আমাদের এই ছোট্ট, শান্ত ক্যাম্পাসটা হঠাৎ করে উত্তাল হয়ে উঠল সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই নিজেদের অবস্থান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছি, সেসব নিয়ে বিভিন্ন মহলের নানামুখী বিশ্লেষণ, আলোচনায় মুখর পত্রপত্রিকার পাতা, টকশোর টেবিল, এমনকি এই আলাপ চলে যায় সাধারণ মানুষের মুখে মুখেও।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) আপনারা চেনেন বিভিন্নভাবেই। একটি প্রকৌশল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে শিক্ষার্থীরা কঠিন কঠিন অঙ্ক কষে অভ্যস্ত, যে ক্যাম্পাস স্মরণকালের দুই দশকেই তিনটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়েছে এবং যে প্রতিষ্ঠান এখন আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে শিক্ষার্থীদের ছাত্ররাজনীতিবিরোধী অবস্থানের জন্য।
কিন্তু এই চেনাশোনার কোথায় যেন কিছু একটা নেই। আমাদের নিজস্ব গল্পগুলো আপনারা কেন যেন জানেন না, আর সেই গল্পের ফাঁকফোকরে জায়গা করে নেয় মিডিয়া ন্যারেটিভ, ক্লিকবাইট অথবা কারোর স্বার্থ খোঁজার কিছু অপতথ্য।
ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসে যে শিক্ষার্থীরা সাড়ে চার বছর কাটিয়েছে, তাঁদের এই সাড়ে চার বছরের গল্পগুলো বলা জরুরি। আমাদের প্রতিদিনের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিগুলোর বাইরেও যে আমাদের আরও গল্প থাকে, সেগুলোও জানানো জরুরি।
সাড়ে চার বছর আগে বুয়েটে শুধু ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধই হয়নি, বুয়েটের সব স্তরে শুরু হয়েছিল একটি বিনির্মাণের, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যেভাবে ঢেলে সাজানো হয়।
আমরা সেই পালাবদলের নাম দিয়েছিলাম ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’। র্যাগিং এবং অত্যাচার-নিপীড়ন বন্ধ হলো, ফলে মুক্ত মতামতের প্রবাহ চালু হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে, সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এখন যেকোনো সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বাধীনভাবে অংশ নিতে পারেন। সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে সম্পর্ক এখন আর ভয়ভীতি দেখানো বা ‘ম্যানার’-কেন্দ্রিক না, বরং সহযোগিতা এবং সুস্থ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া থেকে তৈরি হয়ে আসে।
এই সামগ্রিক বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী ও বুয়েট প্রশাসনের চেষ্টায় ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছিল নতুন বুয়েট, আর তাই ‘নতুন বুয়েট’ শব্দবন্ধটা বুয়েটে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অত্যন্ত প্রচলিত এবং স্বস্তির।
এতগুলো মানুষের এই সহজ–স্বাভাবিক চাওয়ার পেছনে কোনো গুপ্ত ষড়যন্ত্র নেই, এই আন্দোলন কোনো একক দলীয় রাজনীতির ছাত্রসংগঠনের বিপক্ষেও নয়, বরং সব লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনেরই বিরুদ্ধে। আমরা শুধু স্বাধীন এবং নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীজীবন কাটাতে চাই। এই ক্যাম্পাসটাতে মুক্তভাবে নিশ্বাস নিতে চাই। এই ছোট্ট, শান্ত ক্যাম্পাসটা সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতিমুক্ত স্বাধীন পরিবেশে চমৎকার এগোচ্ছিল, একে সেভাবেই চলতে দিন, আমাদের অনুরোধ এটুকুই।
২০১৯ সালে বুয়েটের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে অনেকেই মত দিয়েছিলেন যে এতে করে ক্যাম্পাসের মুক্তবুদ্ধির চর্চা থেমে যাবে এবং মৌলবাদী নিষিদ্ধ অপশক্তির চর্চা চালু হবে, যে ন্যারেটিভটা বারবারই আমাদের যৌক্তিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, বুয়েট এই সাড়ে চার বছর ধরে সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে অগ্রসর এবং সক্রিয় ক্যাম্পাসগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে, এই তথ্যটি অনেকেই জানেন না, অথবা জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যের অপলাপ ঘটান। কাজেই অন্ধকারে ফিরে যাওয়ার অভিযোগ যাঁরা করেন, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই কেউ এই সাড়ে চার বছরে বুয়েটে আসেনইনি, এলেই দেখতে পেতেন, এই ক্যাম্পাস প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো উপলক্ষে মেতে থাকে উৎসবে, কতটা চমৎকার কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, সামাজিক কিংবা প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোতে।
এই ছোট ক্যাম্পাসটাতে সম্ভবত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কনসার্ট হয়, সেসব কনসার্টে ক্যাম্পাস মাতাতে এসেছেন নগরবাউল জেমস, মাইলস, আর্টসেল, শিরোনামহীনসহ দেশের সঙ্গীতজগতের বিখ্যাতরা। ফিল্ম, সাহিত্য, নাটক, পেইন্টিং কিংবা ফটোগ্রাফির মতো নান্দনিক বিষয়গুলো নিয়েও সৃজনশীল কাজ হচ্ছে প্রচুর।
ডিপার্টমেন্ট এবং ক্লাবগুলোর ফেস্টিভ্যালগুলো আয়োজন করছে শিক্ষার্থীরা, প্রকৌশল এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মেলবন্ধন ঘটছে সেখানে। এত বেশিসংখ্যক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, ক্লাবগুলোর বহুমুখী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সুস্থধারার নেতৃত্ব, মুক্তচিন্তা এবং বাক্স্বাধীনতার বাস্তবিক বিকাশ বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়েই দেখতে পাওয়া যাবে।
একটি জঘন্য মিথ্যাচার অনেক সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই শোনা যায়, বুয়েটে জাতীয় দিবসগুলো পালন করা হয় না। সত্যিটা হচ্ছে, বুয়েটের জাতীয় দিবসগুলো সব সময়ই পালিত হয় বহুমুখী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।
বিজয় দিবসে রাত জেগে এখানে আলপনা আঁকেন শিক্ষার্থীরা, দেয়ালজুড়ে আঁকেন গ্রাফিতি। সেসব গ্রাফিতিতে প্রতীকী অর্থে ফুটিয়ে তোলা হয় স্বাধীনতার আলেখ্য অথবা দেশ ও ক্যাম্পাসের নানান অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা প্রদান করা হয়, অসহায়দের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। নির্মিত হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শর্টফিল্ম, মঞ্চস্থ হয় মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত নাটিকা।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বুয়েটে আয়োজিত হয় আলোচনা সভা এবং জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ। এসব অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকে সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত, গত সাড়ে চার বছরে কখনো এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
কাজেই যে মৌলবাদের অভিযোগ বুয়েটের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে করে আসা হচ্ছে, তার বিপরীতে আমাদের এই সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সব সময়ই দাঁড়িয়েছে ঢাল হিসেবে। এই ছোট্ট ক্যাম্পাসের জীবনযাত্রা এখন এতটাই প্রাণবন্ত যে আমরা ভালোবেসে একে ডাকি ‘ল্যান্ড অব লিভিং’ নামে। বুয়েটের ওয়েবসাইটে ঢুকলেই পাওয়া যাবে এই লাইনটা, ‘দেয়ার ইজ অলওয়েজ সামথিং এক্সাইটিং হ্যাপেনিং ইন বুয়েট।’
একটি আদর্শ ক্যাম্পাস যেমন হওয়া উচিত, তেমনটি হওয়ার লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। গত সাড়ে চার বছরে কোনো পরীক্ষা বাতিল হয়নি, হলগুলোর জীবনযাত্রা এবং ডাইনিংয়ের খাবারের মান বেড়েছে, রিসার্চ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বুয়েটের অবস্থান উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে। র্যাগিং না থাকায় নবাগত শিক্ষার্থীদের জন্য বুয়েট বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরাপদ ক্যাম্পাসগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।
যে নিষিদ্ধ রাজনীতি ও মৌলবাদের ডানা মেলার প্রমাণবিহীন ভয় দেখিয়ে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতিকে ফিরিয়ে আনার পথ খোঁজা হয়, বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সব সময় ছিল তৎপর। এসব অপতৎপরতা ঠেকাবে দেশের চৌকস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির সেখানে আসলেই কী করার আছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
এই নতুন দিনের আলোকিত বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতির আমাদের নতুন করে দেওয়ার কিছুই নেই, বরং তা ফিরে এলে ক্যাম্পাসকে আবারও ঠেলে দেবে নিকষ অন্ধকারে, নিশ্চিতভাবেই আবারও শুরু হবে রাজনৈতিক অপক্ষমতার নগ্ন প্রদর্শনী এবং একসময়ে আবার নতুন কোনো নাম যুক্ত হবে সনি, দ্বীপ কিংবা আবরারের পাশে।
বুয়েটের শিক্ষার্থীরা অধিকার সচেতন, সমাজ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এবং নিজেদের ও ক্যাম্পাসের ভালো-মন্দ খুব ভালো করেই বোঝেন। স্মার্ট, আধুনিক এবং ‘সুস্থধারার’ ছাত্ররাজনীতির নামে আমাদের যা গলাধঃকরণ করতে বলা হচ্ছে, সেই আইওয়াশের বাস্তবতা বুয়েটের শিক্ষার্থীরা জানেন, শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই চান না সেই সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ হতে।
সে জন্যই ছয় হাজার বর্তমান শিক্ষার্থীর প্রায় প্রত্যেকে এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একটি বিপুল অংশ যাঁদের অনেকেই দেশে-বিদেশে তাঁদের কাজের জন্য সমাদৃত, সবাই আজ একটি দাবিতেই মুখর, তাঁদের এই প্রিয় ক্যাম্পাসটিতে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতির কালো ছায়া ফিরে না আসুক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁরা সবাই #NoStudentPoliticsInBuet হ্যাশট্যাগের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানাচ্ছেন।
সম্প্রতি সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে নেওয়া একটি পিটিশনে বুয়েটের বর্তমান শিক্ষার্থীদের ৯৮ শতাংশ তাঁদের ইনস্টিটিউশনাল ই–মেইলের মাধ্যমে গণসাক্ষরে অংশগ্রহণ করেন। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই দাবির সামগ্রিকতাই সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীদের তীব্র বিতৃষ্ণার বিষয়টিকেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে।
সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ এবং দেশের সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতি অনুরোধ, আপনারা আমাদের এই আন্দোলনের সামগ্রিকতাটুকু বুঝুন। এই কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর সবাইকে ঢালাওভাবে মৌলবাদ ও নিষিদ্ধ রাজনীতির মদদপুষ্ট বলে ট্যাগ দেওয়াটা রীতিমতো মূর্খতা এবং এই বিপুলসংখ্যক প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারার ক্ষমতাকে অবমূল্যায়নের শামিল।
এতগুলো মানুষের এই সহজ–স্বাভাবিক চাওয়ার পেছনে কোনো গুপ্ত ষড়যন্ত্র নেই, এই আন্দোলন কোনো একক দলীয় রাজনীতির ছাত্রসংগঠনের বিপক্ষেও নয়, বরং সব লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনেরই বিরুদ্ধে। আমরা শুধু স্বাধীন এবং নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীজীবন কাটাতে চাই। এই ক্যাম্পাসটাতে মুক্তভাবে নিশ্বাস নিতে চাই। এই ছোট্ট, শান্ত ক্যাম্পাসটা সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতিমুক্ত স্বাধীন পরিবেশে চমৎকার এগোচ্ছিল, একে সেভাবেই চলতে দিন, আমাদের অনুরোধ এটুকুই।
সৌরভ সাহা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী