‘যারা জানে, তারা করে। আর যারা বোঝে, তারা শিক্ষা দেয়।’ শিক্ষা নিয়ে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল এই উক্তিটির মাধ্যমে শিক্ষকতার কাজটিকে আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রকারান্তরে শিক্ষকতা আসলে কী, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার স্বার্থে বিষয়টির আরেকটু সহজ ও বোধগম্য ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। প্রথমত, এখানে ‘জানা’ মানে শুধু তথ্য বা দক্ষতা অর্জন করা।
এটা ‘শিখন’ প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ধাপ, যেখানে আমরা রকমফের জিনিস শিখি এবং সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোকে কাজে লাগাই। যেমন গণিতের সমস্যা সমাধান করা, রচনা লেখা কিংবা কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজানো।
পক্ষান্তরে জানার চেয়ে বোঝা তুলনামূলক গভীর। বোঝা কেবল তথ্য মনে রাখা নয়; বরং সেগুলোকে ব্যাখ্যা করা, বিশ্লেষণ করা এবং অন্যদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতাও বটে। সহজভাবে বলতে গেলে, শেখানো হলো বোঝার প্রমাণ। আপনি যদি যেকোনো ধারণা কাউকে স্পষ্ট ও কার্যকরভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন, তাহলে সেটা প্রমাণ করে যে আপনি ওই বিষয়টি গভীরভাবে বুঝেছেন। আবহমানকাল থেকে ইতিহাস ও সাহিত্যে শিক্ষকদের যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তা মূলত আলোচিত এই দর্শনের জন্যই।
সময় ও যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আজ সমাজের চিত্রও প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। স্থান-কাল-পাত্রনির্বিশেষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানকারী একজন শিক্ষককে অনায়াসে ‘স্যার’ সম্বোধন করা আমাদের গড়ে ওঠা অভ্যাস ও সংস্কৃতিরই অংশবিশেষ। অথচ আজ আমাদের নাসিকার উচ্চতা যেন হিমালয়কেও ছাড়িয়ে গেছে!
শিক্ষকমাত্রকেই যদি ‘স্যার’ সম্বোধন করার অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান করা হয়, তাহলে বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে একজন সংগীতশিল্পীকে যেমন আমরা ‘গায়ক’ বলে ডাকি, ঠিক তেমনিভাবে যাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন, তাঁদেরও আমরা স্বাভাবিকভাবেই ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করি। বলা বাহুল্য, এই ‘স্যার’ বলাটা একটা পেশাভিত্তিক সম্বোধনও বটে।
আমাদের দেশের অন্য পেশাজীবীদের মধ্যেও এই ‘স্যার’ ডাক শুনতে চাওয়ার একটি উদগ্র প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, যদিও তাঁদের পেশা শিক্ষাদান নয়। অন্যের মুখে ‘স্যার’ শব্দটিতে সম্বোধিত হওয়ার জন্য তাঁদের মধ্যে বিদ্যমান প্রকট আকাঙ্ক্ষা এবং এর অবস্থাদৃষ্টে এটি মনে করা বিচিত্র কিছু নয় যে এ কালে ‘স্যার’ সম্বোধনটা বেশ রোমান্টিক একটি সম্বোধনে পর্যবসিত।
এই ‘স্যার’ সম্বোধন শোনার ব্যগ্র বাসনায় আমরা ভুলতে বসেছি যে সমাজে কিছু অতি পবিত্র পেশা রয়েছে। শিক্ষকতা, রোগীর চিকিৎসা প্রদান ও বিচার কার্যক্রম—এই তিনটি পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের নৈতিকতার দিক থেকে সবচেয়ে অনড় ও অবিচল থাকতে হয়। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সমাজে যেদিন এই তিন শ্রেণি-পেশার মানুষ সবাই কলুষিত হবে, সেদিনই হবে এই মানবসভ্যতার অন্তিম মুহূর্ত। হ্যাঁ, এই তিনটি পেশা এতটাই মহৎ।
আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না যে শিক্ষকেরাও মানুষ। ভুলভ্রান্তি তাঁদের দ্বারাও হয়ে থাকে। তাই বলে আমরা যদি এই পেশাটিকে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে হেয়প্রতিপন্ন করতে থাকি, তাহলে এর অনিবার্য পরিণতি ধ্বংস ছাড়া আর কিছু হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, কিছু পেশার প্রতি সম্মানসূচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা এই সমাজেরই দায়। শিক্ষকদের সম্মান প্রাপ্য ব্যাপারটিকে এভাবে না দেখে বরং এটা সমাজেরই কর্তব্য যে তাঁদের সেই মর্যাদা প্রদান করা কিংবা এভাবে দেখা উচিত।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের পুরো রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা একটি মেশিনের মতোই। অন্য সব শ্রেণি–পেশার মানুষ এই মেশিনের কলকবজার মতোই একেকটি অংশমাত্র। শিক্ষকেরা কিন্তু সেই অর্থে এই মেশিনের সরাসরি কোনো যন্ত্রাংশ না হয়ে বরং এই মেশিনটি তৈরি করার কারিগর হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকেন। শিক্ষকদের মর্যাদাকে অন্য শ্রেণি ও পেশা থেকে আলাদা করে তুলে ধরার জন্য এর চেয়ে সহজ ও বোধগম্য উদাহরণ আর কী হতে পারে।
‘প্রত্যয়’ স্কিম হোক আর অন্য যেকোনো স্কিমই হোক না কেন, শিক্ষকদের বারবার নানা নামে একটি কথিত স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রয়াস, তার আসল উদ্দেশ্যটা বোঝা বড় মুশকিল। আপাতদৃষ্টে এটিকে একটি শ্রেণিবিভাজন ব্যতীত আর কিছুই মনে হচ্ছে না। আর এই শ্রেণিবিভাজনের অবধারিত ফলাফল হলো বৈষম্য। বিষয়টি আর্থিকভাবে একজন শিক্ষকের জন্য যতটা না ক্ষতির, তার চেয়ে শিক্ষকতা পেশাটির জন্য বেশি অসম্মানজনক। আজ শিক্ষকদের এই মহান পেশার সম্মান রক্ষায় পথে দাঁড়াতে হচ্ছে। এটিই কি কম বেদনাদায়ক?
সামান্য কিছু পাওনা বেতনের দাবিতে দিনের পর দিন রাজপথে শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি পালন; প্রশাসন ক্যাডার ও শিক্ষা ক্যাডারের মাঝামাঝি যে প্রগাঢ় বৈষম্য, তার বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে স্লোগান; বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি স্বতন্ত্র স্কেলের আওতায় আনার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসা—এমন সব দৃশ্য আগেও দেখা গেছে। অথচ একজন সরকারি আমলার সুযোগ-সুবিধার তুলনায় একজন শিক্ষকের কিছুই নেই। উদ্ভূত পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্ন ওঠাই কি স্বাভাবিক নয় যে ‘প্রত্যয়’ স্কিম এই ‘কিছুই নেই’ থেকে আরও কেড়ে নেওয়ার অপপ্রয়াসেরই নামান্তর? এর শেষ কোথায়?
প্রসঙ্গত, প্রবল আশঙ্কাজনকভাবে ঘনীভূত একটি সংকটের কথাও আমাদের বিবেচনায় রাখা বাঞ্ছনীয়। আর সেটি হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি সরকারি চাকরিতে আগ্রহী না হয়ে বরং অন্য কোনো উৎপাদনমুখী কার্যক্রমে নিজের পেশা বেছে নেয়, তাহলে সেটি রাষ্ট্রের জন্য সন্দেহাতীতভাবে আশীর্বাদ হলেও সত্যিকারের মেধাবী সমাজ যদি শিক্ষকতা পেশার দৈন্যদশা দেখে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে কি এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ক্রমান্বয়ে হুমকির মুখে পতিত হবে না?
একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম ঘোষণা করা নিঃসন্দেহে সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনারই প্রতিফলন। সরকার চলমান পেনশন ভাতার যে টেকসই দিকটি বারবার সামনে আনছে, সেটিরও যৌক্তিকতা রয়েছে। তাই বিষয়টিকে সার্বিক অর্থে টেকসই করার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে সত্যিকার অর্থেই সর্বজনীন করা যায়, সেটি বিবেচনায় নেওয়া অত্যাবশ্যক।
আমাদের মাথায় রাখতে হবে, এখনো একটি বিশাল পেশাগোষ্ঠী এই স্কিমের ঊর্ধ্বে রয়েছে। মূলত যাঁরা এই নীতিনির্ধারক গোষ্ঠী, তাঁদের একটি বিশাল অংশ নিজেদের পেশায় শুধু জ্যেষ্ঠ এ কারণে পূর্বনির্ধারিত সেবাপ্রাপ্ত হচ্ছেন। নৈতিকতার মানদণ্ডে এটিও কি কম বড় প্রশ্ন?
এ কে এম মাহমুদুল হক অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়