানসম্পন্ন অক্সিজেন সঞ্চালন নল দিয়ে বাবলসিপ্যাপ তৈরি করেছিলেন। এর মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন বাতাসের চাপ সরবরাহ করা হয়। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এটি সহজে ব্যবহার করতে পারেন।
চিশতির উদ্ভাবিত বাবলসিপ্যাপের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য ২০১১ সালের আগস্ট থেকে ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে ভর্তি ২২৫ জন শিশুকে নিয়ে গবেষণা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, বাবলসিপ্যাপ ব্যবহারে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি ৭৫ শতাংশ কমে যায়। এ নিয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছাপা হয়।
কম খরচে সহজে ব্যবহারযোগ্য ও সহজে তৈরিযোগ্য বিবেচনায় এই প্রযুক্তির ব্যাপারে অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশগুলো। এর কার্যকারিতা দেখানোর জন্য ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালে জুলাই পর্যন্ত ইথিওপিয়ার ১২টি জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ১ হাজার ২৪০ জন শিশুর ওপর বাবলসিপ্যাপ নিয়ে গবেষণা হয়। তাতে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি ৮৬ শতাংশ কমতে দেখা যায়।
চিশতি উদ্ভাবিত বাবলসিপ্যাপ নিয়ে আরও বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সাময়িকীতে ছাপা হয়েছে। ল্যানসেটে সর্বশেষ প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছে ২০২৪ সালের মে মাসে।
এ বছর আগস্ট থেকে আফ্রিকার তিনটি দেশে বাবলসিপ্যাপের ব্যবহার শুরু হয়েছে। ইথিওপিয়ার ২৪টি, নাইজেরিয়ার ১৫টি ও মালাবির ১টি হাসপাতালে বাবলসিপ্যাপ ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এত দিনেও বাংলাদেশের কোনো সরকারি হাসপাতালে এর ব্যবহার শুরু হয়নি।
প্রথম আলোসহ বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে চিশতি উদ্ভাবিত বাবলসিপ্যাপ নিয়ে প্রায় শুরু থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও নিউমোনিয়া বিশেষজ্ঞেরও এ নিয়ে আগ্রহ ছিল। কিন্তু সরকারি তরফে বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের আগ্রহ দেখা যায়নি।
আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা দেশের হাসপাতালগুলোতে বাবলসিপ্যাপের ব্যবহার শুরু করার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেছেন। বিষয়টি তাদের বুঝিয়েছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তাদের আগ্রহ দেখা যায়নি। কেন দেখা যায়নি তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে নিউমোনিয়া চিকিৎসায় শিশুদের অক্সিজেন দেওয়ার মতো আয়োজন নেই।
দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর একটি প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। এই মৃত্যু কমাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বাবলসিপ্যাপ। দেশে বিদেশের বিজ্ঞানী, গবেষক ও নিউমোনিয়া বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বাবলসিপ্যাপের কার্যকারিতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, দ্বিধা নেই। এটা যে কার্যকর না, এমন বক্তব্য দেশে বা দেশের বাইরের কারও কাছ থেকে শোনা যায়নি।
হাসপাতালে শিশুদের অক্সিজেন সরবরাহে যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তার দাম ৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার ডলার। সব যন্ত্র বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাবলসিপ্যাপের দাম পড়ে দুই ডলার। খুব সহজে হাজার হাজার বাবলসিপ্যাপও তৈরি করা সম্ভব। এখন দরকার সরকারি উদ্যোগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বহু বছর ধরে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সহজ ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে আসছে। সেই দিক দিয়েও স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মেনে নেওয়া। আফ্রিকার তিনটি দেশে বাংলাদেশের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলে বাংলাদেশে কেন তা হবে না? এ কি কূপমণ্ডূকতা, নাকি ব্যবসায়িক স্বার্থ?
বেশ কয়েকটি কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত। বাবলসিপ্যাপ সরকারি হাসপাতালে ব্যবহার কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এতে বিদেশনির্ভরতা কমবে, খরচ বাঁচবে। নিজেদের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারে গর্বের একটি দিকও আছে। স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত হবে না দেশবাসীকে এই গর্বের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা।
* শিশির মোড়ল: বিশেষ প্রতিনিধি, প্রথম আলো