দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুপেয় পানির সমস্যা এতটাই প্রকট যে বলা হয়, দক্ষিণবঙ্গে শুধু মায়েদের চোখের জলটুকুই বিশুদ্ধ, বাকি সব লবণাক্ত জল।
ভূপৃষ্ঠের মোট আয়তনের ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ পানি আর বাকি ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ স্থল। অর্থাৎ ৭ শতাংশের ৫ শতাংশই পানি। এই ৫ শতাংশ পানির ৯৭ শতাংশই লবণাক্ত। মাত্র ৩ শতাংশ সুপেয় পানি, এর মধ্যে আবার বরফও রয়েছে।
ওপরের এই পরিসংখ্যান অবলোকন করতে পৃথিবী ঘুরে দেখার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা জেলার উপকূলীয় উপজেলাগুলোর চিত্র দেখলেই তা জানা যাবে। এসব অঞ্চলে গেলে স্বাভাবিকভাবে মনে হবে পানির অভাব নেই। এটাও সত্য কথা, আসলেই পানির অভাব নেই। কিন্তু সামান্য কিছু বাদ দিয়ে অধিকাংশ জায়গার পানিই লবণাক্ত।
শুধু সুপেয় পানি পান করার জন্য এসব অঞ্চলের মানুষের যেতে হয় কয়েক কিলোমিটার দূরে। এত দূর যাওয়ার পরও সব জায়গায় নলকূপ নেই। নির্দিষ্ট কিছু জলাশয়, যেগুলো সরকারি পুকুর নামে পরিচিত, সেখানের পানি পান করে মানুষ। এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে সরকারি পুকুরের পাশে খাল থাকে। খালের পানি লবণাক্ত, যার ফলে পুকুরের পানিও কিছুটা লবণাক্ত থাকে। কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষের কিছুই করার নেই। ওই পানিই খেতে হয়। কারণ, দূরের সুপেয় পানির নলকূপ থেকে পানি আনতে জায়গাভেদে ২৫০-৩৫০ টাকা নেন ভ্যানচালকেরা। গ্রীষ্মকালে আরও বেশি নেন।
এতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন মায়েরা। তাঁরা না পারেন পরিবারের সদস্যদের লবণাক্ত পানি খাওয়াতে, আবার ৩-৫ কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনাও খুব কষ্টকর৷ যদিও তাঁরা এই কষ্টটা করে থাকেন। যদিও সরকার পানি সংরক্ষণ করে রাখার ট্যাংক দিচ্ছে গ্রাম পর্যায়ে, যাতে বৃষ্টির পানি সারা বছর ব্যবহার করা এবং পান করতে পারে মানুষ। তবে এটা এখনো সবাই পায়নি।
সুপেয় পানির অভাব দূর করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে নেওয়া হয়েছিল একটি প্রকল্প। বিভিন্ন জায়গায় সরকারি পুকুর করা এবং পুকুরের পাশে ফিল্টার স্থাপন করা হয়। কিন্তু নিয়মিত তদারকির অভাবে অনেক সময় সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। আবার সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনেই দেখা যায়, অনেক জায়গায় সংস্কার করার পর সরকারি পুকুরগুলোতে মানুষের নামা বন্ধ করে নিজেদের সুবিধামতো পুকুরে মাছ এবং পাড়ে সবজি চাষ করেছে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী। তবে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বিপদে পড়েন যখন সরকারি পুকুরগুলোতে নির্দিষ্ট দিনে টিকিট দিয়ে মাছ ধরা হয়। অন্তত ৭-১০ দিনের মধ্যে তখন আর ওই পানি খাওয়া যায় না। এই মাছ চাষ এবং মাছ শিকারের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীসহ অনেকে জড়িত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পকেও যদি এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, তাহলে সুপেয় পানির জন্য দক্ষিণবঙ্গের মানুষের হাহাকার দূর কীভাবে হবে? এ বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবী যতগুলো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তার মধ্যে স্বাদুপানির সমস্যা অন্যতম। বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গে গভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব না। দিন দিন পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। আবার নলকূপ স্থাপন করলেও সেই পানিতে আর্সেনিক পাওয়া যায়। ফলে সেই পানি পানের অযোগ্য।
মূলত ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোনাপানি চলে আসে লোকালয়ে। আর চিংড়িঘেরের জন্য স্লুইসগেটের মাধ্যমে নিয়মিত লোনাপানি তো ঢুকছে। ঘেরে লোনাপানিতে চিংড়ি চাষ সুপেয় পানির অভাবের অন্যতম প্রধান কারণ।
আন্তর্জাতিক সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের গবেষণায় জানা গেছে, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দক্ষিণবঙ্গে বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার কৃষিজমি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। চিংড়ি চাষের জন্য লোনাপানি আনতে ছিদ্র করে বাঁধ দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। যার কারণে এসব এলাকায় সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতার। বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে কৃষিজমি লোনাপানির নিচে থাকছে। ফলে জমির উর্বরতা কমছে।
এ এলাকার যেসব মানুষ আগে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত, তাদের অধিকাংশই বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকে অন্য কাজ করছে। কিন্তু তারা আগে যেমন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ছিল, এখন তেমন নেই। অর্থনৈতিকভাবে অনেক অসচ্ছল হয়ে গেছে তারা। এই সম্পর্কিত প্রতিটি গবেষণায় দেখা গেছে, লোনাপানিতে চিংড়ি চাষের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে এসব অঞ্চলের চাষের জমি প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে। ৪০ শতাংশ কৃষিজমি মারাত্মক হুমকির মুখে। গবেষকেরা বলছেন, ঘন ঘন লোনাপানির প্লাবনে ইতিমধ্যে অনেক কৃষক ধান চাষ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। কৃষকেরা ধানের জমিতে চিংড়ি বা অন্য সামুদ্রিক মাছের চাষ করছেন এখন। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে বর্গাচাষিদের আয় বছরে ২১ শতাংশ কমেছে। একদিকে চাষাবাদ কমছে, অন্যদিকে সুপেয় পানির অভাব। মানুষ উভয়সংকটে পড়েছে।
লবণাক্ত পানি পানের কারণে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে মানুষের ওপর। আইসিডিডিআরবির গবেষণায় জানা গেছে, লোনাপানির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের নারীদের গর্ভপাতের হার অন্য জায়গার তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। এটা খুবই চিন্তার বিষয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির প্রতিদিন ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষকে প্রতিদিন ২০০ গুণের বেশি লবণ খেতে হচ্ছে, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, পানির সমস্যা সমাধানে সরকারপ্রধান নিজে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এবং অনেক টাকাও বাজেট করা হয়েছিল। কিন্তু দিন শেষে মানুষের দুর্দশা লাঘব হওয়া তো দূরের কথা, অনেকাংশে বেড়ে গেছে। বিশুদ্ধ পানি সহজলভ্য করার জন্য যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল, সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে প্রতিটি জায়গায় এর সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দুর্নীতি করেছেন। যার ফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ। সরকারের উচিত দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া৷ তা না হলে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের পানির জন্য হাহাকার দূর হবে না।
সুকান্ত দাস
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া