১৭৬০ সালের দিকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় প্রথম শিল্পবিপ্লব। বস্ত্র, খনিজ, কৃষি—বিভিন্ন খাতে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হয় শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। ১৮৭১ সাল থেকে শুরু হয় প্রযুক্তিগত দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। রেলপথ, টেলিফোন ও বিদ্যুতের আবিষ্কার সে বিপ্লবের সময় কারখানাগুলোকে দেয় নতুন গতি, অর্থনীতিকে দেয় অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি। এরপর বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে শুরু হয় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। ইলেকট্রনিকস এবং তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে ঘটে যাওয়া সেই বিপ্লব ডিজিটাল বিপ্লব নামেও পরিচিত। আসে কম্পিউটার, সুপার কম্পিউটার।
বর্তমানে বুদ্ধিদীপ্ত বিভিন্ন ধরনের সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমের (কম্পিউটারভিত্তিক অ্যালগরিদম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও নিরীক্ষিত) উদ্ভবের মাধ্যমে আমরা এগিয়ে চলছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভেতর দিয়ে। এই বিপ্লবের চালিকা শক্তি নানা ধরনের বিকাশমান প্রযুক্তির সংমিশ্রণ। এর মধ্যে যেমন আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস, বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং; তেমন আবার আছে জিন প্রকৌশল, ন্যানোটেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, থ্রি-ডি প্রিন্টিং, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির মতো প্রযুক্তিগুলো।
পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লবগুলোর সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম পার্থক্য হলো—এটি আগের বিপ্লবগুলোর তুলনায় অনেক বেশি দ্রুতগতিতে পরিবর্তনশীল, প্রতিটি দেশের প্রায় প্রতিটি শিল্পকে এটি প্রভাবিত করছে। উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, পরিষেবা কিংবা পরিচালনা—সবকিছুর রূপান্তরের ইঙ্গিত নিয়ে এসেছে এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ সময়ে সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি আবার তৈরি হয়েছে যন্ত্রের কাছে চাকরি হারানোর ভয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘ফিউচার অব জব সার্ভে ২০২০’ অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় সাড়ে আট কোটি চাকরি গায়েব হয়ে যাবে। তবে, নতুনভাবে উদ্ভব হবে আরও সাড়ে নয় কোটি চাকরির। যেসব চাকরির চাহিদা বাড়বে, সে তালিকার প্রথম পাঁচটি হলো—ডেটা বিশ্লেষক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ, বিগ ডেটা বিশেষজ্ঞ, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং কৌশল বিশেষজ্ঞ, প্রসেস অটোমেশন বিশেষজ্ঞ। আর যে চাকরির চাহিদা কমবে, সে তালিকার প্রথম পাঁচটি হলো—ডেটা এন্ট্রি ক্লার্ক, প্রশাসনিক ও নির্বাহী সচিব, অ্যাকাউন্টিং, বুককিপিং এবং পে’রোল ক্লার্ক, হিসাবরক্ষক এবং নিরীক্ষক, উৎপাদন কারখানার শ্রমিক।
দেশের পাঁচটি খাতের ওপর এটুআই প্রকল্প দ্বারা পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ২০৪১ সালের মধ্যে গড়ে এই খাতগুলোতে প্রতি পাঁচজনের দুজন চাকরি হারানোর ঝুঁকির মধ্যে থাকবেন। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র এবং ফার্নিচার খাতেই ঝুঁকির মুখে পড়বে ৬০ ভাগ চাকরি। তবে, এই সময়ে ৫৫ লাখ চাকরি হারানোর সম্ভাব্য হুমকির বিপরীত দিক হিসেবে ধারণা করা হয়েছে, ১ কোটি নতুন চাকরির সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
মার্কিন শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্মার্ট মেশিনের নতুন যুগে অনেক চাকরি যে ধ্বংস হয়ে যাবে, ডেটা অনুসারে এ ধারণার পক্ষে খুব সামান্য সমর্থনই পাওয়া গেছে। তবে, চাকরির বাজারে যে সমন্বয় ও পুনর্বিন্যাস ঘটবে, সেটি ইতিমধ্যে সুস্পষ্ট। একটু ভিন্নভাবে অনেকেই মত দিয়ে থাকেন, বিকাশমান এসব প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন নয়, বরং মানুষকে ‘স্মার্ট’ করবে, ‘দক্ষ’ করবে।
অ্যামাজন তাদের ওয়্যারহাউসে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখের বেশি রোবট (ড্রাইভ ইউনিট) ব্যবহার করেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন লাখ কর্মীর শিক্ষা এবং দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বাজেটের ঘোষণা দিয়েছে।
সামনের সময়গুলোতে চাহিদা বাড়বে, যেমন চিকিৎসা সহকারী, পরিসংখ্যানবিদ, সফটওয়্যার প্রকৌশলী, নার্সিং—এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্ব প্রদান করবে। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকেন্দ্রিক কৌশল ঘোষণা দিয়েছে, যেখানে ডিজিটাল গভর্ন্যান্স (প্রযুক্তিগত পরিচালন) ও সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল অর্থনীতি, এবং সমাজের ডিজিটাল রূপান্তরের মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু। প্রায় অর্ধযুগ ধরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে আলোচনা চলছে, আয়োজিত হচ্ছে ওয়ার্কশপ, সেমিনার। কিন্তু সে অনুযায়ী যে পরিকল্পনা, দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদে যে কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা ছিল, সেটি আশানুরূপভাবে দেখতে পাওয়া যায় না। এসব প্রযুক্তি ‘এখানে কম্পিউটার শেখানো হয়’ সাইনবোর্ড লাগানো দোকানে ছয় মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে শিখিয়ে ফেলা যাবে না। বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে একটি বিষয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগ স্থাপন করে দিলেই দক্ষ জনবল তৈরি হয়ে যাবে না।
আবার, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আর বিজ্ঞানীরাই শুধু চাকরির বাজার দখল করে রাখবেন, ব্যাপারটা সে রকমও নয়। একটি প্রযুক্তি অবলম্বন করে সৃষ্টি হয় অনেকগুলো কর্মসংস্থানের, যেগুলো ক্ষেত্রবিশেষে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে, ভালো রকমেই আয়ত্ত করে ফেলা সম্ভব। যেমন মুঠোফোন ঠিক করার জন্য সবাইকে ইলেকট্রিক্যাল বা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে হয় না, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকলে পাড়ার মোড়ের দোকানেই ঠিক করে ফেলা সম্ভব। অতএব, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকেন্দ্রিক কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বরাবরের মতোই থাকছে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার ভিত্তিটা প্রাথমিক পর্যায় থেকে মজবুত করার কোনো বিকল্প নেই। যেসব দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন, তার একটি উদাহরণ হতে পারে ‘গণিত’—স্কুল-কলেজে ঠিক যে বিষয়টি পড়ানোর জন্য আমাদের মানসম্পন্ন শিক্ষক নেই, শিক্ষার্থীরা যে বিষয়ের তুলনামূলকভাবে খারাপ ফলাফল করে। বেশির ভাগ প্রযুক্তির পেছনেই আছে শক্ত গাণিতিক বিশ্লেষণ ও যৌক্তিক চিন্তা। জ্ঞানভিত্তিক এই বর্তমান বিশ্বে ভিত্তি যদি দুর্বল হয়, মুখস্থনির্ভর গ্রেড আর সনদ দিয়ে বড়জোর আমরা প্রযুক্তির ব্যবহারকারী হতে পারব, প্রযুক্তির উদ্ভাবনকারী হতে পারব না।
● ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক।
Email: [email protected]