রোববার দুপুরে ৩৫ চাকরিপ্রার্থীদের একজন মোবাইল ফোনে কল করে বললেন, তাঁদের কোনো কথাই পুলিশ শোনেননি। আটক ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আদালত তাঁদের জামিন দেন। তাঁদের মধ্যে ৩ জন নারী। আটকদের কারও কারও সামনে চাকরির মৌখিক পরীক্ষা।
স্বাধীন স্বদেশে চাকরির জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে তরুণদের মামলা খেতে হবে, এটা কেমন কথা? কেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের সঙ্গে বসবেন না, কথা বলবেন না? দাবির কথা জানাতে গিয়ে প্রতিবার এই চাকরিপ্রত্যাশীরা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন। সরকারে কি এমন কেউ নেই তাদের সান্ত্বনা দেবেন। তাঁদের মনের দুঃখটা বুঝবেন।
পত্রিকান্তরের খবরে জানা যায়, শনিবার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে পূর্বঘোষিত সমাবেশ শেষে গণভবন অভিমুখে পদযাত্রা করতে গিয়ে শাহবাগ মোড়র পুলিশের বাধার মুখে পড়ে আন্দোলনকারীরা। পরে লাঠিপেটা করে পুলিশ তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেন এবং ১৩জনকে আটক করে থানায় নিয়ে যান।
৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. হারুন বলেন, ‘আমাদের বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধাদের পুলিশ আটক করেছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকজনকে পুলিশ লাঠিপেটা করেছে। আমরা পুলিশ প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানিয়ে অবিলম্বে সহযোদ্ধাদের মুক্তি চাই। সেই সঙ্গে আমাদের দাবি আদায়ে এখনো অনড় অবস্থানে রয়েছি। দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরব না।’
আটক ব্যক্তিরা হলেন সরকারি বাঙলা কলেজের নূর মোহাম্মদ নূর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হুমায়ুন কবির, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের মানিক দাস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. রাসেল, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ ফরিদ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আজম মোহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল হাকিম, ঢাকা কলেজের মামুনুর রশিদ ও সাদ্দাম হোসেন, নরসিংদী সরকারি কলেজের রিমা আক্তার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃষ্টি, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের আল আমিন এবং সুলতানা সিদ্দিকী।
এর আগে দুপুরে পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ হয়। পরে সমাবেশ থেকে বর্তমান জাতীয় সংসদের ৪০ জন সংসদ সদস্য, ৫টি পেশাজীবী সংগঠন, ৪টি ছাত্রসংগঠন বয়সসীমা ৩৫ দাবির বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তের সুপারিশের যুক্তিসংগত তথ্যসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে গণভবন অভিমুখে এই পদযাত্রা করে।
যাঁরা শেষ পরীক্ষাতেও সফল হন, তাঁদেরও অপেক্ষায় থাকতে হয়—মেডিকেল পরীক্ষা, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার নিরাপত্তা ছাড়পত্রের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং গেজেট প্রকাশ হতে প্রায় এক বছর সময় লাগে। অনেকেরই চাকরির বয়স সীমা পার হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে ৩৫ প্রত্যাশী চাকরিপ্রার্থীদের দাবি অযৌক্তিক বলার সুযোগ নেই।
পদযাত্রার মতো নিরীহ কর্মসূচিতে কেন বাধা দেওয়া হবে? পুলিশের দাবি, তাদের আন্দোলনের কারণে সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। যানজট হলেই আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে? তারা পুরো পদযাত্রাটিকে আটকে না দিয়ে নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে যেতে দিতে পারতেন। ক্ষমতাসীন কোনো সংগঠন রাস্তায় কর্মসূচি নিলে কি পুলিশ একই আচরণ করতেন?
চাকরির বয়স ৩৫ প্রত্যাশীরা দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছিলেন। সাবেক রষ্ট৶পতি মো. আবদুল হামিদ স্পিকার থাকতে তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। অনেক সংসদ সদস্য সমর্থন জানিয়েছিলেন। সংসদে এটি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু সরকার তাদের দাবি মানেনি।
৩৫ প্রত্যাশীরা যখন আন্দোলন করতে গিয়ে রাস্তায় পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হচ্ছেন, তখন জনপ্রশাসনে পৌনে চার লাখ সরকারি পদ খালি। গত বছর জুলাই মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদ রয়েছে ১৮ লাখ ২১ হাজার ২৮৪টি। এর মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ১৪ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৬ জন। অর্থাৎ ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮টি পদ খালি রয়েছে।
এসব পদে দ্রুত নিয়োগ দিলে অনেক বেকার তরুণ-তরুণী চাকরি পেতেন। বেসরকারি চাকরির বাজার মন্দা। নতুন শিল্পকারখানা হচ্ছে না। সরকারি চাকরির জন্যও বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়।
১২ মে ডেইলি স্টার বিসিএস চাকরিপ্রার্থীদের হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪১তম বিসিএস পরীক্ষা শেষ করতে চার বছর চার মাস সময় নিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতেই সময় লেগেছে তিন বছর এক মাস। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এখনো এই পরীক্ষার গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি।
এই প্রতিবেদনে একজন বিসিএস পরীক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করার কয়েক মাস পর ২০১৯ সালের নভেম্বরে ৪১তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার জন্য আবেদন করেছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। তবে তিনি ক্যাডার সার্ভিসে জায়গা করে নিতে পারেননি। তার নাম সুপারিশ করা হয় নন-ক্যাডার পদের জন্য। নন-ক্যাডার পদেও চাকরি পাননি। কারণ, এসব পদে নিয়োগ হয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া চাহিদা সাপেক্ষে।
নন-ক্যাডার পদের জন্য কয়েক মাস অপেক্ষা করে থাকার পর শেষ পর্যন্ত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। এই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিক্রি নেওয়া তরুণের জীবন সংগ্রামের কাহিনি।
এ রকম কত কাহিনি যে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে জন্ম হচ্ছে, উন্নয়নের মৌতাতে বিভোর মন্ত্রী–এমপিরা তার খোঁজ রাখেন না। যেখানে দুর্মূল্যের বাজারে চাকরি থাকলেও চলা দায়, সেখানে চাকরিহীন অবস্থায় তরুণদের। অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে যে আট তরুণের লাশ এল মধ্যপ্রাচ্য থেকে, সে জন্য কি কেবল তাঁরাই দায়ী? রাষ্ট্র ও সরকারের কোনো দায় নেই? খবরে বলা হয়েছে, দালালদের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ টাকা দিয়ে তাঁরা বিদেশে গিয়েছিলেন। এসব দালাল ধরার দায়িত্ব কার? দেশে চাকরি নেই বলেই তরুণেরা দলে দলে বিদেশে পাড়ি জমান। কেউ চাকরি পান, কেউ লাশ হয়ে ফিরে আসেন।
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএস) ২০২০ সালে পরীক্ষার পুরো প্রক্রিয়াটি এক বছরে সম্পূর্ণ করার জন্য রোডম্যাপ তৈরি করেছিল। সেই রোডম্যাপ কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত এই পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি চাকরিপ্রার্থীরা কর্মজীবনের অন্তত চারটি বছর নষ্ট করেন।
৪১তম বিসিএস পরীক্ষা শেষ করতে চার বছর চার মাস সময় নিয়েছে পিএসসি। ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতেই সময় লেগেছে তিন বছর এক মাস। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এখনো এই পরীক্ষার গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি।
যাঁরা শেষ পরীক্ষাতেও সফল হন, তাঁদেরও অপেক্ষায় থাকতে হয়—মেডিকেল পরীক্ষা, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার নিরাপত্তা ছাড়পত্রের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং গেজেট প্রকাশ হতে প্রায় এক বছর সময় লাগে। অনেকেরই চাকরির বয়স সীমা পার হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে ৩৫ প্রত্যাশী চাকরিপ্রার্থীদের দাবি অযৌক্তিক বলার সুযোগ নেই।
আশা করি, চাকরির জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে যারা আটক হয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হবে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]