কাঁথা মুড়ি দিয়ে আরাম করে অবকাশ যাপন করার জন্য বেশ উপযুক্ত পরিবেশ হলেও বৃষ্টি শহরের শ্রমজীবী মানুষের জীবনে বাড়তি ভোগান্তি নিয়ে আসে সব সময়ই।
জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামতে ও অবস্থান করতে হয় রিকশাচালকসহ শ্রমজীবী নানা পেশার মানুষকে। তাঁদের অবস্থা এ রকম, এক দিন কাজে বের না হলে পরের দিন পেটে ভাত জুটবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার কারণে দুর্যোগে তাঁরা কর্মক্ষেত্রে ন্যূনতম অনুকূল পরিবেশটুকুও পান না।
একটানা বৃষ্টিতে ভেজার ফলে জ্বর, ঠান্ডাসহ নানান রকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন এবং সেই অসুস্থ অবস্থাতেও তাঁদের কাজ করে যেতে হয়। এভাবে একটানা অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে বাধ্য হলে নিউমোনিয়াসহ আরও নানান ভয়ংকর রোগের ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
একটা জরুরি কাজে রিকশায় যাতায়াতের প্রয়োজন পড়ে। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। তো একটানা বৃষ্টিতে ভেজার কারণ জিজ্ঞেস করলে রিকশাওয়ালা উত্তর দেন, ‘জ্বর আসলে কী আর করব মামা? কেউ সাধে বৃষ্টিতে বের হয় না, পেটের জ্বালায় বের হইতে হয়।’ মামার লাল চোখে বলা এই কথা ভেতরটা তোলপাড় করে দিল।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ, সুস্থ থাকতে পারাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। আমাদের ভোগান্তি লাঘব করার জন্য যাঁরা একটানা বৃষ্টিতে ভিজে চলেছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তাঁদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা সময়ের দাবি। তাঁদের জন্য প্রাথমিকভাবে কিছু করার চিন্তা আমরা করতে পারি, যার ফল দীর্ঘমেয়াদি হবে। আমাদের ক্রমান্বয়ে কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত, যাতে তাঁদের জীবনমানের উন্নয়ন আমরা ঘটাতে পারি।
আমরা প্রত্যেক শ্রমজীবী মানুষের জন্য একটা করে মানসম্মত রেইনকোট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি, যা তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করতে পারবেন। রেইনকোটটি যেন টেকসই হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিয়ে কোম্পানিগুলো উদ্যোগ নিতে পারে, স্বল্প লাভে এটি উৎপাদনের। আমরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তাঁদের মধ্যে এটি বণ্টনের দায়িত্ব পালন করতে পারি। শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা এবং এলাকাভেদে তাঁদের অনুপাত হিসাব করে নিয়ে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারি, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর।
আরও একটা বড় সমস্যা হচ্ছে নিরাপদ খাওয়ার পানি এবং টয়লেটের অপ্রতুলতা। শ্রমসাধ্য কাজ করার জন্য তৃষ্ণা বেশি পায়, পানি বেশি খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেভাবে খাওয়ার পানি পান না শ্রমজীবী মানুষেরা। তাঁদের জন্য পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) নামে একটি সংগঠনের জরিপে উঠে আসে ঢাকার ৯৪ শতাংশ রিকশাচালকই অসুস্থ থাকেন। বিশেষ করে জ্বর-কাশি, ঠান্ডা, গায়ে ব্যথা, দুর্বলতা লেগেই থাকে। সেই সঙ্গে ৩০ শতাংশ জন্ডিসে আক্রান্ত বলে ওই জরিপে উঠে এসেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেখানে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠিয়ে দিচ্ছে, সেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের কথা বলাই বাহুল্য। বেশির ভাগ রিকশাওয়ালা তাঁদের দিনের খাওয়া সারেন বিভিন্ন টংয়ের দোকানে রুটি, কেক ও চা খেয়ে। যেন তাঁরা ভাত খাওয়ার পয়সা সাশ্রয় করতে পারেন। এখন রাস্তাঘাটে যদি তাঁদের কথা ভেবে সস্তায় পুষ্টিকর খাবার বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হতো, তাহলে তাঁদের হয়তো এতটা ভোগান্তির মুখে পড়তে হতো না বলে মনে করছে সংস্থাটি।
এ ছাড়া রিকশার আকৃতি ও প্রকৃতি দেশটিতে গড়পড়তা যে শ্রমিকেরা আছেন তাঁদের জন্য আদর্শ নয়। যে চালক লম্বা তাঁকে রিকশাটা নুয়ে চালাতে হয়। আবার যারা খাটো, তাঁদের চালাতে হয় দাঁড়িয়ে। যাঁরা শারীরিক প্রতিবন্ধী, তাঁরাও রিকশা চালান, কিন্তু রিকশাটা তাঁদের অনুযায়ী আরামদায়ক করে তৈরি হয় না। যার কারণে তাঁরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন। এ বিষয়গুলো সব সময় এড়িয়ে যাওয়া হয়। এতে অনেক শ্রমিকের গায়ে ব্যথা, দুর্বলতা থেকে শুরু করে তাঁদের কাজ করার ক্ষমতা আগের চেয়ে কমে যায় বলে গবেষণায় উঠে আসে। অর্থাৎ বেশির ভাগ শ্রমিক দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করতে পারেন না।
জুলাই বিপ্লবে প্রতিটা শ্রেণির, প্রতিটি পেশার মানুষজন আমাদের পাশে ছিল। আমরা যেন তাঁদের না ভুলে যাই। তাঁদের প্রতি আমাদের কর্তব্য যেন আমরা এড়িয়ে না যাই। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে শ্রমজীবী মানুষকে আলাদা করার সুযোগ নেই। তাঁদের জীবনমানের উন্নয়নের কথা চিন্তা করার বিকল্প নেই। আমাদের প্রত্যেককেই তাঁদের জন্য এগিয়ে আসা উচিত নিজ নিজ জায়গা থেকে।
শেখ তাসনিম আফরোজ
সাবেক ভিপি, শামসুন নাহার হল সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়