গাছের নাম যেভাবে হয়ে ওঠে এলাকার নাম

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের পতাকায় ফুটবলের চিহ্ন থাকলেও দেশটির নাম এসেছে একটি গাছ থেকে। নাম ‘পাউ ব্রাজিউ’।

বহু শতাব্দীকাল আগে থেকে পর্তুগিজেরা এই গাছের ছাল থেকে লাল রং উৎপাদন করত। এক সময় এই রং এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে পুরো দেশটির নাম হয়ে গেল ব্রাজিল।

দুঃখের বিষয়, সেই পাউ ব্রাজিউগাছটি এখন সেখানে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। অবশ্য ব্রাজিলের জাতীয় উদ্যানে বেশ কিছু কয়েক শ বছরের পুরো পাউ ব্রাজিও দেখতে পাওয়া যায়।

গাছের নামে পুরো দেশের নাম হয়তো পৃথিবীতে আর পাওয়া যাবে না। তবে গাছ থেকে নামাকরণ হয়েছে এ রকম বড় শহর, জেলা কিংবা এলাকার বহু বহু নাম পাওয়া যাবে তা নিশ্চিত।

আমাদের দেশেই এমন শত শত নাম। তবে ব্রাজিলের মতো এখানেও নামের উৎস গাছটি উধাও হয়ে গেছে। কালের বিবর্তনে বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে গেছে অতীতের বাস্তবতা।

এক সময়ের প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ মানুষ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়েই বিভিন্ন এলাকাকে চিনত। তাই প্রকৃতির কোনো একটি কিছু দিয়েই জনপদগুলোর নাম হতো।

চট্টগ্রাম শহরের বহু এলাকার নামের সঙ্গে যুক্ত আছে পাহাড়। যেমন দেবপাহাড়, চেরাগীপাহাড়, টাইগার হিল, কাটা পাহাড়, গোলপাহাড়, পাহাড়তলী, চশমাহিল এ রকম আরও কত কী।

এসব এলাকায় এখন পাহাড়ের সন্ধান মেলে না। ঠিক তেমনি গাছের নামে যেসব এলাকা রয়েছে, সেখানে সেসব গাছের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ঢাকার কাঁঠালবাগানে কী এখন কাঁঠালের ঘ্রাণ কিংবা ছায়া পাওয়া যায় জ্যৈষ্ঠের গরমের দিনে? এই প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর হলো ‘না’।

রাজধানীর বুকে এ রকম অনেক জনপদ বিচিত্র সব বৃক্ষের নাম ধরে রাখলেও সেখানে সেই সব বৃক্ষ বাস্তবে নেই, মানুষের স্মৃতিতেও নেই। থাকলেও সেটি কদাচিৎ। ধানমন্ডিতে ধান পাব কই? ফুলবাড়িয়ার ফুল নেই। নীলক্ষেত ব্রিটিশ উপনিবেশের স্মৃতি ধরে নেই। জিগাতলায় জিগাগাছের আঠা পাওয়া যাবে? সেগুনবাগিচা, কলাবাগান, চামেলিবাগ, জঙ্গলবাড়ি শুধু নামেই আছে, কাজে নেই।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় চকিরপাশ ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম হয়ে গেছে অচিনগাছ। এখানে পাঁচ শ বছরের বেশি পুরোনো অতিকায় একটি রহস্যময় গাছ আছে। সে গাছের নাম কেউ জানে না। অচিনগাছটি যে গ্রামে শতাব্দীর পর শতাব্দী মায়া ছড়িয়ে যাচ্ছে, সেই এলাকার নামটিও এখন অচিনগাছ।

গাছের নামে কিছু কিছু জনপদ আমাদের দেশের গৌরবের ঐতিহ্যকে ধরে আছে। যেমন শালবন। কুমিল্লা জেলার লালমাই-ময়নামতির শালবন বৌদ্ধবিহার প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে অন্যতম।

এটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা। গাছের নামে আরেকটি ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে আমাদের দেশে। মেহেররপুর জেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের বৈদ্যনাথতলা (পরবর্তী সময়ে মুজিবনগর) গ্রামের আম্রকানন।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এই আম্রকাননেই শপথ নিয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার। সে সময় বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ করা হয়েছিল মুজিবনগর। সেই আম্রকাননে ছিল সহস্রাধিক সারি সারি আমগাছ।

চট্টগ্রাম শহরের বটগাছহীন প্রধান রেলস্টেশনটিকে বেশির ভাগ মানুষ বটতলী স্টেশন নামেই চেনে। সেই স্টেশন থেকে রওনা দিয়ে ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছে কেউ কমলাগাছের সন্ধান পাবেন না। কিন্তু থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো? চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের সামনের খোলা প্রান্তরে একটা বটগাছ যদি ডালপালা বিস্তার করে সবুজ ছড়াত, দূরের পাখিরা এসে বট ফলে ঠোঁট লাগিয়ে যদি আনন্দ উল্লাস করত, তাতে এ শহরের মান বাড়তই।

কার্পাস শব্দটি বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রামের কাপাসগোলা নামটি এসেছে। কার্পাস মানে তুলা। এই এলাকায় তুলা বিক্রি হতো। একসময় চন্দনপুরায় চন্দনকাঠ গুদামজাত হতো।

মজুতদাররা এখানে সুগন্ধি চন্দনের ব্যবসা করতেন। আরকানিদের কাঠের নির্মিত দুর্গ ছিল বলে সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা কাঠগড়ের নাম হয়েছে।
চট্টগ্রামের মেহেদিবাগ, আমবাগান, কদমতলী, ঝাউতলা, আমতলা, জামতলা, লিচুতলা, বাদামতলা, পোস্তারপাড়, ফুলতলি, আমবাগান, বটতল, বটতলী, জারুলতলা, সিআরবি শিরীষতলা, কুলগাঁও, বাঁশখালী কোথাও এখন নামকরণের সার্থকতা আর তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না।

পটিয়া উপজেলার চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়কের পাশে বাদামতলী এলাকাটির নাম হয়েছে একটি বিশাল বাদামগাছকে কেন্দ্র করে। কদিন আগে ওখানে বন্ধু অ্যাডভোকেট এ টি এম আফতাবউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি গিয়ে গাছটি দেখলাম না। বোয়ালখালীর গোমদণ্ডি ফুলতলীতে কোনো ফুলগাছ নেই।

চট্টগ্রাম শহরের জামাল খান এলাকার লিচুতলায় কোনো লিচুগাছ পাওয়া যায় না। তবে একটু দূরে প্রেসক্লাবের সামনে ছাতিমতলায় সত্যি সত্যি একটা ছাতিমগাছ মৌসুমে সৌরভ ছড়ায়। নিউমার্কেটের কাছে আমতলীতে আম নেই।

এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পক প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদারের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বললেন, ‘আমতলায় কিংবা বটতলীতে যদি সত্যিই আম আর বটগাছ থাকত তাহলে বিষয়টা খুব মজার হতো। এতে শহরের পরিবেশের জন্য যেমন ভালো হতো, তেমনি ঐতিহ্যকে ধরে রাখা হতো। এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন হতে হবে বেশি।’

দেলোয়ার মজুমদার আরও বললেন, ‘আমরা সব কাজের জন্য সরকার বা প্রশাসনের দিকে চেয়ে থাকি। গাছ লাগাতে কোটি কোটি টাকার খরচ নেই। স্থানীয় সচেতন মানুষেরা গাছ লাগাতে পারেন। সেই গাছের সঙ্গে তো কারও শত্রুতা নেই। সরকারের নিষেধাজ্ঞা নেই। নামের সার্থকতা ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় ক্লাব, পরিবেশবাদী সংগঠন, এনজিও যে কেউ উদ্যোগ নিতে পারে।’

যদি এমন হয় মেহেদীবাগের তরুণেরা সেখানে বেশ কয়েকটা মেহেদি গাছের চারা রোপণ করল। আমবাগানে লাগাল আমের চারা। ধরুন নাম অনুযায়ী চারা রোপণ করার নতুন একটি উদ্যোগে আমাদের তরুণেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এমন একটা সবুজ সুন্দর স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি।