নাটোরের কাঁচাগোল্লা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেতে কত দেরি

নাটোরের ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির পেছনে আছে প্রাচীন গল্পগাথা।
ছবি: সংগৃহীত

‘আপনার বাড়ি কোথায়?’ এই প্রশ্নের উত্তরে যখন বলি নাটোরে। তখন স্বভাবতই প্রশ্নকর্তার মনের ভেতর কয়েকটি নাম বা চিহ্ন অকপটে ভেসে ওঠে। যেমন বনলতা সেন, চলনবিল, উত্তরা গণভবন। সেই সঙ্গে অবধারিতভাবে আসে কাঁচাগোল্লা নামটিও। তারপরই আবদারটা করে বসেন, কবে খাওয়াচ্ছি নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা? যা হোক, এই যে কাঁচাগোল্লার বরাত দিয়ে আমাকে বা আমার শহরকে অন্য জেলার মানুষ সহজেই শনাক্ত করতে পারছে, এই শনাক্তকরণই হচ্ছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই)।

উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে, ‘ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হচ্ছে কোনো সামগ্রীর ব্যবহার করা বিশেষ নাম বা চিহ্ন। এই নাম বা চিহ্ন নির্দিষ্ট সামগ্রীর ভৌগোলিক অবস্থিতি বা উৎস (যেমন একটি দেশ, অঞ্চল বা শহর) অনুসারে নির্ধারণ করা হয়। ভৌগোলিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সামগ্রী নির্দিষ্ট গুণগত মানদণ্ড বা নির্দিষ্ট প্রস্তুত প্রণালি অথবা বিশেষত্ব নিশ্চিত করে।’

এই সংজ্ঞার সূত্র ধরে সহজেই অনুমেয় হয় যে, কাঁচাগোল্লাও নির্দিষ্ট একটি শহরকে সুনির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করে আসছে। আর সেই শহর হচ্ছে, নাটোর। কাঁচাগোল্লা মিষ্টান্নটি যেভাবে তৈরি করা হয়, তা অন্য কোনো মিষ্টি-মিষ্টান্ন তৈরির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশেষত্বের দিক দিয়েও এটি মৌলিকত্ব বহন করে। অর্থাৎ কোনো পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যেসব মানদণ্ড লাগে, সেসব বিষয়ে কাঁচাগোল্লা উতরিয়ে আছে ইতিমধ্যেই।

নাটোরের এই ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির পেছনে আছে প্রাচীন গল্পগাথা। একসময় নাটোর অঞ্চল ছিল রানি ভবানীর শাসনামল। তিনি মিষ্টি-মিষ্টান্ন খেতে বেশ পছন্দ করতেন। শহরের লালবাজারের মিষ্টি বিক্রেতা মধুসূদন পাল রানির রাজপ্রাসাদে নিয়মিত মিষ্টি-মিষ্টান্ন সরবরাহ করতেন। হঠাৎ করেই একদিন তার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মচারী কাজে আসে না। ওই দিন মিষ্টি-মিষ্টান্ন তৈরির জন্য দোকানে মণ দু-এক দুধের ছানা রাখা ছিল। ছানাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে মধুসূদন পাল দোকানে থাকা দুধের ছানার সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিনি মিশিয়ে চুলায় তাপ দিতে থাকেন। একসময় গরম ছানা থেকে সুন্দর ঘ্রাণ বের হতে থাকে। মধুসূদনের নাকে সেই ঘ্রাণ যেতেই তিনি তা মুখে দিয়ে দেখেন যে খেতে দারুণ স্বাদ হয়েছে।

এরপরই তার মাথায় আসে ভিন্ন এক বুদ্ধি। দুঃসাহস করেই হোক আর নতুনত্ব দেখাতে হোক, স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় নতুন এই মিষ্টি তিনি রানি ভবানীর রাজপ্রাসাদে নিয়ে যান। বিধিবাম, এই ছানার কাঁচা মিষ্টি খেয়ে রানি প্রশংসায় পঞ্চমুখ করে তোলেন। এই খাবারের নাম কী তা জানতে মধুসূদনকে জিজ্ঞেসও করেন তিনি। মধুসূদন পাল ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি। কাঁচা ছানা থেকে তৈরি করা হয়েছে বলে এর নাম বলেন কাঁচাগোল্লা। ধীরে-ধীরে কাঁচাগোল্লার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে রাজপ্রাসাদে। পরে তা সাধারণ মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে।

নাটোরের কাঁচাগোল্লার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অত্র অঞ্চলের আপামর মানুষের আবেগ, ভালোবাসা ও স্মৃতি। প্রায় আড়াই শ বছর আগে প্রথম তৈরি হলেও আজও মিষ্টিটির সুনাম ধরে রেখেছেন কারিগর ও বিক্রেতা-প্রতিষ্ঠানগুলো। নাটোর অঞ্চলের যেকোনো বিয়ে, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান ও অতিথি আপ্যায়নে সরবরাহ করা হয় কাঁচাগোল্লা। নাটোরে আসা দর্শনার্থীরাও কাঁচাগোল্লার স্বাদ লুফে নেন। মিষ্টির দোকানিরা প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাঁচাগোল্লা পাঠান। কাঁচাগোল্লাকে কেন্দ্র করে চলে নাটোরের মিষ্টির বড় ব্যবসা।

এত কিছুর পরও দুঃখজনক আরেকটি বিষয় সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের নজরে আসছে। তা হলো, নকল কাঁচাগোল্লার ভিড়ে চাপা পড়ছে ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লা। বিশেষ করে গণপরিবহন, ট্রেনে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রতারক চক্র কম মূল্য দেখিয়ে নকল কাঁচাগোল্লা তুলে দিচ্ছে ভ্রমণরত মানুষদের হাতে। এতে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে, কাঁচাগোল্লার স্বাদ ও সুনামও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

বাংলাদেশে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া বা চাওয়ার বিষয়টি নতুন কিছু না। ইতিমধ্যে পনেরোটি জিনিস বা পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ১৭ নভেম্বর ২০১৬ সালে জামদানি স্বীকৃতি পায়। এরপর ইলিশ বাংলাদেশের দ্বিতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হয়। এরপর ক্ষীরসাপাত আমকে বাংলাদেশের ৩য় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর মসলিনকে ৪র্থ, রাজশাহী সিল্ককে ৫ম, শতরঞ্জিকে ৬ষ্ট, চিনিগুঁড়া চালকে ৭ম, দিনাজপুরের কাটারিভোগকে ৮ম এবং বিজয়পুরের সাদা মাটিকে ৯ম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

২০২২ সালের ২৪ এপ্রিলে বাগদা চিংড়িকে বাংলাদেশের ১০ম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য বলে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়। একই বছর বাংলাদেশের একাদশতম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় রাজশাহীর বিখ্যাত ফজলি আম। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৫ জুলাই আরও চারটি পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পণ্যগুলো যথাক্রমে, বগুড়ার বিখ্যাত দই, শেরপুরের তুলসীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম ও আশ্বিনা আম। ১৬তম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি হিসেবে নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে দেখতে উৎসুক আমরা। এটি এখন আমাদের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। গণমানুষের এই দাবিকে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের বদৌলতে চলতি বছরের শুরুর দিকে একটি আওয়াজ কানে এসেছিল যে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেতে পারে নাটোরের কাঁচাগোল্লা। ইতিমধ্যে নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগ যদি সত্যি স্বীকৃতিদাতা কর্তৃপক্ষ আমলে নিয়ে কাজ শুরু করে, তবে খুব শিগগিরই কাঁচাগোল্লা ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস রাখতে পারি। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতেও আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

সবশেষ, এটি বলার কোনো অপেক্ষা রাখে না যে নাটোরের কাঁচাগোল্লা সারা দেশে প্রসিদ্ধ ও এর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। শুধু তাই নয়, কাঁচাগোল্লা ভারতসহ বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি করা হয়ে থাকে। তাই কাঁচাগোল্লাকে দ্রুত ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতিকরণের মধ্য দিয়ে নাটোরের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশ-বিদেশে কাঁচাগোল্লার চাহিদা আরও বাড়ানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি হয়ে পড়েছে। সেইসাথে কাঁচাগোল্লার নকল প্রতিরোধে জেলা প্রশাসনকে তৎপর হওয়ার আহ্বান করছি। স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে বেশি দামে যাতে বিক্রি করা না হয় ও নকল কাঁচাগোল্লা বাজারে যাতে না আসে, এ বিষয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করছি।

মোহাম্মদ অংকন
প্রকৌশলী, ঢাকা
ই-মেইল: [email protected]