কচুরি সম্পর্কে আমি যা জানি
কচুরপানা নিয়ে সংঘর্ষে নারায়ণগঞ্জে এই জানুয়ারি মাসে ২০ জন আহত হলেও কচুরিপানা কিন্তু নিরীহ জিনিস। মোটেই বিষাক্ত নয়। ওর জ্ঞাতি-গোষ্ঠী অনেকেই আমাদের খাবার পাতে বহুকাল ধরেই আছে। শুধু গরিবের পাতে নয়, ভদ্রলোকের খাবার টেবিল, এমনকি দামি হোটেলেও ওর জ্ঞাতিভাই কচুর কন্দ, লতি, ডাঁটা, পাতা অভিজাত খাবার। খাদ্যগুণেও কম নয়। চিংড়ি, নোনা ইলিশ দিয়ে কচুর লতির স্বাদ কে ভুলতে পারে? চ্যাং মাছ আর কচুপাতার ভর্তা যে খেয়েছে, সে-ই মজেছে।
শুধু কি কচু? ওলের কথাই বিবেচনা করুন। কন্দ হিসেবে ওল উপাদেয় খাদ্য। নারকেল দুধ দিয়ে ওলের ডাঁটা রান্না ভোজনরসিকদের ভীষণ পছন্দ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাটকেলঘাটা, চুকনগর, সাতক্ষীরার মানকচু ও ওল বিখ্যাত।
এদের আরেক জ্ঞাতিভাই হলো ঘ্যাটকল। সর্দি-শ্লেষ্মায় নিদান। এর ডাঁটা ভালো করে বেটে কড়া ঝাল, নুন, তেল, কালিজিরা, রসুনে রাঁধতে হয়। উপাদেয় খাদ্য। বাংলাদেশের সব শুকনো এলাকায় বেলে মাটিতে ভালো জন্মে। কুষ্টিয়া অঞ্চলে বাণিজ্যিক চাষ হয়। সেখান থেকে ভ্যান, পিকআপ, ট্রাক, ট্রেনে ঢাকাসহ সারা দেশে চালান যায়। ঢাকার বাজারে ১০০ গ্রাম ঘ্যাঁটকল ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিকোয়।
কচুরিপানা খাওয়া যেতেই পারে। ওতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন আছে। আছে ভিটামিন এ, বি, সি, ক্যালসিয়াম। যেটুকু বিছুটি আছে, তা তেঁতুল-টমেটোয় দূর হওয়ার কথা। একটু বেশি তেলে চিংড়ি দিয়ে রান্না হলে উপাদেয় হবেই। শুঁটকিতেও জমতে পারে। ইলিশ হলে সোনায় সোহাগা। নোনা ইলিশেও মজাদার খাবার হবে। চাইলে নারকেলের দুধ দিয়েও কচুরির ডাঁটা রাঁধতে পারেন (যেমন ওলের ডাঁটা রাঁধা হয়)।
কচুরির ফুল ডিমের সঙ্গে ভেজে খাওয়া যায়। বেসন দিয়ে পাকোড়াও সুস্বাদু। যাঁরা কুমড়ো, বকফুল, বরুণফুল ভাজা খেয়েছেন, তাঁরা কচুরির ফুল ডিম দিয়ে বা বেসনসহকারে পাকোড়া করে খেয়ে দেখতে পারেন। কচুরিপানা যে সুখাদ্য এবং পুষ্টিতে ভরপুর, তাতে আমার সন্দেহ নেই। খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞানীদের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী একটা ভালো প্রজেক্ট দিয়েছেন।
কচুরিপানার বৈজ্ঞানিক নাম Eichhornia crassipes। আইকর্নিয়া নামটি এসেছে প্রুসিয়ান রানির নাম থেকে। রানি এই ফুলের রূপে মুগ্ধ ছিলেন। বিলাসী রানির টবে চাষ হত এই ফুল। এক বর্ষারাতে টব থেকে এর একটি চারা বাইরে ভেসে যায়। ভাসতে ভাসতে নদীতে। নদীর স্রোতে গেল ভেসে বহুদূর। গরম পেয়ে দ্রুত বংশবিস্তার ঘটতে লাগল। বংশবিস্তার এত দ্রুত হলো যে অল্প দিনের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এখন তো দুনিয়াজুড়ে কচুরিপানা।
ফুলের সৌন্দর্যে শীতের দেশের রানি যতই মুগ্ধ হন না কেন, গরম দেশে এসে তা রীতিমতো উৎপাত হয়ে ওঠে। মশার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রজননক্ষেত্র এই কচুরিপানা।
ব্রিটিশ আমলে যশোরে এমন ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল যে অর্ধেক মানুষই শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। যশোর শহর বিরান হয়ে গিয়েছিল। সরকারি কর্মচারীরা ম্যালেরিয়ার ভয়ে যশোরে পোস্টিংই নিতে চাইতেন না।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে জানা গেল, মশা ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়ায়। তার নিরাপদ আশ্রয় এই কচুরিপানা।
পঞ্চাশের দশকে তাই ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চলে যায় কচুরিপানার বিরুদ্ধে। সেকালের পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের অন্যতম অঙ্গীকার হয়ে গেল ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। হাবিবুল্লাহ বাহার ঢাকা শহর মশামুক্ত করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে অমর হয়ে আছেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে মশা তথা কচুরি নিধনের অঙ্গীকার করবেন। তিনি এর বাংলা নাম জানতেন না। জনসভায় ইংরেজি নাম ‘হায়াসিন্থ’ সাফা করার প্রতিজ্ঞা করলেন। পেছন থেকে ছোট নেতা প্রম্পট করলেন, ‘বলুন কচুরিপানা।’ তিনি কষ্টেসৃষ্টে উচ্চারণ করলেন ‘কচুড়িপোনাহ’। লোকে হেসে কুটিকুটি। সোহরাওয়ার্দী বাংলা বলতে পারতেন না। মেদিনীপুরের এই আশরাফ মুসলিম পরিবারে বাংলার চর্চা ছিল না।
এমনিতেই শীতের সময় কচুরিপানা মরে যায়। নোনা পানিতেও বাঁচে না।
মাছ চাষে কচুরিপানার ব্যবহার আছে। গরমে পানি শীতল রাখে। মাছ কচুরিপানার নিচে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। কচুরির দাড়ির মতো শিকড়ের ভাঁজে ভাঁজে মাছ আশ্রয় নেয়। চিংড়ি, কই মাছের খুব প্রিয় আবাস এই কচুরিপানা। চাষিরা অগ্রহায়ণ মাসে কচুরিপানা তুলে চিংড়ি, কই মাছ ধরেন। পটোলের খেত কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেন চাষি। তাতে ফলন বাড়ে। পচলে উত্তম জৈবসার হয়। কার্তিকে ডোবা ঘাস খেয়ে গরুর মড়ক লাগে। তখন গরুর নিরাপদ খাদ্য এই কচুরিপানা।
আইয়ুব খান দেশজুড়ে কচুরিপানা নিধনে রাসায়নিক স্প্রে করে বিল-বাঁওড় বিষাক্ত করে দিলেন ১৯৬০ দশকে।
রানি আইকর্নিয়াকে ধন্যবাদ। তাঁর কাছে আমাদের অশেষ ঋণ। তাঁর প্রিয় ফুলটি এখন আমাদের নানা কাজে লাগছে। আর রানিও অমর হয়ে আছেন এই কচুরিপানার নামে তাঁর নামটি নিয়ে। তা না হলে কে আর রানি আইকর্নিয়ার নাম মনে রাখত?
আমাদের উদ্ভাবনাময় পরিকল্পনামন্ত্রী একটি ভালো আইডিয়া দিয়েছেন। এটা নিয়ে গবেষণা করার বিরাট সুযোগ এসেছে। পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করুক, গবেষণা করুক। এ প্রকল্পের আর্থনীতিক সম্ভাবনা নিয়ে অর্থ, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সেল গঠিত হোক।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ নির্দেশ জারি করে বিশেষ ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। প্রয়োজনে বিদেশ সফরের ব্যবস্থাও অস্বাভাবিক হবে না।
আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।