বরেণ্য লেখক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘দারুচিনি দ্বীপ’ চলচিত্রের একটি দৃশ্য; যাঁরা সিনেমাটি দেখেছেন তাঁদের তো বটেই, যাঁরা দেখেননি কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে দৃশ্যটি দেখে অনেকেই চোখের জল মুছেছেন। কেউ কেউ দৃশ্যটি দেখে এমন কথাও বলেছেন, ‘আরে, এ তো আমাদের গল্প। আমাদের বাড়ির গল্প।’ এ দৃশ্যে দেখা যায়, সঞ্জুর বাবা খাবার টেবিলে বসে মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘তোমরা কি আমাকে ভয় পাও?’ ‘ভয় পাব কেন?’ মায়ের এ জবাবের পরই বাবা বলেন, ‘আমি কোনো দিন উঁচু গলায় কথা বলি না, কাউকে ধমক দিই না। অথচ আমার ভয়ে সবাই অস্থির।’ জবাবে মা কী বলেন? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে বাবার পরের কথাটা শোনা যাক, ‘জীবনে কোনো দিন দেখলাম না আমার কোনো ছেলেমেয়ে আমার কাছে কখনো কিছু চেয়েছে। ওরা তোমার কাছে চায়, তুমি আমাকে বলো। সরাসরি বলতে সমস্যা কোথায়?’
আমরা যাঁরা ২০০০ সালের আগে জন্মেছি, কেবল ২০০০ সালই–বা বলছি কেন, এরপরও যাঁদের জন্ম, অনেকেরই বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা এমন। যেন একটা মধুর দূরত্ব নদীর ঢেউয়ের মতো প্রতিনিয়ত যাপন করে যেতে হয়। কেন এই দূরত্ব? কেন আমরা বাবার কাছে সরাসরি চাইতে পারি না; ভালো লাগা-মন্দ লাগা বাবার সঙ্গে শেয়ার করতে পারি না। আর কেনই–বা এই দূরত্ব অতিক্রম করে উঠতে পারি না?
উত্তর খোঁজার আগে একটা বাস্তব উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক। আমরা মানে আমি ও আমার বন্ধুরা, যাদের প্রত্যেকের বয়স ২৪ থেকে ২৫–এর মধ্যে। পড়ালেখার সুবাদে একেকজন দেশের একেক প্রান্তে থাকলেও ধর্মীয় উৎসবগুলোয় বাড়ি ফিরি। একসঙ্গে মাঠে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিই। তেমনই এক আড্ডায় প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রশ্নটি উঠল। আমাদের মধ্যে কার কার বাবার সঙ্গে ছবি আছে? এখন ইলেকট্রনিকস ডিভাইস খুব সহজলভ্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি, সেলফি, কতশত ব্যাপার। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আড্ডায় থাকা ১৫ জনের মধ্যে মাত্র ১ জনের হাত উঠল। তা–ও বাবার সঙ্গে একটি বিশেষ প্রয়োজনে ছবিটি সে তুলেছে। কী আশ্চর্য, কী ভয়াবহ ব্যাপার! কাজে-অকাজে পরিচিত-অপরিচিত কতজনের সঙ্গে আমরা ছবি তুলি। অথচ সবচেয়ে আপন, কাছের মানুষটার সঙ্গে আমাদের কোনো ছবি নেই। কিন্তু নেই কেন? বাবার সঙ্গে ছবি তুলতে জড়তা কিসের?
১৬ জুন বাবা দিবসে আমরা কমবেশি সবাই বাবাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হইচই করেছি। স্মৃতিচারণা করে নানা কথা লিখেছি। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নয়, সব দূরত্ব রেখে বাবাকে সঙ্গে নিয়েই হইচই–আনন্দ উদ্যাপন করতে হবে। একটা জীবন নিজের রক্ত জল করে যে মানুষটা বড় করলেন, কোনো অজুহাতেই তাঁর সঙ্গে আমরা দূরত্ব রাখব না। কেবল একটি দিন নয়, প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বাবা যেন আমাদের ভালোবাসায় সিক্ত হন।
কেন এমন হয়? সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে মানুষটা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, পরিবারের জন্য নিজেকে বিলিয়ে যান, নিজের জন্য কখনো ভাবেন না। মহানুভব বটবৃক্ষের মতো এই মানুষের সঙ্গেই কেন এ দূরত্ব?
ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি।
আমরা যাঁরা বাবার সঙ্গে দূরত্ব অনুভব করি, তাঁদের অধিকাংশেরই দূরত্বটা তৈরি হয় ছেলেবেলায়। আমাদের বড় হওয়ার অংশজুড়ে বাবা কঠিন মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দেন। তাঁর কাছ থেকে নানা বিষয় ছেলেবেলা থেকেই আমরা লুকিয়ে রাখতে শুরু করি। আরও সহজ করে বললে, বাবাকে ভয় পেতে শুরু করি। সে কারণেই কি রেজাল্ট খারাপ হলে বকবেন ভেবে অনেকেই মার্কশিটে বাবার স্বাক্ষর নকল করিনি?
আমাদের ঠিক পাশের বাড়িতে একটা ছেলে থাকত। আমার দুই ক্লাস ওপরে পড়ত সে। বাবার ভয়ে সব সময় জড়সড় হয়ে থাকত সে। কিছু বললেই বলত, বাবা বকবে? জোর করেও কখনো তাকে খেলতে নিয়ে যেতে পারিনি। আংকেল সত্যিই ভীষণ রাগী মানুষ ছিলেন। আমরা ছেলেটাকে খেলার জন্য ডাকতে গেলে আমাদের সঙ্গেও রাগী কণ্ঠে কথা বলতেন। এটা ব্যতিক্রম। আমাদের সবার বাবা এতটা কঠিন নন। তারপরও কোনো এক অজানা কারণে আমরা অনেকেই বাবাকে ভয় পাই। বাবার সঙ্গে একটা দূরত্ব অনুভব করি।
শুরুতে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ চলচিত্রের দৃশ্যের বর্ণনায় মায়ের একটি জবাব পরে উল্লেখ করব বলেছিলাম। ‘আমি কোনো দিন উঁচু গলায় কথা বলি না, কাউকে ধমক দিই না। অথচ আমার ভয়ে সবাই অস্থির।’ এ কথার জবাবে মা বলেছিলেন, ‘ছেলেমেয়েরা তোমাকে সমীহ করে, ভয় পায় না।’ আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেবেলার ভয়ের সঙ্গে অবচেতনের ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা মিশে একাকার হয়ে যায়। আমরা বাবাকে সমীহ করতে শুরু করি। ফলে বাকি সব ঠিক থাকলেও দূরত্ব হারায় না।
তা ছাড়া বাবার সঙ্গে আমাদের খুব বেশি সময় কাটানোর সুযোগও হয় না। আমাদের ছেলেবেলায় বাবা দায়িত্ব-কর্তব্য পালন, ক্যারিয়ার, কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আমরা বড় হলে বাবার সেই ব্যস্ততা যদিও কিছুটা কমে আসে। কিন্তু বিপরীতক্রমে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তাই আমাদের সম্পর্কটা আর সহজ হয়ে ওঠে না। এই যে বাবার সঙ্গে মনখুলে কথা বলতে না পারা, কিছু বলতে গিয়েও ইতস্তত করা, ছবি তুলতে লজ্জা বোধ করা, জড়িয়ে ধরতে বাধা অনুভব করা, এগুলো তার একটি কারণ হতে পারে।
সে যা-ই হোক, যত জানা–অজানা কারণই থাকুক না কেন, বাবার সঙ্গে আমাদের দূরত্ব কমাতে হবে। সব বাধা অতিক্রম করে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে হবে। গলা ছেড়ে পাগলের মতো বলতে হবে, বাবা, তোমাকে ভালোবাসি। বৃদ্ধ বয়সে বাবারা একা হয়ে যান। সব ব্যস্ততা, দূরত্ব দূরে রেখে বাবাকে আমাদের সময় দিতে হবে।
১৬ জুন বাবা দিবসে আমরা কমবেশি সবাই বাবাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হইচই করেছি। স্মৃতিচারণা করে নানা কথা লিখেছি। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নয়, সব দূরত্ব রেখে বাবাকে সঙ্গে নিয়েই হইচই–আনন্দ উদ্যাপন করতে হবে। একটা জীবন নিজের রক্ত জল করে যে মানুষটা বড় করলেন, কোনো অজুহাতেই তাঁর সঙ্গে আমরা দূরত্ব রাখব না। কেবল একটি দিন নয়, প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বাবা যেন আমাদের ভালোবাসায় সিক্ত হন।
সৌমেন্দ্র গোস্বামী: কবি ও লেখক
[email protected]