ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ডাকসু প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশ ও জাতির মুক্তির কান্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। একাধারে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা ডাকসু নেতৃত্ব দিয়েছে অগ্রভাগে। দেশের রাজনীতিতে তৈরি হয়েছেন অসংখ্য জাতীয় নেতা। অথচ আজ সেই রাজনীতির সূতিকাগার ডাকসু অচল।
শিক্ষার্থীদের সকল দাবি-দাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির শুরুর দিক থেকে অর্থাৎ ১৯২২-২৩ থেকে ডাকসুর সূচনা হয়। ডাকসুকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট বলা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সগৌরবে তার শতবর্ষ পূরণ করে ফেললেও ডাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র ৩৬ বার। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসিত পরাধীন দেশে নিয়মিত ডাকসু হলেও স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে ৫২ বছরে ডাকসু হয়েছে মাত্র আটবার। ১৯৯০ সালের পর দীর্ঘ ২৮ বছর বিরতিতে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তানি শাসনামল কিংবা স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলেও ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন পরবর্তী তথা ১৯৯০-৯১ এরপর কোনো সরকারই নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার সাহস করেনি। কারণ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য, ক্যাম্পাসগুলোতে ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করতে এবং দখলদারির মাধ্যমে দলদাস লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি চালু করেছে। ফলে জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির কারখানা ডাকসু ও সারা দেশের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছে।
দীর্ঘ ১৫ বছর বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও ক্যাম্পাস। এমতাবস্থায় ডাকসুর নির্বাচন দিলে বিরোধী দলগুলো সক্রিয় হতে শুরু করবে। যা সরকারি দল নিজেদের জন্য হুমকি বলে মনে করে। ফলে তারা কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদিও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান তবুও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের কাছে অসহায়। এসব কারণে ২০১৯ সালে পরীক্ষামূলক ডাকসু নির্বাচন হলেও ভবিষ্যতে নির্বাচন হবে কিনা তা একেবারেই অনিশ্চিত।
ডাকসু থেকে নির্বাচিত নেতারা পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠতেন রাজনৈতিক নেতাও। নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার কারণে জাতীয় রাজনীতিতে যাওয়ার এই নিয়মতান্ত্রিক সুযোগটুকু হারিয়েছে। এখনকার দলীয় ছাত্রনেতাদের কাছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি পৌঁছায় না। দেশ ও দশের জন্য ছাত্রনেতাদের ঝাঁজালো কণ্ঠ আর শোনা যায় না।
যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে হল থেকে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের বের করে দেওয়া, মারধর, গেস্টরুম নির্যাতন, হলের আসন বণ্টন নিজেদের কর্তৃত্বে রাখা এবং হলের ছাত্রদের জোর করে নিজেদের কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ অসংখ্যবার খবরের শিরোনাম হয়। ছাত্র রাজনীতির এ বেহাল দশা ঘোচানোর জন্য হলেও ডাকসু নির্বাচন প্রয়োজন। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের ছাত্রনেতাকে বেছে নিতে পারে। ফলে হলগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের একক আধিপত্য বজায় রাখতে পারে না। যা হল এবং ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহিংসতা অনেকাংশেই কমিয়ে আনে।
আবার নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন হলেই যে জাতীয় রাজনীতিতে রাতারাতি বিপ্লব ঘটে যাবে তা নয়। কিন্তু ক্যাম্পাস রাজনীতিতে সহিংসতা ও উগ্রতা অনেকাংশেই কমে আসবে। ছাত্রসংগঠনগুলো দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। দলীয় কমান্ডের চেয়ে গুরুত্ব পাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশা। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় খোলস থেকে বের করা যাবে। ডাকসুর মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আশা-আকাঙ্ক্ষা ও নিজেদের দাবি-দাওয়া প্রকাশের একটি মুক্তমঞ্চ খুঁজে পাবে। আর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত তরুণ নেতৃত্ব ক্রমান্বয়ে অর্জন করবে গোটা দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা।
নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিকে ত্বরান্বিত করবে। তারাও উৎসাহিত হবে সুষ্ঠু ধারায় গণতন্ত্র চর্চা করতে। এভাবেই ক্রমান্বয়ে পুরো দেশের অনিয়ন্ত্রিত ছাত্র রাজনীতির লাগাম টানা সম্ভব হবে। একটি জরাজীর্ণ ছাত্র রাজনীতির সংকট রাতারাতি না কাটলেও কয়েক দশকের ব্যবধানে হলেও এর বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাবে। তাই অতিসত্বর ডাকসু নির্বাচন দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
তামান্না আক্তার
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: [email protected]