ঢাকায় তুমুল বৃষ্টিপাত হলেই দুঃসহ একটি স্মৃতি আমাকে তাড়া করে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে যখন ভারী বৃষ্টি হচ্ছিল, তখনই সেই স্মৃতি ভেসে ওঠে। একই সঙ্গে রাতে ঘরমুখী ঢাকা নগরবাসীর সীমাহীন দুর্ভোগের চিত্রও চোখে ভাসে।
২০১৭ সালের কথা, তখন আমার কর্মস্থল ছিল ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় দৈনিক সমকাল। আমার থাকার স্থান ছিল রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এফ ব্লকের একটি ভবনে। রাত ১০টায় অফিস শেষ করে বাসার পথে রওনা হই। কুড়িল বিশ্বরোডে গাড়ি থেকে নামার পর বৃষ্টির কবলে পড়ি। তড়িঘড়ি করে সেখানে ঠাঁই নিই সড়কের পাশে একটি ভ্রাম্যমাণ দোকানের ছাউনির নিচে। চলছে তুমুল বৃষ্টি। টানা প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি থামলে সেখান থেকে যাই যমুনা ফিউচার পার্কের পাশে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটে। দেখি চারদিকে নোংরা পানিতে টইটম্বুর। নর্দমার আবর্জনা ও মনুষ্যবর্জ্য একাকার হয়ে জলাবদ্ধ পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে।
এই গেটে যেসব রিকশাচালক, যাত্রীদের অপেক্ষায় থাকেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বেশির ভাগ চালক নেই। যে দুই-একটি রিকশা ছিল, চোখের সামনে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া মিটিয়ে গন্তব্য ছুটল। তাই বাধ্য হয়েই প্যান্ট ও শার্ট আরও গুটিয়ে হাঁটা শুরু। আমার মতো অনেকেই হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন। গেটের সামনের সড়কেই ঊরু সমান পানি। আর ফুটপাতে হাঁটু পানি। সড়কে খানাখন্দ ছিল, তাই সহজে হাঁটার উপায় ছিল না। সামনে এক পা দিয়ে নিরাপদ নিশ্চিত হওয়ার পরই পেছনের পা তুলে এগিয়ে যেতে হয়। কোথাও হাঁটু, কোথা ঊরু, কোথাও কোমর, আবার কোথাও বুকসমান পানি মাড়িয়ে দুরুদুরু বুকে পৌঁছে গেলাম আবাসিক এলাকার ডি ব্লকের কাছে ব্যাংক এশিয়ার মোড়ে।
এবার সেই মোড় থেকে উত্তর দিকে সড়কের ফুটপাত ধরে যাওয়ার পালা। সেখানেও ফুটপাতে হাঁটু ও ঊরু সমান পানি। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামনের পা ফেলামাত্র অথই পানিতে মাথাসহ তলিয়ে গেলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রীতিমতো চুবানি খেয়ে উঠলাম। ভিরমি খেয়ে কিছুক্ষণ থাকার পর বুঝতে পেলাম ও নিশ্চিত হলাম, আমি ঢাকনা ছাড়া কোনো একটি ম্যানহোলের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলাম। সাঁতারের কৌশল কাজে লাগিয়ে উঠে আসতে পেরেছি। দূষিত, দুর্গন্ধ ও নোংরা পানিতে মাথাসহ ভিজে একদিকে যেমন ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো, অপর দিকে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করে নিলাম এই বলে যে, আমি প্রাণে বেঁচে ফিরেছি। আরও একটু এদিক-সেদিক হলেই ম্যানহোলের ভেতরে চিরদিনের মতো হারিয়ে যেতে হতো।
এভাবেই রাত সাড়ে ১২টার দিকে সাত তলায় ব্যাচেলর ফ্ল্যাটের থাকার কক্ষে পৌঁছালাম। বাসায় দেখি বিদ্যুৎ নেই। গোসল করতে বাথরুমে ঢুকে দেখি পানিও নেই। এবার ভাবুন আমার অবস্থা। দূষিত ও নোংরা পানি গোটা শরীরে চুলকানি দিচ্ছে, কিন্তু পানির অভাবে পরিষ্কার হতে পাচ্ছি না। বোতলের খাওয়ার পানি দিয়ে শুধু হাত-মুখ কোনো মতে পরিষ্কার করে নিলাম। গোসল করতে না পেরে চরম অস্থির ও অস্বস্তি লাগছিল। এবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ডিসকভারি চ্যানেলের ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’-এর বিখ্যাত উপস্থাপক ও অভিযাত্রিক বিয়ার গ্রিলসের কথা ভাবছিলাম। তাঁর প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা ও পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার কৌশল চোখে ভেসে ভেসে ঘুম চলে আসে।
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ফেসবুকে একটি ভিডিও দেখে হকচকিয়ে গেলাম। জলাবদ্ধ সড়কের পাশে দুই-তিনজনের লাশ পড়ে আছে, কোথা থেকে একজন এসে সড়কের মাঝে ডুবে থাকা এক শিশুর পা ধরে টেনে তোলে স্বজনের কাছে দিলেন। আশপাশে মানুষের ভিড় থেকে আহাজারি শোনা গেল। পরে প্রথম আলোর খবরে নিশ্চিত হলাম, বৃষ্টির মধ্যে রাতে ঢাকার মিরপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এমন করুণ ও হৃদয়বিদারক ঘটনার দৃশ্য দেখে কি ঘুমানো যায়? ঘুম চোখে আসে? এই যে আমরা ‘উন্নয়ন’ ‘উন্নয়ন’ করে মাথা নষ্ট করে ফেলেছি। নিরাপদ, মানবিক ও প্রাণবিক একটি নগর কি তৈরি করতে পেরেছি?
তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোর সহসম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]