জনবান্ধব সিভিল সার্ভিস নাকি পিঠা ভাগাভাগির গল্প

জনপ্রশাসনে আন্তক্যাডার বৈষম্য ও ক্যাডারদের মধ্যে বিরোধ নিয়ে ৫ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে দুটি সাক্ষাৎকার পড়লাম।

দুটি সাক্ষাৎকারে কোথাও স্পস্ট হলো না, পক্ষ দুটি কীভাবে সিভিল সার্ভিসকে জনবান্ধব করবে। একজন তো বলেই ফেললেন, বানরের পিঠা ভাগাভাগির গল্প।

আমরা গণকর্মচারীদের জনগণের সেবায় দেখতে চাই। ফলে পিঠা ভাগাভাগির গল্প নয়, সংস্কারপ্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হবে সিভিল সার্ভিসকে দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রার জন্য প্রস্তুত করা। এ কথা সব পক্ষই স্বীকার করবেন যে প্রচলিত আমলাতন্ত্র গণমুখী নয়।

১৮৫৭ সালের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ব্রিটিশ বেনিয়ারা যে বিচারিক-প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে রেখে গেছে, সেই কলোনিয়াল ব্যবস্থাতেই চলছি আমরা। সেটিকেই ঐতিহ্য বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বহু বছর ধরে। ফলে অফিস–আদালতে এখনো ছোট ছোট ‘লর্ড’ রয়ে গেছেন। এ ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য কাজ করতে হবে খোলা মনে, গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে।

প্রশাসন ক্যাডার ও ২৫ ক্যাডারের দ্বন্দ্বের কারণটা কী? এ প্রশ্নের জবাবে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বললেন, ‘জনপ্রশাসনে যে বিরোধ, এটার উদ্ভব পঁচাত্তরের পর। জিয়াউর রহমান ২৮টি ক্যাডার তৈরি করলেন। তখন থেকেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।’

উল্লেখ্য, ২৮টি ক্যাডারের প্রতিটিই সেক্টরভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ সেবাদানের জন্য তৈরি। সেক্টরগুলোর বিকাশের জন্য এই বিন্যাস অবদান রেখে চলেছে। এ বিন্যাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। মনে রাখতে হবে, কেবল রাষ্ট্রাচার আর শাসনগিরি চালানোর জন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ, কৃষি ইত্যাদি বিভাগের মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক চাহিদার জোগান দেয়। সংস্কারকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে।

আন্তক্যাডার সমস্যার জন্য আবু আলম শহীদ খান দায়ী করেছেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে, অথচ এই সমস্যা দীর্ঘদিনের। উপরন্তু বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদী ব্যাবস্থাকে ৩ দফায় দীর্ঘায়িত করতে আমলাতন্ত্রকে যথেচ্ছ ব্যাবহার করা হয়েছে এবং বিনিময়ে আমলারা সময়ে সময়ে তাদের স্বার্থ আদায় করেছে।

ফলে দেখা যায়, দেশের চরম আর্থিক সংকটের সময়ও তাদের বিলাসবহুল গাড়ি ক্রয়সহ সবই চলে। মূলত ফ্যাসিবাদী শাসন যেভাবে আর সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে, একইভাবে আন্তক্যাডার বৈষম্যকেও চরম মাত্রায় নিয়ে গেছে। কারণ, নির্বাচনসহ নানা কারণেই তাদের প্রশাসন ক্যাডারকে প্রয়োজন ছিল। ফলে সব ক্ষমতা এক জায়গায় জড়ো করে এই গণকর্মচারীদের যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে সংস্কার আজ অবশ্যম্ভাবী।

এই বাস্তবতা সব পক্ষ যত দ্রুত মেনে নেবেন ততই মঙ্গল। অন্যায্য কোটা প্রথার মাধ্যমে সব ক্যাডারেই অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যরা জায়গা করে নিয়েছেন। ফলে জনপ্রশাসনে সংস্কারের জন্য পরীক্ষা নিয়ে উপসচিব পদে পদোন্নতি প্রদান একটি ইতিবাচক প্রস্তাব। পৃথিবীর অন্য দেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমাদের দেশের মিলিটারি ব্যুরোক্র্যাটদের পদোন্নতিও পরীক্ষার মাধ্যমে হয়।

প্রসঙ্গক্রমে এসেছে বিসিএস পরীক্ষায় পছন্দ বেছে নেওয়ার বিষয়টি। উল্লেখ্য, প্রতিটি সেক্টরকে গতিশীল করতে হবে জনসেবার প্রয়োজনে। এমন সমতার পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে সবার সক্রিয়তায় দেশ এগিয়ে যায়।

আহমদ আলী চৌধুরী ইকবাল এক প্রশ্নের উত্তরে প্রশাসন ক্যাডারের ৬-৭ হাজার কর্মকর্তার সঙ্গে ২৫ ক্যাডারের ৩৬ হাজার কর্মকর্তার যে বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন, তা জনপরিসরে সে অর্থে আলোচিত হতে দেখা যায় না।

সংস্কার কমিশন তাদের যথাযথ মতামত দেবেন, সরকার সে আলোকে জনপ্রশাসনকে জনবান্ধব করে গড়ে তুলবেন—এ আশাবাদ তৈরি হয়েছে নাগরিকদের মধ্যে। কোনো পক্ষেরই উচিত হবে না এই কাম্য সংস্কারের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া। সবাইকে মনে রাখতে হবে, দেশের স্বার্থ সবার আগে, গোষ্ঠীস্বার্থ পরে।

  • রাইসুল মুজাদালা অ্যাক্টিভিস্ট