বহুদলীয় গণতন্ত্রে নির্দলীয় পোলিং কর্মকর্তা, নির্দলীয় প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, নির্দলীয় রিটার্নিং কর্মকর্তা, নির্দলীয় নির্বাচন কমিশন এবং সর্বোপরি নির্দলীয় সরকার অপরিহার্য। গোটা জাতিকে দলীয়করণ করলে নির্দলীয় মানুষ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। নির্দলীয় মানুষ পেতে হলে নির্দলীয় স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় লাগবে। শিক্ষক ও ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে। অনুরূপ সব পেশাজীবীকেও দলীয় রাজনীতির বলয় থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, দলীয় রাজনীতি কারা করবে? ছাত্র–শিক্ষক ব্যতীত অন্যান্য পেশাজীবী ব্যক্তি হিসেবে যেকোনো দল করতে পারেন। কিন্তু পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাহী পদে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের দলীয় রাজনীতি করতে দেওয়া সমীচীন হবে না। সে ক্ষেত্রে দলদাসত্বের কারণে কোনো পেশাজীবী সংগঠন ন্যায্য পেশাস্বার্থ আদায়ে সক্রিয় ও সোচ্চার হতে পারবে না । অপেশাজীবী জনগণ অবাধে দলীয় রাজনীতি করতে পারবে। তবে কাউকে দলীয় রাজনীতি করতে বাধ্য করা যাবে না। সিভিল সমাজই একটি রাষ্ট্রের শক্তিশালী নির্দলীয় সমাজ এবং তারাই জাতির বিবেক হিসেবে মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখে।
সিভিল সমাজ মানবাধিকারের রক্ষাকবচ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে বিরোধী দলের পাশাপাশি সিভিল সমাজকেও বিগত ১৫ বছরে প্রায় নির্মূল করে দেওয়া হয়েছিল। সবকিছু নির্মূল করে মাফিয়াতন্ত্র নিজেকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তন চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া।
দলীয়করণ কোথায় হয়? রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ভেনেজুয়েলা, বেলারুশ ও উত্তর কোরিয়ায় যেখানে গণতন্ত্র নেই। ইউরোপ–আমেরিকার গণতান্ত্রিক কোনো দেশে দলীয় ছাত্ররাজনীতি এবং পেশাজীবীদের দলীয়করণ নেই। দলকে চিরদিন ক্ষমতায় রাখার জন্য পেশাজীবীদের দলীয়করণ দরকার হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রে এক দলের চিরদিন ক্ষমতায় থাকার কোনো অবকাশ নেই। তাহলে অন্য দলের রাজনীতি করার কোনো যুক্তি থাকে না।
ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক হস্তান্তর বহুদলীয় গণতন্ত্রে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এ জন্য বায়তুল মোকাররম মসজিদের ইমাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং সচিবদের পালাতে হয় না। আর এই স্বাভাবিক ঘটনাটি ঘটে নির্দলীয় মানুষ তথা সিভিল সমাজের নির্দলীয় ব্যবস্থাপনায়। এর ব্যত্যয় ঘটলে বিপত্তি।
সব লোককে দলীয় রাজনীতির গোডাউনে জোর করে না ঢুকিয়ে মুক্ত বাতাসে নির্দলীয় রাজনীতি করতে দিলে কি গণতন্ত্র ভেস্তে যাবে? নিশ্চয়ই নয়। বরং এতে দেশে অনেক স্বাধীনচেতা নেতা তৈরি হবে, যারা পরে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে নতুন দলের নেতা হতে পারে। মনে রাখতে হবে, নেতার পেছনে থেকে নেতাকে তাল দিয়ে নেতা হওয়া যায় না। খুব জোর ভালো চামচা বা চাটুকার হওয়া যায়। ঔপনিবেশিক ডিসি এবং কমিশনার দিয়ে আর কত দিন মাঠ প্রশাসন চলবে এবং চালাতে হবে? কেন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি, জেলা পরিষদ এবং বিভাগীয় পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছে না?
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেনো দলীয় ছাত্ররাজনীতিমুক্ত হচ্ছে না? প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমে যাবে তাই। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়িয়ে জনগণ কি চিরকাল বুকে গুলি খেতেই থাকবে? রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ ও পদোন্নতি দলীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে রেখে কীভাবে দলীয়করণ ঠেকানো সম্ভব? পেশাজীবীদের প্রধানমন্ত্রীর চামচা ও চাটুকার হয়ে বাঁচতে হবে কেন? কেন তাঁদের রক্তে দলদাসত্বের এত জীবাণু? পেশাভিত্তিক উচ্চকক্ষ থাকলে কি কোনো সরকার আইন করে ব্যাংকগুলোর মালিকানা পরিবারের হাতে তুলে দিতে পারত? ডিজিটাল বা সাইবার নিরাপত্তা আইন বানাতে পারত? ডিজিএফআইয়ের কাজকে আইনের বাইরে রাখতে পারত? কোনো সরকার মানুষ গুম করতে বা আয়নাঘর বানাতে পারত? নিশ্চয়ই পারত না। তাহলে সংবিধানে পেশাভিত্তিক উচ্চকক্ষের বিধান রাখতে আমাদের এত আপত্তি কেন? পেশাজীবীদের দলীয় দাসত্বে বাধ্য করার জন্য? তাহলে বাঙালিরা এত লেখাপড়া করছে দলদাস এবং জ্ঞানপাপী হওয়ার জন্য?
মু. আবদুল হাকিম
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব